TV9 Bangla Special: যৌনতা আর যৌনক্রিয়া এক নয়, যৌনশিক্ষা না পেলে স্কুলে এমনই সদ্যোজাতর দেহ মিলবে, মত বিশেষজ্ঞদের
Adult Education: যৌনতা নিয়ে সচেতনতার পাঠ দিতে পাঠক্রম প্রণয়নকারীদের একাংশের নাক উঁচু মনোভাব রয়েছে।
অংশুমান গোস্বামী
প্রত্যন্ত গ্রামে মেয়েদের স্কুল। অন্য দিনের মতোই ক্লাস চলছে। এক ছাত্রী বাথরুমে গিয়ে দেখলেন সেখানে পড়ে রয়েছে সদ্যোজাতর দেহ। সঙ্গে সঙ্গে তিনি খবর দিলেন স্কুলের শিক্ষকদের। এর কয়েক দিন আগেই এ রকম ভাবেই স্কুল চত্বরের ঝোপে সদ্যোজাতের দেহ মিলেছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে খবর পেয়ে আসে পুলিশ। তার পর তদন্তে উঠে আসে স্কুলেরই নাবালিকা ছাত্রীরা জন্ম দিয়েছে সদ্যোজাতদের। একটি ক্ষেত্রে তো নাবালিকা পেন দিয়ে খুঁচিয়ে আম্বিলাকাল কর্ড (যার মাধ্যমে মায়ের শরীরের সঙ্গে যুক্ত থাকে শিশুর শরীর) কেটেছে। তামিলনাড়ুর গ্রামাঞ্চলের দুটি স্কুলে এ রকম ঘটনা ঘটেছে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে। দুটি ক্ষেত্রেই অন্তঃসত্ত্বার বিষয়টি পরিবারের লোকেদের থেকে গোপন করেছিলেন নাবালিকারা। কিন্তু কী করে গোটা অন্তঃসত্ত্বাকাল পরিবারের লোক, স্কুলশিক্ষকদের নজর এড়িয়ে গেল। সেই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। কিন্তু এই ঘটনাগুলি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সমাজে যৌনসচেতনতার অভাব। লুকোছাপা করতে গিয়ে নিজেদের জীবনকেও বিপন্ন করে তুলেছিল ওই দুই নাবালিকা। সমাজের ‘কলঙ্কের’ ভয়েই যে তাঁরা গোটা বিষয়টি লুকিয়ে রেখেছিলেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই দুই ঘটনা ফের তুলেছে ধরেছে মতো বেশ কিছু মূলগত প্রশ্ন।
এই ঘটনা যৌনসচেতনতার অভাবকে প্রকট করছে বলে মত সমাজকর্মী থেকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। বয়ঃসন্ধিকালে সঠিক যৌনশিক্ষার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করাচ্ছে সাম্প্রতিক কালের এই ঘটনাগুলি। এ ব্যাপারে সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ বলেছেন, “তামিলনাড়ুর ঘটনা অবশ্যই শরীর নিয়ে শিক্ষার অভাবকে সামনে এনেছে। কমবয়সি কিশোর কিশোরীদের অধিকাংশেরই যৌনতার পরিণতির ব্যাপারে সম্যক ধারণাও নেই। যা বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের থাকা প্রয়োজন।” জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অমিতাভ সরকার বলেছেন, “এই ঘটনাগুলি দেখিয়ে দিচ্ছে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা দেউলিয়া। পশ্চিমী ভাবধারায় কেরিয়ার নির্ভর, ইন্ড্রাস্টির উপযোগী সিলেবাস এখন শিক্ষার অঙ্গ।” এই শিক্ষা ব্যবস্থা এক জনকে তথ্যে ঠাসা করে তুলতে পারে, কিন্তু সচেতন মানুষ হতে কতটা সাহায্য করে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অমিতাভের।
অমিতাভ এবং শাশ্বতী দুজনেই মনে করেন স্কুল স্তর থেকে Sex Education বা যৌনশিক্ষার প্রয়োজন। এ ব্যাপারে শাশ্বতী বলেছেন, “যৌনশিক্ষার অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের দেশে ৪০ শতাংশ মেয়েদের ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। তাদের এই শিক্ষাটা থাকা প্রয়োজন। লকডাউনের জেরে তো নাবালিকা বিবাহ আরও বেড়েছে। তাঁদের যদি নিজেদের দেহ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকে, তাহলে তারা ভুল করবেই। তার উপর এখন অধিকাংশ কিশোর কিশোরীর হাতে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সুবিধা এসেছে। ফলে তাদের কাছে তথ্য আসতে বাধা নেই। কিন্তু ভুল তথ্য আসার সম্ভাবনা প্রবল।” শুধু স্কুলের মাধ্যমে নয়, স্কুলছুট কিশোর-কিশোরীদেরও যৌনশিক্ষার পাঠ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ দেওয়া মনে করেন তিনি। এ জন্য অন্বেষা ক্লিনিকের বিষয়টিও তুলে ধরেছেন। কিন্তু তাঁর আক্ষেপ, “অধিকাংশ রাজ্যই এ ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখায়নি।“
ভারতীয় সমাজে যৌনশিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন, কিন্তু তা সরাসরি প্রণয়ন করার বেশ কিছু বাধা রয়েছে বলেও স্বীকার করে নিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অমিতাভ সরকার। তিনি বলেছেন, “বয়ঃসন্ধিতে পৌছনোর পর কিশোর কিশোরীদের মধ্যে যৌন আকর্ষণ হওয়াটা স্বাভাবিক। এ বিষয়ে তাঁদের সচেতন করতে, যৌনতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা গড়ে তুলতে এই শিক্ষার গুরুত্ব রয়েছে।” যৌনশিক্ষা পাঠক্রমে বিষয় হিসাবে করা সম্ভব না হলে, ভিন্ন মাধ্যম অবলম্বন করে শিক্ষা দেওয়ার কথাও উঠে এসেছে। অমিতাভ বলেছেন, “সরাসরি যদি পাঠক্রমে যৌনশিক্ষার অন্তর্ভু্তি না করা গেলে, সাহিত্যের মাধ্যমে ধীরে ধীরে এই সংক্রান্ত বিষয়গুলি আলোচনায় তুলে আনা উচিত। ওয়ার্কশপের মাধ্যমেও বিষয়গুলি নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের অবহিত করা যেতে পারে।” চিত্র সম্বলিত ছোট পুস্তিকার আকারেও বিষয়টি তুলে ধরা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
কিন্তু যৌনতা নিয়ে সচেতনতার পাঠ দিতে পাঠক্রম প্রণয়নকারীদের একাংশের নাক উঁচু মনোভাব রয়েছে। তাঁদের উদ্দেশে অমিতাভ বলেছেন, “যৌনতা এবং যৌনক্রিয়া এক নয়, তা অধিকাংশই বোঝেন না। যৌনশিক্ষা যৌনতা নিয়ে ধারণা দেয়। সচেতন করে। যৌনাঙ্গ বা হরমোন নিয়ে খাপছাড়া পড়ালে চলবে না। যৌনতার সামাজিক এবং শারীরবৃত্তীয় জিনিসটিও বোঝাতে হবে। জনস্বাস্থ্যের বিষয়টির শিক্ষাও ছাত্র-ছাত্রীদের থাকা দরকার।” পাঠক্রম প্রণয়নকারীদের অনাগ্রহ এবং ছুৎমার্গ এই যৌনশিক্ষা প্রদানে অন্যমত বাধা বলে মনে করেন শাশ্বতী। এ ব্যাপারে শাশ্বতী বলেছেন, “এর আগে পশ্চিমবঙ্গে জীবনশৈলি বলে যৌনশিক্ষার পাঠক্রম চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদেরও বিষয়টি নিয়ে অযথা লুকোচুরি, অস্বস্তি দেখা গিয়েছে। যৌনশিক্ষাকে বায়োলজিতে রূপান্তরিত করে দিলে চলবে না। যৌনতার সঙ্গে সম্পর্ক, দায়িত্বের বিষয়টি জানাতে হবে। কিন্তু চলতি সমাজের যারা ধারক বাহক তাঁরা মনে করেন, বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের এ ব্যাপারে জ্ঞান দিলে তারা কম বয়সে পেকে যাবে। নিজেদের শরীর নিয়ে পরীক্ষা শুরু করবে।” তামিলনাড়ুর মতো ঘটনা রুখতে চাইলে কিশোর-কিশোরীদের যৌনসচেতন করে তোলা ছাড়া গতি নেই বলেই মত বিশেষজ্ঞদের। এবং সেই কাজ এক দিনে হওয়া সম্ভব নয়। যৌনতা নিয়ে ছুৎমার্গের সমস্যা সমাজের গভীরে প্রোথিত হয়ে রয়েছে। উপযোগী শিক্ষা ছাড়া তাকে সমূলে উৎপাটন অসম্ভব।