Explained: দীপাবলির পরই আবার শুরু ‘অপারেশন সিঁদুর’?
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী থেকে সেনাপ্রধান, পাকিস্তানের ইতিহাস থেকে ভূগোল বদলে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। বায়ুসেনা প্রধান তো তাঁর বাহিনীকে পরবর্তী অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিতেও নির্দেশ দিয়েছেন। সব দেখেশুনে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তবে কি দীপাবলির পরেই কোনও বড় অ্যাকশন হবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে? এবার কি ভারতের মানচিত্রে ফের জুড়ে যাবে PoK? নাকি দ্রুতই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অপারেশন সিঁদুর ২.০ শুরু হবে?

পাক অধিকৃত কাশ্মীরে (PoK) সরকার-বিরোধী ক্ষোভ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এই বিক্ষোভকে গলা টিপে মারতে শাহবাজ শরিফের সরকার গুলি চালাতেও কসুর করছে না। কিন্তু তাতেও পিছপা হতে রাজি নন আন্দোলনকারীরা। তাঁদের সম্মিলিত দাবি, কাশ্মীরে যেমন উন্নয়ন হচ্ছে, তেমন উন্নয়ন চাই PoK-তেও। জম্মু ও কাশ্মীর জয়েন্ট আওয়ামি অ্যাকশন কমিটি (JKJAAC) গোটা এলাকার রাজনৈতিক পালাবদল, ভর্তুকিযুক্ত খাদ্যপণ্য, কম দামে বিদ্যুৎ, ছেলেমেয়েদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবার দাবিতে লাগাতার দোকানপাট, বাজার, গাড়িঘোড়া-সমস্ত কিছু বন্ধ রেখে আন্দোলন চালাচ্ছে।
এই প্রতিবেদন লিখতে বসার সময় পর্যন্ত সেই সরকার বিরোধী আন্দোলন দশম দিনে পা রেখেছে। ফলে চূড়ান্ত বেকায়দায় ইসলামাবাদ। আর এদিকে, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী থেকে সেনাপ্রধান, পাকিস্তানের ইতিহাস থেকে ভূগোল বদলে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। বায়ুসেনা প্রধান তো তাঁর বাহিনীকে পরবর্তী অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিতেও নির্দেশ দিয়েছেন। সব দেখেশুনে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তবে কি দীপাবলির পরেই কোনও বড় অ্যাকশন হবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে? এবার কি ভারতের মানচিত্রে ফের জুড়ে যাবে PoK? নাকি দ্রুতই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অপারেশন সিঁদুর ২.০ শুরু হবে? সেই সম্ভাবনাও ক্রমশ জোরাল হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশ তো এটাও বলছেন, অক্টোবরেই বড়সড় কিছু ঘটতে পারে, যা পাকিস্তান স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না।
শুরুটা করেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং। গুজরাটের ভুজে দশেরার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে তিনি পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দেন, তাঁর কাছে খবর আছে বিতর্কিত স্যার ক্রিক লাইনের কাছে পাক সেনা পরিকাঠামো তৈরি করছে। পাক সেনা বা সরকার একটাও মিস-অ্যাডভেঞ্চার করলে আস্ত পাকিস্তানের ইতিহাস-ভূগোল বদলে যাবে বলেও চূড়ান্ত সতর্কবার্তা দেন রাজনাথ। ভারতের গুজরাট ও পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের মধ্যে ৯৬ কিলোমিটার লম্বা স্যার ক্রিক লাইন ব্রিটিশ আমল থেকেই বিতর্কিত সীমান্ত। ওই বিতর্কিত এলাকায় পাক সেনা পরিকাঠামো তৈরি করলে ভারতের সেনা প্রস্তুত রয়েছে বলেই ইসলামাবাদকে সতর্ক করে দেন রাজনাথ। আবার সোমবার এম জে আকবরের একটি বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে গিয়েও বলেন, ভবিষ্যতে পাকিস্তানের কী হবে সেটা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। কয়েকদিন আগে প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরও একধাপ এগিয়ে এটাও বলেছেন, ‘প্রয়োজন পড়লে দেশের মানুষ ও সুরক্ষার জন্য ভারতীয় সেনা যে কোনও সীমানা পেরোতে পারে।’ ২০১৬-র সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, ২০১৯-এর বালাকোট স্ট্রাইকের কথা মনে করিয়ে কি রাজনাথ পরোক্ষে ইসলামাবাদকে এটাই জানিয়ে দিলেন, যে পরেরবার প্রয়োজন পড়লে ভারতের সশস্ত্র সেনা LoC পেরোবে?

একা রাজনাথ নন, তাঁর সুরেই সুর মিলিয়েছেন ভারতের বায়ুসেনা প্রধানও।
গত মাসে পাক প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রসংঘের মঞ্চে গিয়ে বলে এসেছেন, পাক সেনা নাকি ৭টা ভারতের যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছে! যদিও তার কোনও ছবি বা প্রমাণ দেখতে পারেননি! পাকিস্তানের সেই সব ভাঁওতাবাজির ফানুস ফাটিয়ে দিয়েছেন ভারতের বায়ুসেনা প্রধান। শাহবাজ শরিফের ‘মনগড়া কাহিনী’-র তাসের ঘর ভেঙে দিয়েছেন। এয়ার চিফ মার্শাল অমরপ্রীত সিং এমনিতে কম কথার মানুষ। কিন্তু ৯৩-তম এয়ার ফোর্স ডে সেলিব্রেশনে যোগ দিয়ে তিনিই বললেন, ‘ভারতের প্রত্যাঘাতে পাকিস্তানের অন্তত চার জায়গার রেডার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্তত দুই জায়গায় কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টারে আঘাত করেছে বায়ুসেনা।’ শুধু কি তাই? ‘দুটি রানওয়ে ও তিনটি আলাদা আলাদা জায়গায় হ্যাঙ্গারেও নির্ভুল নিশানায় আঘাত করেছে ভারতের বায়ুসেনা।’ ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যানও দিয়েছেন এয়ার চিফ মার্শাল। একটি সি-১৩০ ক্লাসের এয়ারক্রাফট, অন্তত চার থেকে পাঁচটি এফ-১৬ ও জে-এফ ১৭-এর মতো যুদ্ধবিমান, একটি SAM সিস্টেম– পাক সীমান্তের ৩০০ কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে ভারতের মিসাইল গুঁড়িয়ে দিয়ে এসেছে। ইসলামাবাদ যে ভারতের যুদ্ধবিমান গুলি করে নামানোর দাবি করেছিল, এপি সিং সেই দাবিও উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, “এগুলো সব মনগড়া গল্প। ওরা (পাকিস্তান) মনে মনে ভাবতেই পারে আমাদের ১৫টা যুদ্ধবিমান ওরা ধ্বংস করে দিয়েছে। সেই ভেবে যদি ওরা পরেরবার আমাদের ১৫টা যুদ্ধবিমান কম আছে বলে আসে, আসুক!” ভারতের এয়ার চিফ মার্শাল-ও একবার নয়, এই দাবি একাধিকবার করেছেন। গত মাসেই তিনি জানিয়েছিলেন, ভারতের এস-৪০০ ডিফেন্স সিস্টেম কমপক্ষে পাঁচটি পাক যুদ্ধবিমান মাঝআকাশেই ভেঙে দিয়েছে।
নজিরবিহীনভাবে এরপরেই মুখ খোলেন খোদ দেশের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী। তিনি আরও একধাপ এগিয়ে বলেন, ‘ভারত এখন যেরকম প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে, তাতে পরেরবার আর ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মতো সংযম দেখাবে না সশস্ত্র বাহিনী।’ তবে কি সেনাপ্রধানের ইঙ্গিত, পরেরবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জবাব আরও কঠোর ও তীব্র হবে? অপারেশন সিঁদুর-এ নিশানায় ছিল শুধুই পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা। দেশের সেনাপ্রধান এও বলেছেন, ‘এখনই জঙ্গিদের মদত দেওয়া বন্ধ না করলে পরেরবার পাকিস্তান বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে যাবে।’ যোগ করেছেন, ‘অপারেশন সিঁদুর ১.০-তে ভারত যে সংযম দেখিয়েছে, পরেরবার আর তেমন দেখানো হবে না।’
VIDEO | Anupgarh, Rajasthan: Indian Army Chief General Upendra Dwivedi says, “This time we will not maintain the restraint that we did in Operation Sindoor 1.0… this time we will do something that Pakistan will have to think whether it wants to be in Geography or not. If… pic.twitter.com/YXoHUL7xKv
— Press Trust of India (@PTI_News) October 3, 2025
সেনাপ্রধানের এই বক্তব্যে অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্তা কেজিএস ধিলনের মতো ব্যক্তিত্বরাও অবাক। এর আগে ভারতের কোনও সেনাপ্রধানকে পাকিস্তান নিয়ে এতটা আগ্রাসী মন্তব্য করতে দেখেননি তিনি, নিজের এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন ধিলন। জেনারেল দ্বিবেদী একথা বলেছেন কোথায় গিয়ে? রাজস্থানে সেনার এক অনুষ্ঠানে গিয়ে। আর কী বললেন? সেনাকে বললেন, ‘তৈরি থাকুন। ‘ঈশ্বর চাইলেই দ্রুত আপনারা সুযোগ পাবেন মনোবাঞ্ছা পূরণের।’ একজন সেনাকর্তা কখন নিজের দেশের সেনাকে এভাবে প্রস্তুত থাকতে বলেন? উত্তরটা সহজ, সামনে কোনও বড় অভিযান থাকলে!

পহেলগাওঁতে পাক জঙ্গিদের গুলিতে ২৬ জন নিরীহ নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দেয়। জবাবে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ অন্তত শ’খানেক পাক শীর্ষ জঙ্গিদের নিকেশ করা হয়। ভেঙে দেওয়া হয় পাক সেনার পরিকাঠামো, গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় বিমানবন্দরের রানওয়ে, হ্যাঙার। পাক সেনা ও জঙ্গিদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়। জঙ্গিদের শেষকৃত্যে যোগ দিতে দেখা যায় পাক প্রশাসনের মুরুব্বিদের। যদিও পাক সেনাকর্তারা এসব নিজেদের মুখে স্বীকার করেন না। বরং, পাকিস্তান সুবিধাজনক জায়গায় থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্পের অনুরোধে সংঘর্ষবিরতিতে রাজি হয়েছে, এই বলে দেশের নাগরিকদের মগজধোলাই করেই চলেছে শাহবাজের সরকার। ভারতের সেনাপ্রধান বিশ্বের মানচিত্র থেকে পাকিস্তানকে মুছে ফেলার হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরই পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফ পাল্টা মন্তব্য করেছেন, ‘ভারত নাকি ভাঙা যুদ্ধবিমানের স্তূপের নিচে চাপা পড়বে।’ কিন্তু আসল কথাটা হল, পাক মন্ত্রী থেকে খেলোয়াড়রা যতই টিভির সামনে দাবি করছেন ভারতের যুদ্ধবিমান ধ্বংসের, ততই সর্বত্র হাস্যস্পদ হচ্ছেন। অনেকে তো মজা করে এও বলছেন, এশিয়া কাপ টিভিতে সরাসরি না দেখানো হলে পাকিস্তান দাবি করত সেটাও তারাই জিতেছে।
এবার কিন্তু PoK-তে সরকার বিরোধী আন্দোলনের জিগির উঠে যাওয়ার পর আর মুখ লুকানোর জায়গা পাচ্ছে না শরিফ প্রশাসন। আন্দোলনে পাক সেনার গুলিতে ১০ জনের মৃত্যুর পর PoK পুনর্দখল নেওয়ার দাবি ভারতেও উঠতে শুরু করে দিয়েছে। সদ্যই আরএসএস প্রধান মোহন ভগবত মধ্যপ্রদেশের সাতনায় এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বলেছেন, ‘PoK ভারতেরই একটা ঘরের মতো। সেই ঘরে জোর করে ঢুকে বসে রয়েছে অনুপ্রবেশকারী। সেই ঘরটিকে আবার ফেরত নেওয়ার সময় এসে গেছে।’ গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গুজরাট সফরে গিয়ে সিন্ধু জলচুক্তি প্রসঙ্গে নেহরুর আমলের সমালোচনা করে বলেন, ‘তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল চাইতেন, ভারতের সেনা যেন PoK দখল না করা পর্যন্ত না থামে। কিন্তু সেই সময় প্যাটেলের দাবি মানা হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশভাগের সময় থেকে কাশ্মীরে হামলা চালাচ্ছে মুজাহিদিন। জঙ্গিদের সাহায্যে ভারতের একটা অংশ পাকিস্তান দখল করে রেখেছে।’ অপারেশন সিঁদুর-এর পর থেকেই সিন্ধু জলচুক্তি রদ-সহ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সবরকম দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক থমকে রয়েছে। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, এরপর আলোচনা যদি করতেই হয় তাহলে পাক অধিকৃত কাশ্মীর নিয়ে করতে হবে। মোদী তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার ৬ মাসের মধ্যে PoK পুনর্দখল নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথও।
