Leptospirosis: নাক-মাড়ি ফেটে রক্ত, লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ! বাংলায় নতুন জ্বরে উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্য দফতর
Leptospirosis: জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জের চেতনবাড়ি গ্রামে ইতিমধ্যেই ১৫ জন ইঁদুর-জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন শিশুও রয়েছে। নাক দিয়ে, মাড়ি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে তাঁদের। কারোর পরিস্থিতি আরও খারাপ। প্রস্রাবেও বেরোচ্ছে রক্ত! ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্য আধিকারিকরা।

কলকাতা: লেপ্টোস্পাইরোসিস! আতঙ্কের নয়া নাম! নামটা একটু খটমট, আর রোগটাও। অনেকেই হয়তো এই রোগ সম্পর্কে খুব একটা অবগত নন। কিন্তু বাংলায় এখন এই আতঙ্ক ভাবাচ্ছে স্বাস্থ্য দফতরকে। জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জের চেতনবাড়ি গ্রামে ইতিমধ্যেই ১৫ জন ইঁদুর-জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন শিশুও রয়েছে। নাক দিয়ে, মাড়ি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে তাঁদের। কারোর পরিস্থিতি আরও খারাপ। প্রস্রাবেও বেরোচ্ছে রক্ত! ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্য আধিকারিকরা।
ইঁদুর জ্বর কী? কীভাবে ছড়ায়?
ইঁদুর-জ্বর বলছি! অবাক হচ্ছেন তো? ভল্লুক জ্বর বলি আমরা হেয়ালি করে, কিন্তু ইঁদুর জ্বর? সেভাবে শুনেছেন কী? হ্যাঁ, এই জ্বর ছড়ায় ইঁদুর থেকেই। তাই চলতি কথায় তা ইঁদুর-জ্বর। বিষয়টা একটু সহজ করে বলি। জলবাহিত একটি ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ থেকেই এই রোগ ছড়ায়। কুকুর, বিড়াল, ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর মল-মূত্র থেকে সংক্রমণ ঘটে। এই সব প্রাণীরা মাটিতেই তাদের বর্জ্য ত্যাগ করে। বর্ষার সময় তা জলে মিশে যায়। ফলে জমে থাকা জল থেকেই রোগটি ছড়িয়ে পড়ে।
লেপ্টোস্পাইরোসিস রোগের উপসর্গ
জলবাহিত হয়ে ওই ব্যাক্টেরিয়া যদি শরীরে ঢুকে পড়ে, তা হলে খুব দ্রুত সংখ্যায় বাড়তে থাকে। এই রোগের ক্ষেত্রে জ্বর প্রথম উপসর্গ। জ্বরের সঙ্গে হাতে পায়ে তীব্র যন্ত্রণা হয়। সাধারণ ভাবে এই রোগ ধরা যাবে না। রক্ত পরীক্ষা করলে তবেই এই রোগ ধরা পড়বে। চিকিৎসকরা বলছেন, লেপ্টোস্পাইরোসিস রোগটি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলে লিভার ও কিডনি পর্যন্ত বিকল হতে পারে। নাক দিয়ে, মাড়ি দিয়ে রক্ত বেরোতে পারে। রক্ত বেরোতে পারে প্রস্রাবের সঙ্গেও। সেই সঙ্গেই ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটবে। মেনিনজাইটিসের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অর্থাৎ, মস্তিষ্কে প্রদাহ হবে, রোগীর খিঁচুনিও হতে পারে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যোগীরাজ রায় বলেন, “এটা আসলে পশুদের রোগ, মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হচ্ছে। ইঁদুর-বিড়াল, কুকুরের প্রসাবের সংস্পর্শে এলে, অর্থাৎ যদি বেশি বৃষ্টি হয়, সেই জলে মিশেও যদি আমাদের শরীরের সংস্পর্শে আসে, তাহলে আমরা সংক্রমিত হতে পারি।”
রাজগঞ্জের চেতনবাড়ি গ্রামে কীভাবে ছড়াল এই রোগ?
রাজগঞ্জের চেতনবাড়ি গ্রামের কথা বলছিলাম। সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে এখন উদ্বিগ্ন প্রাণী সম্পদ দফতরও। কারণ ইতিমধ্যেই সেখানে ছড়াতে শুরু করেছে এই রোগ। কিন্তু কীভাবে? জানা যাচ্ছে, গ্রামে একটি হ্যাচারি রয়েছে। অর্থাৎ যেখানে আর কী মাছ, মুরগি বা অন্যান্য প্রাণীর কৃত্রিম প্রজনন ও লালনপালনের ব্যবস্থা করা হয়। স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন, ওই হ্যাচারিতেই প্রচুর পরিমাণ মুরগির বিষ্ঠা জমছে। সেখানেই আনাগোন বাড়ছে ইঁদুর-ছুতোর। এবার গ্রামেও তাদের বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে। তাদের প্রসাব থেকে ছড়াচ্ছে রোগ! ওই হ্যাচারি থেকে ইতিমধ্যেই নমুনা সংগ্রহ করে বেলগাছিয়ায় পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট এলে কারণ জানা যাবে।
CMOH ডাঃ অসীম হালদার জানিয়েছেন, সন্ন্যাসীকাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের চেকরমারি গ্রামে আড়াই লাখ মুরগির একটি পোল্ট্রি ফার্ম রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ওই ফার্মে মুরগির বিষ্ঠা জমে জমে পাহাড়-প্রমাণ আকৃতি ধারণ করেছে। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ মাছি জন্মাচ্ছে, গ্রামে ছড়াচ্ছে। ফার্মে আসছে প্রচুর ইঁদুর। ওই ইঁদুরের মূত্র থেকে ইঁদুর জ্বর ও স্ক্রাব টাইফাস ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। তবে লেপ্টোস্পাইরা রোগ নিয়ে খুব বেশি ভয় পাওয়ার কারণ নেই বলে মনে করছেন তিনি। তিনি বলছেন, “আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। সরকারি হাসপাতালে এই চিকিৎসা হয়। রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায়।”
একই পরিবারের একাধিক জন আক্রান্ত
জ্বর তিন-চারদিনের মধ্যে সারলে, আমরা ধরে নিই ভাইরাল ফিভার। তার মধ্যে না কমলে, আমরা ডেঙ্গির ভয় পাই! কিন্তু এই রোগের কথা ঘুণাক্ষরেও মাথায় আসে না আমাদের। রাজগঞ্জে যারা ইতিমধ্যেই আক্রান্ত, তাঁদের পরিবারের সদস্যদেরও মাথায় আসেনি ব্যাপারটা। প্রথমে জ্বর, ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাওয়া, প্রাথমিক রক্তপরীক্ষা সবই করেন। কিন্তু প্রথমটায় কিছুই বোঝেননি। দেরি হওয়ায়, একই পরিবারে সংক্রমণ ছড়ায় একাধিক জনের মধ্যেই।
গ্রামবাসীদের বক্তব্য, “আমার মেয়ের প্রথমে জ্বর হয়, ভাবি এমনি জ্বর হয়েছে, ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু পরে না কমায় ডাক্তার দেখাই। রক্ত পরীক্ষা করে ডাক্তার বলেন, আমার মেয়ের অবস্থা খারাপ।”
আঁতুড়ঘর-হ্যাচারি
কিন্তু গ্রামগঞ্জে ভরা লোকালয়ের মধ্যেই হ্যাচারি! অনুমতি দিল প্রশাসন! এখন সেই নিয়েই তপ্ত রাজগঞ্জ। কেবল লেপ্টোস্পাইরোসিস নয়, বাড়ছে জন্ডিসের প্রকোপও। জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জে ৮টি গ্রামের প্রায় ১ হাজার জন জন্ডিসে আক্রান্ত।
প্রশ্ন উঠছে, কীভাবে লোকালয়ের মধ্যেই হ্যাচারি? সাধারণত নিয়ম গ্রামের লোকালয়ের বাইরে নিরিবিলি ফাঁকা জায়গায় হ্যাচারি তৈরি করা। সেখানে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা। নিয়মিত পশুর বিষ্ঠা পরিস্কার করে তা প্রক্রিয়াকরণ করে অন্য কাজে লাগানো! কিন্তু রাজগঞ্জের ক্ষেত্রে এই কোনও নিয়মই মানা হয়নি, বলছেন গ্রামবাসীরাই। ইতিমধ্যেই ওই হ্যাচারি নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসতে শুরু করেছেন তাঁরা। ক্ষোভ উগরাচ্ছেন স্থানীয় প্রশাসনের ওপরেও।
ক্ষোভের মুখে প্রশাসন
হ্যাচারি বন্ধ না করলে পদত্যাগ করুন, ভরা হাসপাতালের মধ্যেই গ্রামবাসীদের রোষের মুখে পড়েন রাজগঞ্জের চার বারের তৃণমূল বিধায়ক খগেশ্বর রাও। স্পষ্ট বললেন, “হ্যাচারি বন্ধ করতে হবে, না হলে গদি ছাড়তে হবে!” বিক্ষোভের মুখে পড়ে সুর বদলেছে বিধায়কেরও। তিনি বলছেন, হ্যাচারি নাকি তিনিও এখানে চান না। ম্যাডামকে জানাবেন!
কী বলছেন হ্যাচারির কর্মী?
হ্যাচারির কর্মীর অবশ্য বক্তব্য, এখান থেকেই যে রোগ ছড়াচ্ছে, আদৌ কি তার প্রমাণ রয়েছে? হ্যাচারির কর্মী রঞ্জিত সরকার বলেন, “বৈজ্ঞানীক প্রমাণ দিন, যে এখান থেকেই রোগ ছড়াচ্ছে, এমনিতেই কী বললে হয়ে যায়?”
কিন্তু এসব তরজার বাইরেও থেকে গেল একটা বিষয়! এই রোগের থেকে বাঁচবার উপায় কী?
১. বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথমেই জমা জল এড়িয়ে চলতে হবে। অনেক সময়ে জমা জল পেরোনোর জন্য জুতো হাতে নিয়ে খালি পায়েই যাতায়াত করেন অনেকে। ফলে পায়ের ফাটা অংশ বা কাটাছেঁড়ার জায়গা দিয়েই এই জল শরীরে প্রবেশ করে। বর্ষার সময়ে কখনওই খালি পায়ে জমা জলে হাঁটবেন না। আর যতটা পারেন জমা জল এড়িয়ে চলুন।
২. দূষিত জল, কিংবা মুরগী, হাঁস জাতীয় প্রাণীর সংস্পর্শে এলে, বাড়ি ফিরে হাত ও পা সাবান দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
৩. পশুর প্রস্রাব থাকতে পারে, এমন জায়গা দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যাওয়া এড়িয়ে চলতে হবে। সঙ্গে ওই এলাকা থেকে ফিরে অবশ্যই ভাল করে স্নান করতে হবে।
৪. লেপ্টোস্পাইরোসিসের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয়। তবে নিজে থেকে ওষুধ খেতে যাবেন না। যদি দেখেন জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি হচ্ছে, তা হলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যাবেন।
