কে বলেছে হিন্দু সনাতন ধর্ম? রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের কোথাও উল্লেখ নেই: নৃসিংহপ্রসাদ
মহাভারত, রামায়ণ, পুরাণ- একটা কোনও জায়গায় আপনি 'হিন্দু' শব্দটা দেখাতে পারবেন না। নো হোয়্যার। কিন্তু, 'ভারত' শব্দটা তো দেখাতে পারবেন একশো বার। 'হিন্দু' শব্দটা যদি এত বড় ব্যাপারই হত তাহলে রামায়ণ, মহাভারত বা পুরাণ- কোথাও তো অন্তত একবার এই শব্দটা পেতাম।
তিনি গবেষক। তিনি শিক্ষক। নথি বলছে, এক যুগ আগে অবসর নেওয়া অধ্যাপক। তবু আজও, তিনি ভীষণ প্রাসঙ্গিক। একমাত্র মান্য পুরাণবিদ। রাজনীতির কুম্ভীপাকে পড়া ধর্মের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বঙ্গীয় সংবাদ মাধ্যমের একমেবাদ্বিতীয়ম ফিক্সড ডায়ালিং নাম্বার। তাঁর সাম্প্রতিকতম পরিচয় ইউটিউবার। কিন্তু, পুরাণ আর ইতিহাসকে কি তিনি পৃথক করেন? রামায়ণ-মহাভারত-বেদ বিশেষজ্ঞ সেই তিনি কেন বিজেপির পরিবর্তে তৃণমূলের এত কাছাকাছি? চার দিকে ‘সনাতন ধর্মে’র যে রব উঠছে, তাতে তাঁর কী মত? এমনই নানা প্রশ্ন নিয়ে সংস্কৃত না জানা বঙ্গ সমাজের একমাত্র লাইটহাউজ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির সামনে TV9 বাংলা ডিজিটাল।
ইউটিউবে আসার সিদ্ধান্তটা কি হঠাৎ?
দেখুন, আমাকে অনেকে বলছিলেন, আপনি যে পুরাণ নিয়ে নানা বিষয়ে লিখছেন, এগুলিকে এবার অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে নিয়ে আসুন। কারণ, তাঁরা বলছেন, মানুষ এখন পড়ার অভ্যাস থেকে সরে আসছে। তারা এখন দেখতে-শুনতে বেশি পছন্দ করছে। তাই বিভিন্ন বিষয়ে আমার যে চর্চা তা আমি এই মাধ্যমে ডকুমেন্ট হিসাবে রেখে যাচ্ছি। যাঁদের জানার আগ্রহ আছে, তাঁরা যাতে জানতে পারেন।
কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
আমি অল্প কিছু দিন শুরু করেছি। সেই অর্থে মোটামুটি সাড়া পাচ্ছি। আসলে, আমি তো বিতর্কিত কিছু বলছি না। সেটা করলেই লক্ষ লক্ষ ভিউ হয়ে যায়। কিন্তু, আমি অ্যাকাডেমিক মানুষ। ফলে সেটা আমার লক্ষ্য নয়। আসলে যাঁরা আমার এই চ্যানেলটা করার জন্য উদ্যোগী হয়েছেন, তাঁরাও মনে করছেন বর্তমান সময়ে এই কথাগুলি ডকুমেন্টেড রাখা দরকার। সেটাই মূল লক্ষ্য।
আপনি এক প্রকার লোকশিক্ষার কথা বলছেন। কিন্তু, স্বাধীনতোত্তর ভারতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সংস্কৃত পাঠ এবং চর্চার এই অবনতির কারণ কী?
কারণ হচ্ছে, কাল (সময়)। এ ক্ষেত্রে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে পুরানো সমস্ত কিছুই বোধ হয় ঠিক না। সে জন্যই এটা হয়েছে। অথচ, এই সংস্কৃত ভাষাই ছিল প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন অঙ্গ রাজ্যগুলির মধ্যে একমাত্র যোগসূত্র। এই প্রতিটি রাজ্যেরই নিজস্ব ভাষা ছিল। তবু সংস্কৃত ছিল সার্বিকভাবে তৎকালীন ভারতবর্ষের ভিন রাজ্যের মানুষদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের একমাত্র ভাষা। জাতীয় অখণ্ডতার প্রতীক ছিল। স্বয়ং চৈতন্যদেব যখন কেরল পর্যন্ত গিয়েছিলেন, তখন তো তিনি তামিল বা কেরলের ভাষায় কথা বলেননি, বরং তিনি সংস্কৃত ভাষাতেই ভিন রাজ্যের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন, ভাব বিনিময় করেছিলেন।
তাহলে সমস্যাটা কোথায় হল, সংস্কৃত পড়লে আকর্ষণীয় কেরিয়ার হবে না বলেই কি এই অনীহা?
একেবারেই তাই। তবে আবার যদি ভেবে দেখেন, তাহলে কোনও ভাষা পড়লেই কি সেই অর্থে ভাল কেরিয়ার হয়? একমাত্র ইংরেজির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। আমরা এ ক্ষেত্রে এই চাহিদাটা তৈরি করেছি।
আপনি যখন লেখাপড়া শুরু করছেন তখন তো ব্যাপারটা এমন ছিল না। গোলমালটা কোথা থেকে শুরু হল?
আমি যখন স্কুলে পড়ছি, তখন ক্লাস সিক্স থেকে বাধ্যতামূলক সংস্কৃত পড়তে হত। অর্থাৎ তখন থেকেই শব্দরূপ, ধাতুরূপ শিক্ষার মাধ্যমে ব্যকরণটা পোক্ত হচ্ছে। টানা চলছে ক্লাস সেভেন, এইট…এরপর নাইনে গিয়ে ফের একবার ব্যকরণ ঝালিয়ে নিয়ে ইলেভেন অবধি সংস্কৃত পড়লাম। এবার যখন অনার্স পড়তে যাচ্ছি, তখন কিন্তু সংস্কৃতর ভিতটা অনেকটা মজবুত হয়ে গিয়েছে। এরপর সিলেবাস যেভাবে নেমেছে সেটা ভয়ঙ্কর। এখন যাঁরা পাশ করেন, তাঁরা কেউ সংস্কৃত জানেন না, এটুকু আপনাকে বলে দিতে পারি। যাঁরা বি.এ./এম.এ. পাশ করছেন, তাঁরা কেউ সংস্কৃত জানেন না।
সে কী! তাঁরা তো আপনারই ছাত্র-ছাত্রী!
হ্যাঁ, আমারই ছাত্র-ছাত্রী। আসলে সিলেবাস যেভাবে নেমেছে, তার কারণেই এটা হয়েছে। সেটা বাম আমল। সংস্কৃতকে কম্পালসরি করার জন্য আমরা তখন লড়ছি। তার আগে কম্পালসরি সংস্কৃত উঠে গেল। আমরা তখন আন্দোলন করেছি সংস্কৃতকে স্কুল স্তরে কম্পালসরি হিসাবে ফিরিয়ে আনার জন্য। তখন একটা কথা বলেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনি বলেছিলেন, “এটা পুরোহিতদের ল্যাঙ্গুয়েজ”। অথচ উনি একবারও খেয়াল করলেন না যে ওঁর পিতৃপুরুষ কিন্তু পুরোহিতেরই বংশ।
আপনি কি মনে করেন, সংস্কৃতর পরিচয় কেবল পুরোহিতের ভাষা হিসাবেই?
একেবারেই না। উনি আসলে জানেন না বলেই বলেছেন। পুরোহিতদের ভাষা হতে যাবে কেন? যে ভাষায় মহাভারত লেখা হয়েছে, রামায়ণ লেখা হয়েছে, যে ভাষায় কালীদাস কাব্য রচনা করেছেন, তা কি কখনও কেবল পুরোহিতের ভাষা হতে পারে!
সারা দেশেও কি সংস্কৃত পাঠের ছবি এতটাই করুণ?
হ্যাঁ, সারা দেশেই ছবিটা মোটামুটি একই। তবে মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশে অবস্থাটা অপেক্ষাকৃত ভাল।
পুরাণ ও ইতিহাসকে আপনি কীভাবে পৃথক করেন?
পুরাণ মানে পুরানো কথা। কিন্তু, আমাদের পুরাণের একটা আলাদা জ্যঁ (ধারা) আছে। পুরাণ, আসলে অনেক অনেক পুরানো দিনের কথা।
পুরাণ কি ফিকশন?
না। ফিকশন কেন হতে যাবে? পুরাণই আমাদের ইতিহাস। পুরাণের মধ্যে আপনি সোশ্যাল স্ট্রাকচার পাবেন। অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র- এরা কী আচরণ করবে, কী করবে এবং না করবে- সবই আপনি পুরাণেই পাবেন। স্মৃতিশাস্ত্র, মানে যাঁরা সব আইনের বই তৈরি করেছেন, দেখবেন তাঁরা পুরাণকেই উদ্ধৃত করছেন। মহাভারত পুরাণকে ইতিহাস বলা হয়। ইতিহাস মানে কী? মানে, ইতি-হ-আস অর্থাৎ Thus it happened. সেদিক থেকে পুরাণই ইতিহাস। তবে মহাভারতকে আবার অনেকেই বলেন মহাকাব্য। বিশেষত, বামপন্থীরা এ কথা বলেন। আসলে ভুল বলেন। তাঁরা কিচ্ছু জানেন না, তাই বলেন। মহাভারত যে ইতিহাস সেটা প্রমাণ করে দেওয়া যায়।
কীভাবে প্রামাণ করা যায়?
সে সময় কী কী ছিল, রাষ্ট্র ব্যবস্থা কেমন ছিল-সব কিছু মহাভারত থেকেই প্রমাণ করা যায়।
রামায়ণও কি তাই?
অবশ্যই। রামায়ণও তাই। কিন্তু, রামায়ণও ইজ মোর আ পোয়েটিক ফেনোমেনন।
আপনি তার মানে বিশ্বাস করেন যে রামচন্দ্র নামের সেই ব্যক্তির একদা এই পৃথিবীতে অস্তিত্ব ছিল?
হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি। ভীষণভাবে বিশ্বাস করি। কারণ, তার ইতিহাসটা অনেক আগে ধরা আছে। ঠিক বেদের পরে আমাদের যে ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলো, সেখানে তাঁরা কতগুলো রাজার নাম করেছেন, যাঁদের অহীন্দ্র মহাভিষেক যজ্ঞ হয়েছিল, তার মাধ্যমে এঁরা রাজা হয়েছিলেন। সেখানে ইক্ষাকুর নাম রয়েছে। ইনিই কিন্তু, রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ। মনুর নামও আছে। পুরাণে রামচন্দ্রের সম্পূর্ণ বংশলতিকাও দেওয়া আছে। এভাবেই পুরাণের মধ্যে আপনি ইতিহাসের উপাদান পাবেন।
রামে যখন আপনার আস্থা আছে, তার মানে রামজন্মভূমির বিষয়টি সুপ্রিমকোর্ট…(প্রশ্ন শেষ করা গেল না)
না। রাম জন্মভূমির কোনও মানে নেই। দেখুন, সুপ্রিম কোর্টের ওসব বিষয়ের মধ্যে আমি ঢুকব না।
সে কি! রামে আস্থা আছে, অথচ রামজন্মভূমিতে আস্থা নেই! কেন?
নেই। কারণ, অযোধ্যার কোন প্রান্তে রামচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেছেন, তা কেউ বলে যায়নি। তিনি অযোধ্যায় জন্মে ছিলেন এই পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারি, কারণ রেকর্ড আছে। কিন্তু অযোধ্যার ঠিক কোন জায়গায় তিনি জন্মেছিলেন, তার কোনও নির্দেশ নেই। ফলে সুপ্রিম কোর্টের ওই রায় এবং পলিটিক্সে আমি ঢুকব না। আমার কাছে এটা প্রাসঙ্গিক মনে হয় না। আর আরও একটা কারণ আছে। এই ধরুন, ৫০০ বছর আগে চৈতন্যদেব জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি মায়াপুর না নবদ্বীপে জন্মেছিলেন, তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। নবদ্বীপের গঙ্গার মধ্যে রামকৃষ্ণদেবের সমাধি হল এবং তিনি বললেন, “হৃদে, এখানে মহাপ্রভূ জন্মেছিলেন”। কিন্তু এই বিস্তৃত সময়কালের মধ্যে তো গঙ্গা একাধিকবার গতিপথ পরিবর্তন করেছে। নদীর ধর্মই তো তাই। এই একই কথা তো অযোধ্যার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাহলে আমি এই এতদিন পর কী করে বলব যে রাম জন্মভূমি ঠিক ওই জায়গাটিই! (মুখে স্মিত হাসি)
আচ্ছা, বিজেপির বিরুদ্ধে শিক্ষায় গৈরিকীকরণের অভিযোগ ওঠে। তাঁরা, পাঠ্যসূচিতে এবং শিক্ষানীতিতে পুরাণ-বেদ ইত্যাদির অংশ বিশেষ বা ভাবনা অন্তর্ভুক্ত করতে চায় বলে বলা হয়। আপনি কি মনে করেন এর ফলে দেশ জুড়ে পুরাণ পাঠের পুনরুজ্জীবন ঘটবে?
এসব কিছুই হবে না। আমি বলব, নতুন যে শিক্ষানীতি তৈরি হয়েছে তাতে সংস্কৃত এবং পুরনো যে শাস্ত্র, তার কিছুই নেই। যে জাতীয় শিক্ষানীতিটি তৈরি হয়েছে, আমি সেই কমিটিতেও ছিলাম। ফলে দেখেছি, এটার মাধ্যমে পুরাণ ইত্যাদির পুনরুজ্জীবন তো নয়ই, এমনকী গৈরিকীকরণও হয়নি। বরং হয়েছে যেটা, সেটা হল শিক্ষার আমেরিকানাইজেশন।
কেন এ কথা বলছেন?
বলছি। কারণ, যা ওই দেশে হয়, তাই এই দেশেও করতে চাওয়া হচ্ছে। ধরা যাক, স্কুল স্তর থেকেই বলছি। ক্লাস সেভেন-এইট থেকেই সেমেস্টার সিস্টেমে নিয়ে আসা হচ্ছে। এমনকী এম.এ. স্তরেও সেই সেমেস্টার। ইউজিসি এটা জোর করে চাপিয়েছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এটা মেনেও নিয়েছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি, সেখানে প্রতি আড়াই মাস অন্তর ছাত্র-ছাত্রীরা বলে, স্যার কী প্রশ্ন আসবে বলুন। কারণ সেমেস্টারের পরীক্ষা। আর সেই পরীক্ষায় অধিকাংশ প্রশ্নের ধরন এমসিকিউ। ফলে জ্ঞানের গভীরতাই তৈরি হচ্ছে না।
আপনার চর্চা এবং গবেষণার বিষয় আর বিজেপির ভাবধারা খুব কাছাকাছি। তবু আপনি বিজেপির পাশে নেই, মমতার পাশে। ব্যাপারটা অদ্ভুত না?
বিজেপি মানেই যেন ধর্ম। আসলে তা কিন্তু নয়। আমি ধর্ম চর্চা করি। শাস্ত্র চর্চা করি। আমি রামায়ণ, মহাভারত কাব্য চর্চা করি। পুরানো জিনিস চর্চা করি। আর বিজেপি যেহেতু ওই একটু রামায়ণ, ওই একটু ভগবত গীতা, এগুলোকে মোটামুটি প্রোমোট করে ভাবেন, আমিও সেইটাই তা কিন্তু নয়।
আপনি বলছেন বটে। তবে তাঁদের তো আপনার প্রতি আগ্রহ থাকার কথা?
তাঁদের আমার প্রতি আগ্রহ আছে। আমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চ্যানেলে কখনও তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বলে থাকলেও, তাঁদের আমার প্রতি অসম্মান প্রকাশ করতে আমি দেখিনি। বিজেপি আমাকে সেটুকু শ্রদ্ধা করে এবং সেটা অ্যাকাডেমিক স্ট্যান্ডার্ডে শ্রদ্ধা। অন্য কিছু না।
বিজেপি আপনাকে সরাসরি পাশে পেতে চায়নি কখনও?
দেখুন, আমার চাকরিজীবন পুরোটাই প্রায় কেটেছে বাম আমলে (১৯৭৫ থেকে ২০১০ সাল)। আর বাম আমলে আমি যে অত্যাচারের শিকার হয়েছি তা বলবার কথা নয়। কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি চাকরি পাইনি।
তার কারণ কি আপনি ‘পুরোহিতদের ল্যাঙ্গুয়েজে’র শিক্ষক?
না, না। তার কারণ আমি বামেদের পছন্দ করি না। তাঁদের নীতি পছন্দ করি না। যদিও তাঁদের অনেক নেতা-মন্ত্রী আমাকে ব্যক্তিগত স্তরে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু, আমি যেহেতু বামেদের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না তাই চাকরির জায়গায় আমার কখনও কোনও ইউনিভার্সিটিতে নিয়োগ হয়নি। ২০১০ সালের আগে আমি যখন বামেদের নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতাম, ওঁরা তখন বলতেন, “ও তৃণমূল হয়ে গিয়েছে”।
বামেরা তো ভুল কিছু বলতেন না। আপনি তো পরে তৃণমূল হয়ে গেলেন?
না। আমি তৃণমূল হয়ে যায়নি। আমি বাম বিরোধী ছিলাম, বাম বিরোধীই থেকেছি। কিন্তু সরাসরি পলিটিক্স করা বলতে যা বোঝায় তা আমি করিনি।
ইদানীং অনেকের মুখে প্রায় লব্জের মতো শোনা যায়, ‘সনাতন’, ‘সনাতনী’, ‘সনাতন ধর্ম’-এইসব শব্দ। এর অর্থ কী?
আসলে অর্থ জানেন না বলে এই কথাটা বলে থাকেন। হঠাৎ মনে হয়েছে, তাই এটা লব্জ হয়েছে। এমন অনেকেই আছেন যাঁরা মনে করেন, তাঁরা বলছেন বলেই একটা কথা সিদ্ধ হয়ে যাবে। ‘সনাতন’ শব্দটি মহাভারতের মধ্যে অনেক জায়গায় রয়েছে। সেখানে অন্তত একশো বারের বেশি বলা হয়েছে, “এষো ধর্ম সনাতন”। অর্থাৎ সনাতন মানে একেবারে পুরাতন যে জিনিসটা, সেটাকেই বোঝায়। তাহলে সেদিক থেকে ভাবলে সনাতন ধর্ম বলতে বৈদিক বলতে হয়। অর্থাৎ মহাভারতের আগের যে যুগ সেখানে সনাতন ধর্ম বলতে বৈদিক বা ঔপনিষদিক ধর্মকেই বোঝাবে। তা এখন যাঁরা বলছেন, “আমরা সনাতনী মতে চলি”, তাঁরা কি বৈদিক মতে চলছেন?
তার মানে, ‘সনাতন ধর্ম’ বলতে কোনও ভাবেই হিন্দু ধর্ম নয় বলছেন?
আরে ‘হিন্দু’ শব্দটাই তো এই সেদিনকার। ‘হিন্দু’ আবার কোত্থেকে এল? বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে, “এই হল ভারতবর্ষ। আর এর সন্তানরা হচ্ছেন ভরতের ছেলে-মেয়ে”। আমরা তো ‘ভারত’ শব্দটা ভুলেই গেলাম। ‘হিন্দু’ কোথা থেকে এল? ‘হিন্দু’ শব্দটার প্রয়োজন পড়েছিল মুসলিম শাসকদের। তাঁরা মুসলমানদের পৃথকীকরণের জন্য অন্যান্য ধর্মালম্বীদের ‘হিন্দু’ বলেছিলেন। ‘হিন্দু’ শব্দটা প্রথম কে প্রয়োগ করেছিলেন? ডেরিয়াস করেছিলেন। তিনি যখন সিন্ধু নদীর ওই অঞ্চলটা দখল করেছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন ‘হিন্দু’। সেটা তাহলে কী? আমাদের ‘স’ বা ‘শ’ গ্রিক ভাষাতে ‘হ’ হয়ে যায়। যেমন, ‘সপ্ত’ গ্রিকে হয়ে যায় ‘হেপ্টা’। সেভাবেই সিন্ধুর ওই অঞ্চলটা ডেরিয়াস বলেছিলেন ‘হিন্দুজ্’ অথবা ‘ইন্দুজ্’। এই ‘হিন্দু’ শব্দটা তো চাপা পড়েছিল। অর্থাৎ, আলেকজান্ডারের আগের যে শব্দ তা তো সব চাপা পড়েছিল। মহাভারত, রামায়ণ, পুরাণ- একটা কোনও জায়গায় আপনি ‘হিন্দু’ শব্দটা দেখাতে পারবেন না। নো হোয়্যার। কিন্তু, ‘ভারত’ শব্দটা তো দেখাতে পারবেন একশো বার। ‘হিন্দু’ শব্দটা যদি এত বড় ব্যাপারই হত তাহলে রামায়ণ, মহাভারত বা পুরাণ- কোথাও তো অন্তত একবার এই শব্দটা পেতাম। তাহলে কীসের সনাতন? হিন্দুটা কি সনাতন? আজ্ঞে না, মোটেই না। হিন্দু শব্দটা প্রচলিত হয়েছে মধ্যযুগীয় ভারতে মুসলমান শাসকদের আমলে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পৃথকীকরণের জন্য। বিজেপির এইসব ভাবনা চিন্তাকে আমি খুব একটা শ্রদ্ধা করতে পারি না। ওঁরা আসলে এখনও মুঘলদের বিরুদ্ধেই লড়ে যাচ্ছেন।