AQI
Sign In

By signing in or creating an account, you agree with Associated Broadcasting Company's Terms & Conditions and Privacy Policy.

‘জামাই হাউ আর ইউ?’ রামোজি রাও-এর স্মৃতিতে ডুবলেন ‘জামাই’ শিবপ্রসাদ

Shibaprasad Mukherjee On Ramoji Rao: রামোজি রাওয়ের মৃত্যু ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে পরিচালক-প্রযোজক-অভিনেতা শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে। রামোজির মৃত্যুর একসপ্তাহ পর TV9 বাংলা ডিজিটালের জন্য কলম ধরলেন শিবপ্রসাদ। ঋণীর স্বীকার করলেন। বললেন, "আজ আমি যা হতে পেরেছি, সব এই লোকটার জন্য..."

'জামাই হাউ আর ইউ?' রামোজি রাও-এর স্মৃতিতে ডুবলেন 'জামাই' শিবপ্রসাদ
শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
| Updated on: Jun 15, 2024 | 9:10 PM
Share

(রামোজি রাওকে নিয়ে TV9 বাংলার জন্য কলম ধরলেন শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়…)

নীতীশদা (নীতীশ রায়–রামোজি ফিল্ম সিটি তৈরি হয় তাঁর নির্দেশনাতেই) আর নন্দিতাদি (নন্দিতা রায়–নীতীশের স্ত্রী, ইটিভি বাংলার জন্ম লগ্নের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং পরবর্তীতে চলচ্চিত্র পরিচালক) না থাকলে রামোজি রাও কে কিংবা রামোজি ফিল্ম সিটি কী, জানাই হত না আমার। রামোজি রাও যে বাংলা ছবিটি প্রথম প্রযোজনা করেছিলেন, সেই ছবির নায়ক ছিলাম আমি। ছবির নাম ‘জামাই নম্বর ওয়ান’। নীতীশদাই ছিলেন ছবির পরিচালক। সুতরাং, বুঝতেই পারছেন, রামোজি রাওয়ের নজরে আমি ছিলাম কেবলই এক নায়ক। এক অভিনেতা। এই নায়ক কীভাবে আগামীকালের পরিচালক হয়ে উঠল, তার নেপথ্যে রামোজির কতখানি হাত, সেটাই আজ বলতে ইচ্ছা করছে খুব। যেদিন তিনি মারা গেলেন (রামোজি রাওয়ের মৃত্যু হয়েছে একসপ্তাহ আগে। দিনটা ছিল শনিবার, ৮ জুন, ২০২৪), সেদিনই আমি একটি পোস্ট করেছিলাম ফেসবুকে। তাও যেন মনের মধ্যে থেকে বোঝাটা নামাতে পারছিলাম না। তারপর আপনাদের দফতরের ফোনটা পেলাম। মানুষটাকে নিয়ে লেখার আরও একটা প্ল্যাটফর্ম পেয়ে নিজেকে উজাড় করে দিতে ইচ্ছা করল খুব। শুনুন তবে…

তখন আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনের ছাত্র। লেখাপড়ায় মন্দ ছিলাম না। বাড়ির সকলে আমার থেকে অনেককিছু আশা করে বসেছিলেন। বাবা-মা, প্রত্যেকে চাইতেন ছেলে তাঁদের ইউপিএসসি-ডব্লিউবিএসসি পরীক্ষায় সুযোগ পেয়ে দেশের হাল ধরুক। কিন্তু ছেলের সেই সবের বালাই ছিল না। সে চাইত স্রেফ একটা চাকরি। যে চাকরি করতে-করতেও ছেলেটা সিনেমা তৈরির প্রস্তুতি নিতে পারবে। তখনই হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো নন্দিতাদির অফারটা আসে আমার কাছে। তিনি আমাকে ইটিভিতে চাকরি করার প্রস্তাব দিয়ে বসেন। কী জানি, অদৃষ্টের দৃষ্টি আমার উপর দয়াই করেছিল হয়তো। চাকরি করতে এসে ছবি তৈরির অ-আ-ক-খ শিখে নিলাম এই রামোজি ফিল্ম সিটিতে বসে। রামোজি রাওয়ের অধীনে।

তখন ‘জামাই নম্বর ওয়ান’-এর পর দ্বিতীয় বাংলা ছবি তৈরির পরিকল্পনা চলছে রামোজি ফিল্ম সিটিতে। আমি পরামর্শদাতা হিসেবে মতামত দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, জুভেনাইল ক্রাইম নিয়ে ছবি তৈরি করলে কেমন হয়? আসলে পরিচালনা করার ইচ্ছাটা আমার অনেক পুরনো। তাই কুণ্ঠিত না হয়েই কথাটা বলতে পেরেছিলাম। নন্দিতাদি আমাকে চাকরির অফার দিয়ে বলেছিলেন, “মানুষ ফিল্ম সিটিতে আসে কাজ শিখতে। তুমি একটা চ্যানেলে কাজ শিখবে। মন দিয়ে কাজটা শেখো।” এরকম সুযোগকে কেউ হাতছাড়া করে! আমি লুফে নিলাম অফার। সরকারী চাকরির প্রস্তুতিকে চুলোর দুয়ারে পাঠিয়ে ব্রতী হলাম পরিচালনা শেখার কাজে। কোনও ফিল্ম ইনস্টিটিউটে নয়, আমি পরিচালনা, প্রোডাকশন শিখেছি রামোজি রাওয়ের ফিল্ম সিটিতে। হাতে গরম ফল পেয়েছি। ইটিভি আমার জীবন গড়ে দিয়েছে। তবে ইটিভি ছাড়া অন্য কোথাওই চাকরি করিনি আমি। সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট পেয়েছি রামোজি রাওয়ের থেকেই।

এখনকার মতো তখন অত সুযোগ-টুযোগ ছিল না। ওয়েব সিরিজ়, টেলিফিল্ম কী জিনিস, খায় না মাথায় মাখে, তাই কেউ জানত না। কোনও কিছুরই চল ছিল না। কাজের স্কোপ ছিল না। ফলে অভিজ্ঞতা তৈরি হওয়ার রাস্তা নেই। কিছুই তো জানতাম না আমিও। এই না-জানা আমিটাকে সব ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করতে দিয়েছিলেন রামোজি রাও। আমার পাগলামোকে ইন্ধন জুগিয়েছেন তিনি। ইটিভিতে চাকরি করাকালীন ১৯টি প্রোগ্রামের দায়িত্বে ছিলাম আমি। সবটিই ছিল নন-ফিকশন শো। ‘সাফ কথা’, ‘এবং ঋতুপর্ণ’, ‘জনতা এক্সপ্রেস’, ‘নবীন বনাম প্রবীণ’, ‘শ্রীমতী’, ‘প্রথমা’, ‘বরিশালের বর কলিকাতার কনে’, ‘সবুজের দেশ’, ‘পুজোর স্পেশ্যাল প্রোগ্রাম’… সমস্ত আমি করতে পেরেছি। এই যে কাঞ্চন মল্লিককে নেওয়া হবে ‘জনতা এক্সপ্রেস’-এর অ্যাঙ্কার হিসেবে, এরকম একজন ছকভাঙা অ্যাঙ্কারকে নেওয়া কিংবা ঋতুপর্ণ ঘোষকে দিয়েও যে ‘এবং ঋতুপর্ণ’র মতো শো হোস্ট করা যে আসলে সম্ভব, সেই সুযোগগুলো আমাকে রামোজি রাওই করে দিয়েছিলেন।

এখন আমার নিজের টিম তৈরি হয়েছে। উইন্ডোজ় (নন্দিতা রায় এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের প্রযোজনা সংস্থা) প্রযোজনা সংস্থায় অনেক ছেলেমেয়েই কাজ করে। আজও, এতগুলো বছর পরও আমি রামোজি রাওয়েরই উদাহরণ দিই তাঁদের কাছে। মাটির মানুষ ঠিক কী, রামোজি রাওকে দেখেই উপলব্ধি হয়েছে আমার। আমি যতখানি সান্নিধ্য পেয়েছিলাম, দেখতাম তিনি কী ভীষণ অনাড়ম্বর। পা দুটোকে মাটিতেই ফেলে রাখতেন। তিনি যে দ্য গ্রেট রামোজি রাও, সেই হামবড়াই ভাবই ছিল না একবিন্দু। ফলে সাফল্যের অমন শিখর স্পর্শ করতে পেরেছিলেন মানুষটা। সাদা জামা-প্যান্ট, সাধারণ ঘড়ি এবং জুতো, আর শিশুর মতো একটা সরল হাসি মুখে লেপে রাখতেন সবসময়। আমি সেই রামোজিকে আজ বড্ড মিস করছি। চোখ বন্ধ করলেই ওনার মুখটা ভেসে উঠছে। আরও অনেককিছু আমি শিখেছি মানুষটার থেকে। নিজের টিমকে তাঁর উদাহরণ দিই। বলি, বাজেটের মধ্যে থেকেও কাজ করা সম্ভব। নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখা প্রয়োজন। এগুলো সবই রামোজি রাওয়ের ভাইস (wise)।

কেবল রামোজি নন, তেলুগু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিও কিন্তু এই গুণাবলীর জন্যই এখন এত বড় জায়গায় গিয়েছে। এদের ডিসিপ্লিন অসামান্য়। ৯টায় কল টাইম থাকলে ইটিভি নেটওয়ার্কের সকলে ৮টায় পৌঁছে যেতেছেন। রামোজি ফিল্ম সিটিতে আমি কোনওদিনও কাউকে দেরি করে আসতে দেখিনি। এখন আমি অন্যান্য চ্যানেলের ক্ষেত্রে দেখি, যিনি চ্যানেলের দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁকেই ফোনে পাওয়া যায় না। ওখানে আমি পিকে মানভি স্যারকে দেখেছি, ১১টা চ্যানেলের দায়িত্বে থাকা লোকটা একটা রিংয়েই ফোন তুলছেন সকলের। এই মানভি স্যারের পোশাক-আশাক দেখলে আপনার মনেই হবে না তিনি ১১টা চ্যানেলের দায়িত্ব সামলান। কিংবা ধরুন বাপি নিডু (রামোজি রাওয়ের সবচেয়ে কাছের সহকারী) স্যার। তাঁকে দেখলেও বোঝা যাবে না তাঁর স্টেটাস। রামোজি ফিল্ম সিটির লোকজনের মূল উপজীব্যই ছিল বাহ্যিকতা নয়, কাজের জায়গাতেই যা করার করুন। প্রয়োজনের বাইরে খরচ করা, বাজেটের বাইরে ব্যয়, এগুলো ওরা জানেন না। এ ছাড়াও, আমি দেখতাম ইটিভি প্রথমদিকে অ্যাড নিত না। সবাই হাসাহাসি করত। সবার মনে একটাই প্রশ্ন ছিল–এই চ্যানেলটা চলবে কী করে? রামোজি রাও বলেছিলেন, “আমি একবছর কোনও বিজ্ঞাপন চালাব না। আগে চ্যানেলকে একনম্বর জায়গায় আসতে দাও।”

আমার আজও মনে আছে, চ্যানেল এক নম্বর হল, যে কার্ড রেট রামোজি রাও স্থির করেছিলেন, সেই কার্ড রেটই সকলে দিয়েছিলেন। মানুষটার জেদকে আমি কুর্নিশ জানাই। বাংলা টেলিভিশন এবং বাংলা মিডিয়া জগতের যা-যা কাজ হয়েছে, সবই রামোজি ফিল্ম সিটিতে বসে ইটিভি নেটওয়ার্কে প্রথমবার হয়েছে। প্রথম গেম শো, প্রথম ডান্স রিয়্যালিটি শো, সেলিব্রিটি ডান্স রিয়্যালিটি শো, ‘সা থেকে সা’-র মতো গানের রিয়্যালিটি শো-ও তাঁরাই প্রথম করেছেন। শুভমিতা প্রথম চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। প্রথম অ্যালবাম বের হয় তাঁর। বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ৯০ শতাংশ মানুষ-কলাকুশলী, আজ যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা কোনও না-কোনওভাবে রামোজি রাওয়ের কাছে ঋণী। আজও লোকে ইটিভি বাংলার কথাই কিন্তু মনে করেন। আজ ইটিভিতে সম্প্রচারিত টেলিফিল্ম থেকেই কিন্তু সমস্ত শিল্পীরা তৈরি হয়েছেন। তাঁরাই আজ বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্টিতে রাজত্ব করছেন। আমরা আজ যাঁরা মিডিয়ায় কাজ করছি, আমরা সকলেই ইটিভিরই প্রোডাক্ট। মনে হয়, একটা ইনস্টিটিউট ছিল, যেখান থেকে আমরা পাশ করে বেরিয়েছিলাম। আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব রামোজি রাওয়ের কাছে। রামোজি রাও আমাকে মজা করে হয় শিবো বলে ডাকতেন, না হয় ডাকতেন জামাই বলে…! আমার দিকে তাকিয়ে বলতেন, “জামাই হাউ আর ইউ…।” ওই যে ‘জামাই নম্বর ওয়ান’ ছবিতে হিরো ছিলাম। সেটা তিনি কিছুতেই ভুলতে পারতেন না।

অনুলিখন : স্নেহা সেনগুপ্ত