মুম্বই: লোকসভা নির্বাচন থেকে বিধানসভা নির্বাচন। মাঝে ৬ মাসের ব্যবধান। এই ৬ মাসের মধ্যেই আমূল পরিবর্তন। লোকসভা নির্বাচনে যেখানে বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে টান পড়েছিল, সেখানেই মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে গেরুয়া ঝড়। ২০০-রও বেশি আসনে এগিয়ে বিজেপির নেতৃত্বাধীন মহাযুতি। কৃষক আন্দোলন, মারাঠা সংরক্ষণ থেকে শুরু করে অন্তর্ঘাত, বিশ্বাসঘাতকতা- কোনও ইস্যুকেই কাজে লাগাতে পারেনি। কোন ম্যাজিকে মারাঠাভূমে এমন অভূতপূর্ব ফল করতে পারল বিজেপি?
লোকসভা নির্বাচনে এনডিএ-র স্লোগান ছিল, আব কি বার, ৪০০ পার। বিজেপি একাই ৩০০ পার করার লক্ষ্যমাত্রা রেখেছিল। কিন্তু ভোটের ফলে দেখা গেল, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার অঙ্কেও পৌঁছতে পারেনি বিজেপি। এরপরই সমালোচকরা বলেছিলেন, ফিকে হচ্ছে মোদী ম্যাজিক। কিন্তু ৬ মাসের ব্যবধানেই মহারাষ্ট্রে এই দারুণ ফল। ২৮৮ আসনের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি একাই ১২৭টি আসনে এগিয়ে। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও, জোটসঙ্গীদের নিয়ে সরকার গড়ার জন্য এই আসন যথেষ্ট। সম্প্রতি হরিয়ানা নির্বাচনেও যেমন স্টেজে এসে মাত করেছিল বিজেপি, তারই পুনরাবৃত্তি হয়েছে মহারাষ্ট্রেও। মোদী-শাহের কার্পেট বম্বিং, বিজেপির ডবল ইঞ্জিনে উন্নয়নের দ্বিগুণ গতির প্রতিশ্রুতিই কাজ করেছে ম্যাজিকের মতো।
এবারের মহারাষ্ট্র নির্বাচনের প্রচারে প্রধানমন্ত্রী মোদীর স্লোগান ছিল, “এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়”, “বাটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে”। মহারাষ্ট্রে ভোটে বরাবরই একটা বড় ফ্যাক্টর হিন্দুত্ব। একসময়ে বাল ঠাকরের প্রতিপত্তি ছিল এই হিন্দুত্বের স্লোগানেই। উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা থেকে একনাথ শিন্ডের শিবির আলাদা হওয়ার সময়ও হিন্দুত্ব ইস্যুকেই হাতিয়ার করেছিল। এবারের নির্বাচনে যেখানে মহা বিকাশ আগাড়ি হিন্দু, মুসলিম, দলিত, সংখ্যালঘুদের এক সূত্রে বাঁধতে চেয়েছিল, সেখানেই বিজেপি হিন্দুত্ব ইস্যু নিয়ে মাটি কামড়ে পড়েছিল।
মধ্য প্রদেশে বিজেপির সাফল্যের পিছনে অন্যতম কারণ ছিল ‘লাডলি বেহেন’ যোজনা। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা শিবরাজ সিং চৌহানও এই কথা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। আর সেই হোমওয়ার্কই মহারাষ্ট্রের পরীক্ষার খাতাতেও লিখেছিল বিজেপি। ভোটের আগেই আনা হয় মাঝি লড়কি-বহিন যোজনা, যে প্রকল্পের অধীনে ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী মহিলাদের প্রতি মাসে ১৫০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। নির্বাচনে জিতলে এই ভাতা বাড়িয়ে ২১০০ টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে বিজেপি। মহারাষ্ট্রের ৫৫ শতাংশ ভোটারই মহিলা। ফলে ২ কোটিরও বেশি ভোটারদের প্রভাবিত করেছে বিজেপির এই নতুন প্রকল্প।
মহারাষ্ট্রে মারাঠা সংরক্ষণ নিয়ে আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। মারাঠা সংরক্ষণ আন্দোলনের অন্যতম মুখ মনোজ জারাঙ্গে পাটিলও নির্বাচনে সামিল হতে চেয়েছিলেন এই ইস্যুকে হাতিয়ার করেই। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভোটের ময়দান থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। ৩৩ শতাংশ মারাঠা ভোটারদের এই ভোট বিজেপির বিপরীতে যাবে বলেই হিসাব কষা হয়েছিল। কিন্তু মহাযুতি হিন্দুত্ব ইস্যুকে কাজে লাগিয়েই সেই ভোটও নিজেদের পকেটে এনেছে। বিদর্ভের মতো আসনেও শরদ পওয়ারের দলকে হারিয়ে মহাযুতিই এগিয়ে গিয়েছে। মহারাষ্ট্রের ৩৮ শতাংশ ওবিসি ভোটারদের সমর্থন বিজেপির দিকেই। রাহুল গান্ধীর সংবিধান বদলের ‘জুজু’ সেখানে কাজ করেনি।
মহারাষ্ট্রের ভোটারদের ৬৫ শতাংশই কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। বিদর্ভ, মারাঠাওয়াড়ার মতো আসনে কৃষক আন্দোলন বড় ইস্যু ছিল। সয়াবিন, তুলোর ন্যূনতম সহায়ক মূল্যও ভোটের আগে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। মহাযুতি বা মহা বিকাশ আগাড়ি- কেউই এই বিষয়টি এড়ায়নি। কিন্তু বিজেপির কাছে বড় হাতিয়ার হয় ডবল ইঞ্জিন সরকার। ভোটের ঠিক আগেই কৃষকদের ভর্তুকি দেওয়া, লোকসভা নির্বাচনের পরই কৃষকদের বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়ার ঘোষণা করা হয়। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে মহাযুতি কৃষিঋণ মকুব থেকে শুরু করে এমএসপি দেওয়ার উপরেই জোর দিয়েছিল। তার ফল হাতেনাতে পেয়েছে।