দেশের সবথেকে বেশি জনসংখ্যার রাজ্য উত্তর প্রদেশের রাজনীতিতে নজর রয়েছে গোটা দেশের। বলা হয়, কেন্দ্রে কে ক্ষমতায় থাকবে, সেটা নাকি নির্ধারণ করে দেয় এই রাজ্যই। আর এবার সে রাজ্যে শুধু ক্ষমতায় আসাই সাফল্য নয় বিজেপির, কার্যত ইতিহাস গড়ার পথে গোরক্ষনাথ মঠের মহান্ত যোগী আদিত্যনাথ। গত কয়েক দশকের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, সব দলেরই উত্থান-পতন হয়েছে। একই মুখ্যমন্ত্রী দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছেন, এমন নজির নেই গত ৩৭ বছরে। তাই ২২-এর জয় অনেক দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ গেরুয়া শিবিরের কাছে।
গত ৩৭ বছরে কোনও মুখ্যমন্ত্রীকে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় ফিরে আসতে দেখা যায়নি উত্তর প্রদেশে। বৃহস্পতিবার ফলাফলের যে প্রবণতা সকাল থেকে সামনে এসেছে, তা থেকে স্পষ্ট যোগীই গড়ছেন সেই রেকর্ড। নারায়ন দত্ত তিওয়ারি ছিলেন এই রাজ্যের শেষ মুখ্যমন্ত্রী যিনি দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় ফিরেছিলেন। এরপর আর তৈরি হয়নি সেই নজির।
যোগীর ঝুলিতে থাকবে আরও একটি রেকর্ড। তিনি এই রাজ্যের তৃতীয় মুখ্যমন্ত্রী যিনি পাঁচ বছরের মেয়াদ সম্পূর্ণ করেছেন। যোগীর আগে অখিলেশ যাদব ও মায়াবতী ছাড়া আর কেউ টানা পাঁচ বছর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব সামলাননি। এখনও পর্যন্ত মোট ২১ জন মুখ্যমন্ত্রী দেখেছে উত্তর প্রদেশ, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুলায়ম সিং যাদব, চৌধুরী চরনজিৎ সিং, কল্যান সিং, রাজনাথ সিং- এর নাম।
একেবারে শুরুর দিকে তাকালে দেখা যাবে একটানা এক দশকেরও বেশি সময় কংগ্রেসের হাতে ছিল উত্তর প্রদেশ। পরে ১৯৮০-তে ফের ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। মুখ্য়মন্ত্রী হন ভিপি সিং। তবে তাঁর আমলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। দুষ্কৃতীদের হাতে খুন হন তাঁর নিজের ভাই। সেই পরিস্থিতিতে তিনি কুর্সি ছেড়ে দিলে মুখ্যমন্ত্রী হন এনডি তিওয়ারি। পরের ভোটেও তিওয়ারির হাত ধরেই ক্ষমতায় ফেরে কংগ্রেস। সেই শেষবার কোনও দল ক্ষমতায় ফিরেছিল। যদিও যোগীর মতো তাঁর মেয়াদ শেষ করা হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী পদে রাজীব গান্ধী বসিয়েছিলেন বীর বাহাদুর সিং-কে।
১৯৯৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে ১৭৪ আসনে জয়ী হয়েছিল বিজেপি। সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে হয়ে সে সময়। এরপর ১৯৯৭ -এর এপ্রিলে বিজেপি ও বহুজন সমাজবাদী পার্টির মধ্যে সমঝোতা হয়। ঠিক হয় ৬ মাস বিজেপি ও ৬ মাস বিএসপি থাকবে মুখ্যমন্ত্রী আসনে। সেই মতো কুর্সিতে মায়াবতী বসেছিলেন ৬ মাস। পরে জনতান্ত্রিক বিএসপি ও লোকতান্ত্রিক কংগ্রেস বিজেপির সঙ্গে সরকার গঠন করে। ১৯৯৮- তে সেই সরকার ভেঙে দেন তৎকালীন উত্তর প্রদেশের রাজ্যপাল রমেশ ভাণ্ডারী। সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী হন কংগ্রেসের জগদম্বিকা পাল। ক্ষমতা ফিরে পেতে আদালত পর্যন্ত গিয়েছিলেন কল্যান সিং। পরে আদালতের নির্দেশে আবারও মুখ্যমন্ত্রী পদ ফিরে পান তিনি।
বর্তমানে দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীও একসময় সামলেছেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদ। ১৯৯৮-তে ওই পদে ছিলেন কল্যান সিং। তাঁর বিরুদ্ধে দলের অন্দরে ক্ষোভ বাড়লেও পদ ছাড়তে রাজি ছিলেন না তিনি। কিন্তু বিজেপি চেয়ারে বসিয়ে দেয় রাম প্রকাশ গুপ্তাকে। জাঠদের ওবিসি সংরক্ষণের আওতায় আনে গুপ্তা নেতৃত্বাধীন সরকার। গুরুত্ব হারিয়ে বিজেপি ছাড়েন কল্যান। আর এর কয়েক মাসের মধ্যেই পদ্ম শিবিরের অপছন্দের তালিকায় উঠে আসে রাম প্রকাশ গুপ্তার নাম। এরপরই ২০০০ সালে মুখ্যমন্ত্রী করা হয় রাজনাথ সিং-কে। ১৮ মাস ওই পদে ছিলেন রাজনাথ।
যদিও তাঁর বিরুদ্ধে বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, তিনি একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষকেই চাকরির সুযোগ করে দিচ্ছেন, তবে স্বচ্ছ রাজনীতিকদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিলেন রাজনাথ। চুরি-ডাকাতি, দুষ্কৃতীরাজে কুখ্যাত উত্তর প্রদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে নজর দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ২০০০ সালের গুজরাত দাঙ্গার পর বিজেপির প্রতি আস্থা কমে যায় মানুষের। প্রাসঙ্গিকতা হারায় গেরুয়া শিবির। এরপরই ইস্তফা দিয়ে দিল্লি ফিরে যান রাজনাথ।
কখনও বিজেপির সঙ্গে, কখন মুলায়ম তথা সপার সঙ্গে জোটে থেকে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন মায়াবতী। তবে ১৯৯১-তে তাঁর চতুর্থবার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ঘটনা ঐতিহাসিক। কারণ, সেবারই প্রথম একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল বিএসপি। ২০০৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত পদে থেকে প্রথম মেয়াদ সম্পূর্ণ করার নজির গড়েছিলেন মায়াবতী।
সমাজবাদী পার্টিকে তখন পেশীশক্তির দল বলে চিহ্নিত করা হচ্ছিল। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার মুলায়ম-পুত্র তখন দলের ভাবমূর্তি বদলাতে নামলেন আসরে। দল থেকে দুষ্কৃতীদের দূরে সরিয়ে দিলেন। তারপর ফ্রিতে ল্যাপটপ দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতেই কাজ হল। ২২৪ আসনে জিতে ক্ষমতায় এল সপা। যা অনুমান করা হচ্ছিল, সেটাই সত্যি হল। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে কুর্সিতে বসলেন অখিলেশ যাদব, রাজ্যের কনিষ্ঠতম মুখ্যমন্ত্রী।
১৪ তে ক্ষমতায় এলে মোদী। দেশ জুড়ে তখন মোদী-ঝড়। আর সেই আবহেই উত্তর প্রদেশ নির্বাচন ২০১৭ তে। কোনও জোটসঙ্গীর আশন গুনতেই হল না বিজেপিকে। গেরুয়া ঝড় তুলে ৩১২ আসনে জয়ী হয় বিজেপি। কোনও মুখ্যমন্ত্রী মুখ সামনে না এনেই সে বার লড়েছিল পদ্ম শিবির। ফল প্রকাশ হতেই বড়সড় চমক দিলেন মোদী-শাহরা। মুখ্যমন্ত্রী করা হল গোরক্ষপীঠের মহান্তকে। এমনকি দলের অন্দরেও চমকে গেলেন অনেকে। আগে সাংসদ থাকলেও যোগীকে যে মুখ্যমন্ত্রী করা হবে, তা আশা করেননি অনেকেই।
মুখ্যমন্ত্রী আসনে গেরুয়া বসনধারীকে ভালো চোখে দেখেননি অনেকেই। হিন্দুত্বের তাস বলে কটাক্ষ করেছিলেন কেউ কেউ। পাঁচ বছরে বিতর্কও হয়েছে অনেক। শিরোনামে উঠে এসেছে হাথরাস, লখিমপুর। আবার এই পাঁচ বছরেই শুরু হয়েছে রাম মন্দির নির্মানের কাজ। তাই এবারের ফলাফলে কী প্রভাব পড়বে, সে দিকে নজর ছিল বিশ্লেষকদের। ফল প্রকাশ হতে দেখা গেল, যোগী ম্যাজিক এখনও বর্তমান। ২৫০- এর বেশি আসনে আবারও ক্ষমতায় আসছে বিজেপি।
আরও পড়ুন : UP Assembly Elections Results: ‘আমারই জিতব’, ফল প্রকাশের দিন সপা কর্মীদের টিভি দেখতে নিষেধ অখিলেশের!