মাই নেম ইজ জান: বাংলা নাটকের এক নতুন মোড়

Bengali Theatre: এই নাটকের অনেক কিছুই হয়তো ভুলে যাব, অভিনয় ভুলে যাব, মুহুর্ত ভুলে যাব, তবে যেটা ভুলব বা, সেটা হল অর্পিতার গান, আসাধারণ

মাই নেম ইজ জান: বাংলা নাটকের এক নতুন মোড়
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Oct 01, 2021 | 9:39 AM

‘মাই নেম ইজ জান’ নাটকটি সম্প্রতি বিড়লা সভাঘরে মঞ্চস্থ হল। TV9 বাংলা ডিজিটালের এডিটর অমৃতাংশু ভট্টাচার্য এবং কনসালট্যান্ট একজিকিউটিভ এডিটর রাহুল পুরকায়স্থ প্রথম শো দেখতে গিয়েছিলেন। আর সেই নাটক নিয়েই এই কথাবার্তা।

অমৃতাংশু: এই কোভিড কালে অনেকদিন পর এমন একটা থিয়েটার এল বাজারে, তা শৈলী, শিল্প এবং গঠনে চমৎকার।

রাহুল: লকডাউনের আগে ও পরে কয়েকটা থিয়েটার এসেছিল বটে, ম্যানিফেস্টোর মতো হাউজফুল নাটকও এসেছিল। তবে ২টো শো-এর পরেই বন্ধ করে দিতে হল। তবে ‘মাই নেম ইজ জান’ সম্পূর্ণ অন্য আদলে তৈরি থিয়েটার। প্রথমে ছিল শ্যমবাজারের থিয়েটার। তারপর হল বুদ্ধিজীবিদের থিয়েটার। সেক্ষেত্রে যাঁরা তথাকথিত বুদ্ধিজীবি নন, তাঁরা বঞ্চনার শিকার হলেন। ফলে এইসব সবার বোধগম্য না হওয়ায় এক গোষ্ঠীর মানুষ আর থিয়েটার দেখতে গেল না। বানিজ্য কমে যাওয়ায় কিছু থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেল একেবারেই।

অমৃতাংশু: সেই দিক থেকে ‘মাই নেম ইজ জান’ একেবারেই সফল। একদিকে কর্পোরেট টাচ, অন্যদিকে অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়ের অপূর্ব অভিনয়, এক মুহূর্ত চোখ ফেরাতে পারবেন না দর্শক। অর্পিতার ৩টে জিনিস নজর কেড়েছে। একই সঙ্গে একই আঙ্গিকে অভিনয়, গান, নাচ।

রাহুল: অর্পিতা হল এখানে সব মিলিয়ে একটা প্যাকেজ। বরুণ দাসের এখানে একটা বড় ভূমিকা আছে। যিনি গল্পটি নির্মাণ করেছেন, গান, রেওয়াজ, অভিনয় সব মিলিয়ে অর্পিতা নিজেকে অদ্ভুত ভাবে মঞ্চে আনলেন ২০২১-এ। এর আগে নটির পুজো দেখেছিলাম। খারাপ লাগেনি। তবে এটা সম্পূর্ণ আলাদা মিউজিক্যাল সোলো, সুশৃঙ্খল প্রযোজনা, সংগীত, নৃত্য, অভিনয় সব মিলিয়ে অভিনেত্রীকে যে নতুন রূপে পেলেন, বাংলার মানুষ তা মনে রাখবেন।

অমৃতাংশু: কাননদেবী, গীতা দত্ত, মধুবালা, এনারা প্রত্যেকেই কিন্তু খুব সুন্দর গান গাইতেন। তাঁদের গায়কির সঙ্গে অভিনয়টা একেবারে জুড়ে গিয়েছিল। এই টাচ বা ঘরানাটা কিন্তু অর্পিতার মধ্যে দেখা গেছে।

রাহুল: যেহেতু বিষয়টা গহর জান, সেখানে রয়েছে ফাঁকি দিয়ে প্রাণের পাখি, উড়ে গিয়ে, আর এল না.. বিষয়টা রয়ে গেছে। অর্পিতার গলায় রবীন্দ্রসংগীত, অর্পিতার অভিনয় অনবদ্য, ওর মধ্যে আমি গহর জানকে খুঁজে পেয়েছি। অর্পিতার মধ্যে ২০২১-এ বসে সেই গহর জানের চলাবলা, সেই আদব কায়দা, সেটাও ছুঁয়ে যাচ্ছিল একেবারে। বাংলার নাটকের যে অভিনেতা-অভিনেত্রী, তাঁদের কারুর সঙ্গে কারুর তুলনা হয় না। এক একজন এক একজনের মতো। তবে এক বিশেষ ধরণের অভিনেত্রী অর্পিতা, সে যে এত সুন্দর করে মন কেড়ে নিতে পারবে, ভাবতে পারিনি। এই না ভাবতে পারাটা হয়তো আমার বা আমাদের অদূরদর্শীতা।

অমৃতাংশু: এটা কিন্তু প্রবল কষ্টদায়ক, টানা দুঘণ্টা অভিনয়। কন্ঠকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে দাপানো, অভিনয়, নাচ এবং আট-ন’খানা গান গাওয়া এটা একটা অন্য শক্তি থাকতে হয়।

রাহুল: গহর জান চরিত্রটা ২০২১-এ এসে কিন্তু একটা অন্যধরনের শিক্ষা দেয়। women empowerment, এই যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এত প্রতিকূলতা কাটিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন গহর জান, তার সেই গান, অদ্ভুত সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছে অর্পিতা।

অমৃতাংশু: গহর জানের জীবনকাহিনীর মধ্যে একটা লড়াই আছে, জয় আছে, জয় পেতে পেতে অহমিকা তৈরি হওয়া আছে। আবার সেই অহমিকাটা ভেঙে যাওয়া আছে। তাতিঁয়ায় গিয়ে তাঁকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল কেবল তিনি হেলাফেলা করেছিলেন বলে,তারপর তার শিক্ষা হওয়া, অনুভূতি হওয়া, আবার ক্ষমা চেয়ে মঞ্চে ফিরতে আসা। এই নাটকেও বারবার বলা হয়েছে, ‘তানপুরাটাই তাঁর একমাত্র আশ্রয়’। মাঝেমধ্যেই কিন্তু তিনি সেই তানপুরা থেকে বিচ্চুত হয়েছেন। সেখানেও কিন্তু তাঁর তানপুরা কেন্দ্রিক অহমিকাটা কাজ করেছে।

রাহুল: এটাকে আমি নাটক বলব না storytelling বলব জানি না। creative producer হিসেবে বরুণ দাস ছিলেন এখানে, সেখানে বিষয়টা তো এক অন্য ধারা হবেই। এই story telling, গল্প বলে লোকজনকে ২ ঘণ্টা ধরে রাখা.. সেই গল্পগুলোতে অভিনয় আছে, গান আছে। তবে এই অভিনয় ভীষণ চাপা, আর তিনি গহর জানকে ফুটিয়ে তুলছেন তার লাস্য, বিষাদ সবকিছুর মধ্যে দিয়ে। এই নাটকের যে প্রযোজনা, অবন্তি চক্রবর্তির নির্দেশনা, তার মধ্যে একটা মুন্সিয়ানা আছে। অবন্তির নাটক আমি আগে দেখেছি, তবে ‘মাই নেম ইজ জান’ সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। সেই সময়ে এমন এক মহিলাকে ধরা, যিনি সারাজীবন দাপটের সঙ্গে বেঁচেছেন। যিনি চিরকাল পরাজিত হয়েছেন, রুখে দাঁড়িয়েছেন, প্রতারিত হয়েছেন, ফের রুখে দাঁড়িয়েছেন, এক প্রতিবাদি চরিত্রের নাম গহর জান। আর বলতে হয় জয় সরকারের কথা, বাংলা নাটকেও জয় তার মৌলিকতার ছাপ রয়েছে।

অমৃতাংশু: এখানে প্রেম-প্রেমহীনতা, বিশ্বাস-বিশ্বাসভঙ্গ, এই বৈপরিত্যটা প্রকট হয়ে দেখা গেছে।

রাহুল: এই বৈপরিত্যটা অর্পিতা এখানে খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছে। এর আগে অর্পিতার অভিনয় দেখেছি, নাটক দেখেছি, তবে এত দাপটের সঙ্গে যে অর্পিতা অভিনয়টা করবে, তা না দেখলে আমি বিশ্বাসই করতাম না। দু-তিনটে বিষয় আমার মনে থাকবে, একটা হল স্ক্রিপ্ট, তাঁর গল্প বলার ধরন, তার যে প্রযোজনার ঔজ্জ্বল্য কলকাতায় খুব কম হয়, আর এই ঔজ্জ্বল্য আছে বলেই বোধহয় কর্পোরেট পুঁজি এল। লোটাস মেক-আপ টাইটেল স্পনসর করল। সবদিক থেকে কোভিড পরবর্তী বাংলায় এই নাটকটি এক পথ প্রদর্শক।

অমৃতাংশু: আমার যেটা মনে হয়েছে এই নাটকের যে uniqueness, তা শুধু বাংলা নয়, বিদেশের বাজারেও সাফল্য পাবে। এই যে গহর জান চরিত্রটা, তাঁর বিভিন্ন প্রদেশে যাতায়াত ছিল। সর্বভারতীয় পরিচিতি ছিল তাঁর, একাধিক ভাষা জানতেন তিনি। তুমি যদি তাঁর পিতৃ পরিচয়ের দিক থেকে পিছন দিকে যাও, তাহলে তাঁর একটা আন্তর্জাতিক পরিচিতি আছে।

রাহুল: একদমই। যতদিন পৃথিবীতে গান থাকবে, ততদিন গহর জান থাকবেন। ফলে গহর জানকে কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না, সঙ্গে সঙ্গে অর্পিতাকেও কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না।

অমৃতাংশু: আমার অর্পিতার উপর সবচেয়ে বেশি যে মুন্সিয়ানা লেগেছে তা হল, গহর জানের জীবনে পর পর প্রেম এসেছে। তিনি প্রেমের টানে বেনারস গেলেন, তারপরেই সেখান থেকে প্রত্যাখ্যান হন তিনি। ফের নিমাইবাবুর কাছে গেলেন, তার কাছ থেকে ধাক্কা খেলেন। প্রত্যেকবার প্রেমের টানে যাওয়া, ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসে তানপুরাকে আপন করে নেওয়া, গল্প গুলো হয়তো একদম এক। কিন্তু, তাঁর অভিব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রগুলো বদলে যাওয়া..

রাহুল: প্রত্যেকের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়া স্বাভাবিকভাবেই এক নয়, তবে মৌলিক। এই নাটকের অনেক কিছুই হয়তো ভুলে যাব, অভিনয় ভুলে যাব, মুহুর্ত ভুলে যাব, তবে যেটা ভুলব বা, সেটা হল অর্পিতার গান, আসাধারণ। ও অভিনয় না করেও যদি শুধু গান করত, তাতেও আমরা নতুন কিছু পেতাম। আর অভিনয় করতে করতে গান গাইতে মুন্সিয়ানার প্রয়োজন হয়। লাইভ ওইভাবে একের পর এক গান গাওয়া, অসাধারণ!

অমৃতাংশু: এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ, এমন এক মহিলার চরিত্র নিয়ে তিনি রিসার্চ করেছেন এবং অভিনয় করেছেন, তিনি একসময় তাঁর গান দিয়ে প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যকে মিলিয়েছিলেন। তাঁর জন্য বিদেশ থেকে এসে এখানে প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড করা হয়েছিল। এই যার গায়কি ছিল, তাঁর চরিত্রটা গান এবং অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল।

রাহুল: আমার মনে হয় এইধরনের নাটক, কাজ, প্রযোজনা আরও একটা নতুন শুরু। এর ভবিষ্যৎ আমি অনেক দূর দেখতে পাচ্ছি। এই ধরনের নাটক যে বাংলায় নেই তা নয়, তবে এত ঔজ্জ্বল্য, এত সুন্দর পরিবেশনা, এত সুন্দর করে গল্প বলা, এই ধারাটা বাংলা নাটককে পুষ্ট করবে বলে আমার বিশ্বাস।

অমৃতাংশু: এবং নিশ্চিতভাবে নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। আমি আর তুমি যে প্রথম শো-টা দেখতে গিয়েছিলাম, এই গল্প সারাজীবন আমাদের আলোচনার রসদ জোগাবে।