Dialogues 2021: প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে ‘কথোপকথন’, এ দেশের সবথেকে পুরনো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ‘ডায়ালগস’

ভারতবর্ষের সবথেকে পুরনো এলজিবিটিকিউআইএ+ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ডায়ালগস এ বছর পা দিল ১৫-য়। ২০০৭ সাল থেকে এযাবৎ কেমন এই ফেস্টিভ্যালের যাত্রাপথ? 

Dialogues 2021: প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে ‘কথোপকথন’, এ দেশের সবথেকে পুরনো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ‘ডায়ালগস’
অলঙ্করণ- অভীক দেবনাথ।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Nov 26, 2021 | 7:36 PM

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায় 

ডায়ালগস ২০২১, ১৫তম ক্যালকাটা ইন্টারন্যাশনাল এলজিবিটিকিউআইএ+ ফিল্ম অ্যান্ড ভিডিও ফেস্টিভ্যাল—সাফো ফর ইকুয়ালিটি, প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট ও গ্যেটে ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে এ বছরের ডায়ালগস শুরু হয়েছে গতকাল, ২৫ নভেম্বর। চলবে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত। ভারতবর্ষের সবথেকে পুরনো এলজিবিটিকিউআইএ+ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল যা এ বছর পা দিল ১৫-য়। কোভিডের কারণে এ বছরও এই ফেস্টিভ্যাল ভার্চুয়াল। এই প্রসঙ্গেই TV9 বাংলার তরফে যোগাযোগ করা হল প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা অনিন্দ্য হাজরা ও সাফো ফর ইকুয়ালিটি-র ম্য়ানেজিং ট্রাস্টি কোয়েল ঘোষের সঙ্গে।

অনিন্দ্য হাজরা, প্রতিষ্ঠাতা, প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট

১. ডায়ালগস—ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মাধ্যমে এলজিবিটিকিউআইএ+ নিয়ে কথোপকথন শুরুর গোড়ার দিকটা ঠিক কেমন ছিল?

শুরুটা একটা টালমাটাল সময়ের মধ্যে। আমি আর মালবিকাদি (সাফো ফর ইকুয়ালিটি-র মীনাক্ষী সান্যাল) একটা নারীবাদী মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী-দলের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম-এর অংশ হিসেবে ২০০৭-এ নন্দীগ্রামে  গিয়েছি—মার্চ মাসের সেই ঘটনার কিছুদিন বাদেই। প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট-এর কাজের বিষয় রূপান্তরকামী মানুষের সামগ্রিক অধিকার স্থাপনের লড়াই। কিন্ত এই বিষয়টা কেবল একটা আইডেন্টিটি পলিটিক্সের চৌখুপিতে আবদ্ধ রাখতে আমরা কোনওদিনই চাইনি। রাখিওনি। রাষ্ট্রব্যবস্থার চোখরাঙানির যে বীভৎস ছবি সে দিন আমরা দেখেছিলাম, সে দিনই কলকাতায় ফেরার পথে আমি আর মালবিকাদি স্থির করলাম যে, যুগ্মভাবে একটা দীর্ঘমেয়াদী কাজ, যার মধ্যে একটা ট্রান্সফরম্য়াটিভ পলিটিক্স থাকবে, সেটা শুরু করা বড্ড প্রয়োজন। দেখলাম, চলচ্চিত্র বা সিনেমা নিয়ে এই শহরের যে ইন্টেলেকচুয়াল হেরিটেজ রয়েছে, যে কাজ, আন্দোলন, আহ্লাদ, উদ্দীপনা (বা কখনও আদিখ্যেতা) সেখানে ক্যুয়ের (queer) সিনেমা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও চর্চা প্রায় নেই বললেই চলে। আমি নিজে কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বহু বছর গিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম স্টাডিজ় পড়েছি। আমাদের কাজে বিভিন্ন তথ্যচিত্র ও প্রাসঙ্গিক চলচ্চিত্র দেখিয়েছি। কিন্তু কৃষ্টি, সংস্কৃতির মারাত্মক ব্রাহ্মণ্যবাদী এই দুনিয়ায় ক্যুয়ের সিনেমার প্রবেশ কিংবা তা নিয়ে কথোপকথন প্রায় নিষিদ্ধ। ক্যুয়ের সিনেমা বলে চিহ্নিত যদি কোনও ক্ষেত্র থেকে থাকে, সেখানকার অভ্যন্তরীণ কাঠামোগুলো (hierarchy) নিয়েও ভাবনা ছিল, সেই ক্রিটিকটা পরে আরও সামনে এসেছে এবং সেগুলো অ্য়াড্রেস করতে চেষ্টা করেছি, (সেটা নিয়ে পরে বলছি)—কোথাও এই ছুতমার্গিতা একটা প্রচণ্ড অন্যায্য বলে মনে করেছি। তাই ডায়লগস একটা প্রতিস্পর্ধার জায়গা থেকে তৈরি হয়। একটা কাউন্টার-কালচার অথবা সাব-কালচার অথবা ভয়েস—এইটা জিইয়ে রাখাটা একটা প্রয়োজন বলে আমি সবসময় মনে করি। ডায়লগস নামকরণটা শুরুতে ছিল না যদিও। ওটা পরে আসে—আমাদের বন্ধু বোধিসত্ত্ব ঘোষের দেওয়া। আমার আজও মনে আছে, এই উৎসবের প্রথম ছবি মিশ্র বংশোদ্ভূত মার্কিনি চলচ্চিত্র নির্মাতা আর্থার ডং-এর ১৯৯৭-এর তথ্যচিত্র ‘লাইসেন্স টু কিল’—সমকামী মানুষদের হত্যাকারী সাতজন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার, যেখানে ছবির নির্মাতা (যিনি নিজেও একজন সমকামী হওয়ার কারণে বিদ্বেষজনিত একটা আক্রমণের সার্ভাইভার) একটাই প্রশ্ন করছেন এদেরঃ “কেন হত্যা করলেন?” রক্ত হিম করা বর্ণনা, ব্যাখ্যা, কোথাও আবার অনুতাপ। যে জরুরি অবস্থার মধ্যে আজ আছি, কোথাও তার আঁচ ছিল বহমান হিংস্রতার মধ্যে দিয়েই।

২. কলকাতা শহরের এই ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল গত ১৫ বছরে কতটা আন্তর্জাতিক বা গ্লোবাল হয়ে উঠল?

আন্তর্জাতিক হয়েছে যত, তত জাতীয় আর স্থানীয়ও হয়েছে এই উৎসব সমান তালে। কোনও একক একটা পরিচয় পাবে এই উৎসব—সেটা আমরা চাইনি। তাই কোন ছবি, কোন ধরণের নির্মাণ, কোথাকার নির্মাতা এই সব কিছু দিয়েই এই চলাচলটা স্থিরীকৃত। ভেনিস কিংবা কান-এর সেই বছরে প্রদর্শিত ছবি কিংবা বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের টেডি আওয়ার্ড পাওয়া ছবিগুচ্ছর পাশাপাশি থেকেছে তথাকথিত কলকাতার বাইরের কোনও ছবি নির্মাতার কাজও। কখনও সেটা তাঁর প্রথম কাজ, ক্রাফ্ট হয়তো কাঁচা। থেকেছে Fassbinder-এর ছবির শেষ প্রিন্ট প্রদর্শন, Derek Jarman-এর Agnes Varda-র মতো ছবির রেট্রোস্পেক্টিভ। ‘প্রাদেশিক’, ‘আঞ্চলিক’, ‘amateur’—এই যাবতীয় বহু ট্যাগের ছবিই ফেস্টিভ্যালে স্থান পেয়েছে award winning, critically acclaimed জাতীয় ছবির সঙ্গে সঙ্গেই।

LGBTQI Film Festival 2021

৩. এই ১৫ বছরের যাত্রাপথে সবথেকে প্রিয় ৩টে স্মৃতি কী?

১৫ বছরের বেশ কিছু সুখস্মৃতি রয়েছে—আমার জন্যে সেটার প্রায় সবটাই বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের পুরনো ম্যাক্স মুয়েলার ভবনের বাড়িটাকে কেন্দ্র করে। ডায়লগস-এর গোড়াপত্তন এবং প্রথম এক দশক ঐ বাড়িতে অবস্থিত প্রেক্ষাগৃহে যা সাক্ষী থেকেছে এই শহরের বহু ঘটনার, আমাদের উৎসবেরও। যেটা সব চাইতে মনে পড়ে সেটা হল, ঐ বাড়ির আর্কিটেকচারের কিছু বিশেষত্ব… অদ্ভুত লাগল হয়তো যে, উৎসবের সঙ্গে এই নির্মাণশৈলির কী সম্পর্ক? কিন্তু আছে, সিনেমার সঙ্গে এই সবই যে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাড়িটার বেসমেন্টে একটা ভল্ট ছিল… প্রমাণ সাইজের। সেটাতে সেলুলয়েডের প্রিন্টের ক্যানগুলো রাখা হত বলে পরে জেনেছি। আমি যখন দেখেছি তখন ঐ ঘরটা অফিস ঘরে পরিণত হয়ে গিয়েছে। যদিও ভল্টগুলো ছিল। আরেকটা দিক ছিল প্রেক্ষাগৃহের পাশের টেকনিক্যাল রুমটা। মিস্টার ঘোষ ও মিস্টার মাইতি বসতেন… মাইতিদা বর্তমানে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু ওঁদের কারিগরি দক্ষতা অপরিসীম। ওঁদের কাছ থেকে ছবি প্রদর্শনীর কারিগরি দিকের অনেককিছু শিখেছি। দেখেছি প্রস্তুতি কোন পর্যায় নিয়ে যেতে হয়। এমনিতেই আমরা টীম হিসেবে খুব খুঁতখুঁতে। তার উপরে এই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কাজটা করতে দেখা, তা একটা বাড়তি পাওনা ছিল। ঐ প্রেক্ষাগৃহের প্রজেকশন রুমে যেতে হত একটা ছোট ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে। ওখান থেকেই আমরা ম্যাক্স মুয়েলার ভবনের শেষ সেলুলয়েড প্রিন্ট দেখাই ডায়লগস-এঃ একটা রেট্রোস্পেক্টিভে ফাসবিন্ডারের ৩টি ছবি। ওই বাড়িটার সঙ্গে যেটা অন্যতম স্মৃতি, সেটা তখনকার প্রোগ্রাম অফিসার শ্রী রাজু রমণ মশাইয়ের সঙ্গে। এই শহরের সাংস্কৃতিক বহু ঘটনার যিনি সাক্ষী এবং যাঁর সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তিনি আমাদের দ্বিতীয় বছরের শেষে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে কীভাবে একটা ফেস্টিভ্যালকে তৈরি করে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, সেই পাঠটা দিয়েছিলেন। ১৫ বছর ধরে ভারতবর্ষের এলজিবিটিকিউআইএ+ স্পেকট্রামের ক্রমে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রাচীনতম ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হয়ে ওঠার পিছনে সেই পাঠ খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শেষ যেটা না বললে নয়, সেটাও ওই বাড়িতেই ঘটে। ২০১২—ঋতুপর্ণ ঘোষ এর ‘চিত্রাঙ্গদা’ চিত্রায়িত হতে চলেছে ডায়লগস-এ। ওঁর আসার কথা। সব ঠিক। সে দিন মহরম ছিল। ঋতুপর্ণ যেখানে থাকতেন, সেখানে প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে মহরমের মিছিল বের হয়। দুপুরের দিকে ফোন করে বললেন, উনি আসতে পারবেন না। ওঁর গাড়ি বের করা অসম্ভব। যদি যেত তাহলে নাকি উনি হেঁটে বাড়ি থেকে পাশের রাস্তার মুখে এসে গাড়িতে চড়ে চলে আসতেন। সবাই ভাবছে কি হবে। একটু আশাহত। আমি করলাম ফোন লালবাজারেঃ করে জানলাম মিছিল শেষ হওয়ার কখন কথা। জানালাম ঋতুপর্ণকে যে কোনও অছিলা শুনব না, আসতেই হবে! উনি এলেন ও। মঞ্চে আসলেন, দু’-একটা কথা বললেন ওঁর ছবির সহ-শিল্পী ও অভিনেতা যীশু সেনগুপ্তের সঙ্গে দাঁড়িয়ে। বলতে-বলতে হঠাৎ কেঁদে ফেললেন। সামলেও নিয়েছিলেন। পরে একান্তে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, হঠাৎ কি হয়েছিল তোমার? বলেছিলেন, মনে আছে, যে অতগুলো মানুষের ওর দিকে অমন আর্তভাবে তাকিয়ে দেখা তা দেখে, বিশেষ করে যে প্রেক্ষাপটে এই চলচ্চিত্র উৎসব ডায়লগস… ওঁর খুব অভিভূত লেগেছিল। একমাত্র এলজিবিটি চলচ্চিত্র উৎসব যার মঞ্চে উনি এসেছিলেন, সেখানকার অভিজ্ঞতা নিয়ে ঋতুপর্ণর সেদিনকার অভিব্যক্তি আমি কোনওদিন ভুলব না।

৪. ‘প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট’-এর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল দেশের প্রথম রূপান্তরকামী দুর্গাপুজো। ডায়ালগস তারও অনেক আগে আক্ষরিক অর্থেই একটা মাইলফলক। প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে করা যে কোনও প্রথম কাজকে কেন্দ্র করে আপনার সামাজিক তথা রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে কী বলবেন?

আসলে যখন কোনও কাজ করি, বেশিরভাগ সময়েই কিন্তু অত সাত-পাঁচ ভেবে করি না। একটা আবেগ, কখনও কোনও অভিজ্ঞতা… অনেক জিনিস করার তাগিদ তৈরি করে। ভাবনাগুলো গুছিয়ে নিই হয়তো অনেক পরে। ২০১৫-এ রূপান্তরকামী মানুষদের দ্বারা আয়োজিত সর্বজনীন দুর্গাপুজোর ক্ষেত্রেও সেইরকম এক সামাজিক বাধা যা কি না বৈষম্যের বহিঃপ্রকাশ, সেটাই ছিল তা নেওয়ার জন্যে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ। দেখতে ভাল লাগে যে সেটা কত ধরনের কথোপকথনের জন্ম দিয়েছিল, কত মানুষের জন্য একটা সামাজিক স্বীকৃতির দাবি তোলার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। আজ যখন দেখি কোনও এক রূপান্তরকামী গোষ্ঠী তাঁদের বাড়ির পুজোর জন্যও প্রশাসনিক সাহায্য পান, তখন মনে পড়ে যায় যে আমরা কী রকম বৈরি এক পরিস্থিতিতে কাজটা শুরু করেছিলাম… কোনও ধরনের সহযোগিতা ছাড়াই অনেকগুলো ঝুঁকি নিয়ে। তাই আমার রাজনৈতিক, থুড়ি সামাজিক অবস্থানটা যদি বলেন, সেটা হল যে আমি কোনও ধরণের জাতীয়তাবাদী মতবাদে বিশ্বাস করি না (হয়তো নিজের ভাষাটার ক্ষেত্রে একটা অস্মিতা কাজ করে এবং সেটা একমাত্র জিনিস যেখানে আমার এই নিয়মের একপ্রকার ব্যতিক্রম ঘটে এবং সেটা স্বোচ্ছায়)। সেটা লিঙ্গ চেতনার পরিসরেও করি না—মর্যাদা ও অভিন্ন অধিকার এই দুইয়ের প্রতি বিশ্বাসের থেকে কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা করি।

LGBTQI Film Festival

৫. এই ধরনের ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল মূলত শহরকেন্দ্রিক, এলিটদের জন্য—প্রায়শই এই অভিযোগ ওঠে। এ প্রসঙ্গে কী বলবেন?

এই প্রসঙ্গে আগেও বলেছি আমরা কোন ধরনের ছবি দেখিয়ে এসেছি। বাইরে থেকে দেখলে এরকম অনেক কিছু মনে হতে পারে। এলিটিজ়ম-এর অভিযোগটা কেউ আনতে পারেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজটা হয়তো এক সময়ে একটা সীমিত পরিসরে চালু ছিল। বিপুল পরিমাণে অর্থ কিংবা দক্ষতা ইত্যাদি প্রয়োজন হত। আজ কিন্তু সেই জিনিসটা আমুল পরিবর্তিত একটা পরিসর। ছবির নির্মাণ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সেটার প্রদর্শনের মাধ্যম কুক্ষিগত করে রাখার পরিকাঠামোর বাইরে নিয়ে যাওয়ার অনেকগুলো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। নানা ধরণের ছবি হচ্ছে, তার বিপণন হচ্ছে—বাজার অর্থনীতির সঙ্গে এই মাধ্যম তা নানা ভাবে লড়ে এক-একটা জায়গা তৈর করে নিচ্ছে। আমি বহুবছর ধরে রূপান্তরকামী গোষ্ঠীর মধ্যে সিনেমা এবং ডকুমেন্টারি ছবি দেখিয়ে এসেছি। আমরা অনেক সময় এইরকম গোষ্ঠীর ভিতর থেকে উঠে আসা ফিল্মমেকারদের সঙ্গে কাজ করেছি—সেটা প্রযোজনা কিংবা গবেষণা বা অন্য ক্ষেত্র ধরেও। বর্তমানে আমরা শহরে একটা প্রচেষ্টা চালাই—সেটা রূপান্তরকামী গোষ্ঠী দ্বারা চালিত একটা সিনে সোসাইটি। সেখানে আমরা কেবল এলজিবিটিকিউ বলে দাগিয়ে দেওয়া কনটেন্ট দেখি না, বরং যাকে আমরা ওয়ার্ল্ড সিনেমা বলি, ভারতীয় প্যারালাল সিনেমা বলি, সেগুলো নিয়মিত স্ক্রিন করেছি লকডাউনের আগে অবধি। আমরা শুরুই করি এমএসসাথ্যুর ‘গরম হাওয়া’ ছবিটা দিয়ে। কোথাও তো লেখা নেই যে রূপান্তরকামী বা প্রান্ত লিঙ্গচেতনার পরিসরের মানুষরা কেবল তাঁদের গোষ্ঠী নিয়ে নির্মিত ছবিই দেখতে পারেন কিংবা দেখতে পছন্দ করবেন!

কোয়েল ঘোষ, ম্যানেজিং ট্রাস্টি, সাফো ফর ইকুয়ালিটি

১. ডায়ালগস ২০২১, ১৫তম ক্যালকাটা ইন্টারন্যাশনাল এলজিবিটিকিউআইএ+ ফিল্ম অ্যান্ড ভিডিও ফেস্টিভ্যাল—এ ব্য়াপারে ‘সাফো ফর ইকুয়ালিটি’র তরফে মীনাক্ষী সান্যাল (মালবিকা)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘‘এবারের ডায়ালগস-এর দায়িত্ব মূলত ‘সাফো’র সেকেন্ড জেনারেশনের হাতে।’’ সেই সেকেন্ড জেনারেশনের প্রতিনিধি হিসেবে কোয়েলকে প্রশ্নঃ কতটা নতুন এবারের ডায়ালগস? আর সেই সঙ্গেই দ্বিতীয় প্রশ্নঃ এই নতুনত্বকে কতটা ঋদ্ধ করছে আগের বছরগুলোর অভিজ্ঞতা?

২০০৭ থেকে ২০২১—১৫ বছর হয়ে গেল ডায়ালগস-এর। আমরা ১৫ বছর ধরে কলকাতায় এই ক্য়ুয়ের ফেস্টিভ্যালটা করে চলেছি। গত বছর আর এ বছর ডায়ালগস পুরোপুরিই ভার্চুয়াল। এতে একটা মিক্সড ফিলিং হয়। আসলে ডায়ালগস তো শুধু সিনেমা দেখা নয়, একসঙ্গে অনেকগুলো মানুষের একত্রিত হওয়া, সময় কাটানো। এটা আমাদের কাছে আক্ষরিক অর্থেই একটা ফেস্টিভ্যাল—সিনেমা দেখার অজুহাতে বলা যায়। সিনেমা দেখার সঙ্গে সঙ্গে অনেক ধরনের ইন্টার-পার্সোনাল সম্পর্ক, সুখ-দুঃখের গল্প, আড্ডা, সেজেগুজে আসা… সবকিছু হত—সেই চার্মটা গত বছর খুব মিস করছি। এ বছরও সেটা খুউউউবই মিস করছি এবং করবও। এবং সেই সঙ্গে আগের বছরগুলোর অভিজ্ঞতার নস্ট্য়ালজিয়া আমাদের সকলের মধ্যে কাজ করছে। মনে পড়ছে এই সময়টায় আমরা কী-কী করতাম… কীভাবে ভলান্টিয়ারিং হত… কীভাবে সব দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেওয়া হত… এলজিবিটিকিউআইএ+ সম্প্রদায়ের সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকত যে ডায়ালগস-এ দেখা হবে… কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে বসে সিনেমা দেখা আর বড় স্ক্রিনের সামনে বসে সিনেমা দেখার আনন্দের মধ্যে তো অনেকটাই পার্থক্য… কিন্তু হ্যাঁ, ফেস্টিভ্যালটা না-হওয়ার থেকে ভার্চুয়ালি হওয়াটা নিঃসন্দেহে ভাল এবং এটার ফলে যেটা হয়েছে, তা হল শুধু কলকাতা বা তার পার্শ্ববর্তী এলাকা নয়, গোটা পৃথিবীর মানুষ একসঙ্গে এতগুলো ছবি দেখতে পাবেন—এটা অবশ্যই একটা বড় প্রাপ্তি। ফলে যোগাযোগ যেমন কমেছে, তেমনই বেড়েওছে।

২. দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম প্রাইড ওয়াক অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই কলকাতায়। দেশের প্রথম এলজিবিটিকিউআইএ+ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালও প্রথম প্রদর্শিত হয় এই শহরেই। সংস্কৃতির শহর কলকাতায় কতটা তাৎপর্যপূর্ণ ডায়ালগস?

কলকাতার পরিপ্রেক্ষিতে ডায়ালগস ভীষণভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বছরের শেষে আমরা দু’টো জিনিস দেখিঃ কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল আর ডায়ালগস। আমরা এরকমও দিন কাটিয়েছি, যেখানে কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এর বাইরে গিয়েও আমরা ডায়ালগস-এর পোস্টার সেঁটেছি, যাতে অনেক মানুষ এসে এই ফেস্টিভ্যালটাও দেখেন এবং উপভোগ করেন। শুধু যে এলজিবিটিকিউআইএ+ সম্প্রদায়ের মানুষ এসেই এই ফেস্টিভ্যাল দেখতেন তা কিন্তু নয়, চলচ্চিত্রপ্রেমী থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র সমালোচক—সকলেই আসতেন এবং আসেনও। প্রথমে ম্যাক্সম্য়ুলার ভবনে হত ডায়ালগস। পরে ‘বসুশ্রী’তে। এবং ছবি দেখার পাশাপাশি আমাদের জীবন নিয়ে, জীবিকা নিয়ে, বাঁচার রকম এবং ধরন নিয়ে একটা কমিউনিকেশনের পরিসর তৈরি হয়েছিল। সেটা হয়তো একমাত্র কলকাতা বলেই সম্ভব হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আমার মনে হয় কলকাতার সংস্কৃতিতে আগামিদিনে ডায়ালগস-এর প্রভাব রয়ে যাবে ভীষণভাবে।

LGBTQI Film Festival Kolkata

৩. ডায়ালগস—অর্থাৎ কথোপকথন। প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের মেইনস্ট্রিমিং-এর ক্ষেত্রে কথোপকথন কতটা জরুরি?

হ্যাঁ, ডায়ালগস অর্থাৎ কথোপকথন। এই কথোপকথন, এই যোগাযোগের, আমাদের জীবনযাপনের, আমাদের প্রত্যেক দিনের ভাললাগা, খারাপ লাগা, ভালবাসা, বন্ধুত্ব… আমরা যেভাবে আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রতি মুহূর্তে লড়াই করে চলি… এবং সেগুলো এই ধরনের ছবিগুলোর মাধ্যমে বহু মানুষের সামনে আসে… এবারে যে ছবিগুলো দেখানো হবে, তার অনেকগুলো ভারতীয় পরিচালকদের তৈরি। এবং ইনসেনসিটিভ মেইনস্ট্রিম ছবির ভিড়ে এই যে সেনসিটিভ ছবিগুলো মানুষ দেখছে, এটা কোথাও গিয়ে আমার ভীষণভাবে মনে হয় এই কথোপকথনের ফলেই সম্ভব হচ্ছে। কারণ এই ধরনের কথোপকথন—সিনেমার মাধ্যমে হোক অথবা গণমাধ্যমের সৌজন্যে হোক—নিয়মিত হয়ে চলাটা খুবই জরুরি।

৪. প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে ‘মিলেনিয়াল’দের সেনসিটাইজ় বা আরও বেশি মাত্রায় সংবেদনশীল করে তোলার ক্ষেত্রে এই ধরনের উদ্যোগের ভূমিকা কতটা?

হ্যাঁ, প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের সামাজিক অবস্থানকে কেন্দ্র করে একটা স্টিগমা, তকমা দেওয়ার প্রবণতা, হাসি, খিল্লি সবসময়ই থাকে। আমার মনে হয় সেই জায়গা থেকে যখন আমরা সিনেমার মাধ্যমে আমাদের জীবনগুলো, আমাদের জীবনের ধরনগুলো, অধিকারগুলো, প্রাপ্যগুলো নিয়ে যখন মানুষ সিনেমা দেখে, তখন মনে হয় তাঁদের মধ্যে এক ধরনের সংবেদনশীলতা তৈরি হয়, এক ধরনের এমপ্যাথি তৈরি হয়… স্টিগমা সরে গিয়ে ইনক্লুশনের এবং অ্য়াকসেপ্ট্য়ান্স, এক ধরনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের স্বপ্ন—যা আমরা দেখি—এই ধরনের সিনেমাগুলো দেখানোর মধ্যে সেটা সম্ভব হতে পারে এবং হবে, এটাই আমরা বিশ্বাস রাখি। এই বিশ্বাস নিয়েই আমরা গত ১৫ বছর ধরে ফেস্টিভ্যালটার সঙ্গে যুক্ত আছি। আসলে সংবেদনশীলতা তৈরি হওয়া তো একটা সময়সাপেক্ষ ব্য়াপার… তাই-ই আমার মনে হয় ধারাবাহিকভাবে সেটা তৈরি করার ক্ষেত্রে ডায়ালগস একটা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।

স্পষ্ট মনে আছে যখন আমার ২০ বছর বয়স, তখন আমার আইডেন্টিটি নিয়ে ভীষণ একটা দ্বন্দ্বে থাকতাম, ভীষণ কনফিউশন, লজ্জা, পাপবোধ… সবই অনুভব করতাম। তখন আমি প্রথম ডায়ালগস-এ গিয়েছিলাম। একটা ছবি দেখিঃ ‘ইফ দ্য় ওয়ালস কুড টক’। আমার মনে আছে সিনেমাটা শেষ হওয়ার পর আমি হলে বসেই ভীষণ কেঁদেছিলাম। আমার মতো আরও অনেকে ওই ছবিটা দেখতে-দেখতে ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলেন—স্পষ্ট মনে আছে। এবং সত্য়ি কথা বলতে কী সেদিন একটা ‘সেন্স অফ টুগেদারনেস’ কাজ করেছিল—মনে হয়েছিল আমিও একা নই। যাঁরা এই জীবনটা বাঁচে এবং বেছে নেয়, সেই জায়গা থেকে একটা সাহস সঞ্চার হয়েছিল সেদিন। মিলেনিয়ালদের প্রসঙ্গে এটাই বলার, এই ধরনের ‘কাম আউট’-এর… নিজের শর্তে নিজের জীবনটা বাঁচার ক্ষেত্রে সিনেমাও কোথাও গিয়ে ভীষণভাবে প্রভাব ফেলে।

LGBTQI Film Festival 2021 Kolkata

৫. এই ধরনের ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল মূলত শহরকেন্দ্রিক, এলিটদের জন্য—প্রায়শই এই অভিযোগ ওঠে। এ প্রসঙ্গে কী বলবেন?

হ্যাঁ, এই ধরনের ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল শহরকেন্দ্রিক—এই জাতীয় অভিযোগ ওঠে এবং আমার মনে হয় এই ধরনের অভিযোগ অনেকাংশে যুক্তিযুক্তও। আমরা ভেবেছি আগামিদিনে যদি এই ফেস্টিভ্যালটাকে মোবাইল (ভ্রাম্যমাণ) করে তোলা যায়। শুধু তাই-ই নয়, এই প্যানডেমিক শেষ হলে ফেস্টিভ্যালটাকে গ্রামাঞ্চলেও নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে, যাতে অন্তত ভারতীয় পরিচালকদের তৈরি ছবিগুলো—মানে যে ভাষাগুলো আমাদের জানা—শহরের বাইরের অডিয়েন্সের কাছে নিয়ে যাওয়া যায়। এটা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই যে ফেস্টিভ্যালকে শহরের বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের ভাবনাচিন্তা চলতে থাকে ধারাবাহিকভাবে, মানে আমরা প্রসেসটার মধ্যে ভীষণভাবে রয়েছি। তবে এখন যেহেতু ক্যুয়ের ফিল্মমেকারদের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেশি, তাই-ই সেটা অবশ্যই একটা প্লাস পয়েন্ট।

অলঙ্করণঃ অভীক দেবনাথ

(ছবিঃ dialoguesfilmfest.in-এর ইনস্টাগ্রামের সৌজন্যে)