Ram Politics in Bengal: বঙ্গে রাম রাজনীতি: বাংলায় প্রেমিক রামের কাছে ‘পরাজিত’ অযোধ্যার তীর-ধনুকধারী রামলালা!

Difference between Ram of Bengal and Ramlala: 'আমাদের কাছে রাম আধ্যাত্মিকতার থেকে বেশি ধার্মিক। আর বাঙালির মনে ধর্ম নিয়ে যে ভাব রয়েছে সবটুকু ভালবাসা। আমরা ধর্মটা ভালবাসি, বৈদি ভক্তিতে বিশ্বাস করি না। আমরা ভক্ত হতে ভালবাসি। আমরা শ্রীরাম, চৈতন্যদেব, শ্রীকৃষ্ণের পুজো যেভাবে করি সেটা ভালবাসা ছাড়া কিছু নয়। ভালবাসা না থাকলে গঙ্গারাম, গোবর গনেশ, কেলে কার্তিক, কলির কেষ্ট বলতে পারতাম না। ভালবাসা আছে বলেই তাদের আমরা ঘরের মধ্যে নিয়ে এসেছি।' এটা সম্ভব হয়েছে শ্রীচৈতন্যদেবের ভক্তি আন্দোলনের কারণে।

Ram Politics in Bengal: বঙ্গে রাম রাজনীতি: বাংলায় প্রেমিক রামের কাছে 'পরাজিত' অযোধ্যার তীর-ধনুকধারী রামলালা!
ভিন্ন রূপে বাংলার রাম ও উত্তর ভারতের রামলালা।Image Credit source: TV9 Bangla
Follow Us:
| Updated on: Jul 08, 2024 | 5:46 PM

“হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ… হরে রাম, হরে রাম/রাম রাম…,” অঝোরে বৃষ্টির সঙ্গে চলছে এই রাম নাম। আর তার সঙ্গে শাঁখ-কাঁসরের আওয়াজ। তারস্বরে এই রাম-নাম শুনেই ঘুম ভেঙে গেল রিমার। মাঝবয়সি রিমা তখনও ঠাহর করতে পারছিল না, আদতে কী হচ্ছে, কোথায় হচ্ছে? বাইরের দিকের জানলাটা খোলা। আওয়াজটা আসছে জানলার দিক থেকেই। জানলার দিকে তাকিয়ে রিমা দেখল, বাইরে অন্ধকার নেমে গিয়েছে। তড়িঘড়ি বালিশের পাশে থাকা মোবাইলে সময় দেখল ৭.১০ PM। এ বাবা! সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে! ঝট করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল রিমা।

কিন্তু, আদতে বাইরে হচ্ছে কী? বিছানা থেকে রিমা জানলায় এসে দাঁড়াতেই অবাক। ঘরের অদূরে বাঁশের মাচানে বসে একদল। তাঁদের মুখ ভর্তি কাঁচা-পাকা দাড়ি। মাথায় ঘোমটা দেওয়া কয়েকজন মহিলাও রয়েছেন। কেউ ঢোল বাজাচ্ছেন, কারও হাতে খঞ্জনি। মহিলাদের কারও হাতে আবার শাঁখ। আসলে সবাই চিৎকার করে রাম-নাম জপছেন- ঠিক যেমনটা পুরানো দিনের কিছু সিনেমায় দেখা যায়, কিছু বইতেও গ্রাম-বাংলার এই সংস্কৃতির কথা শুনেছিল। কিন্তু, শহুরে রিমা কখনও এসব চাক্ষুষ করেনি। বহু বছর পর মেদিনীপুরের এই প্রত্যন্ত গ্রামে মায়ের মামাবাড়িতে এসে এবার তার গ্রাম বাংলার সংস্কৃতি কাছ থেকে দেখার, অনুভব করার অভিজ্ঞতা হল। জানলায় দাঁড়িয়ে এটা দেখতে-দেখতে বিভোর হয়ে গিয়েছিল রিমা। হঠাৎ মামা ঘরে ঢুকতে সম্বিৎ ফিরল। “রাম-নাম নিয়ে কি সুন্দর আসর বসে গো, কি মধুর শুনতে লাগে!”- মামাকে বলে উঠল রিমা। শহুরে ভাগনির এই কথা শুনে মামা অবাক হননি। বরং এক দীর্ঘশ্বাস পড়ল।

মামা কেন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি কলকাতার রাজনীতিতে বড় হওয়া, কর্পোরেট অফিসে চাকরিরতা রিমার। তাই তার গলাতেও ঝড়ে পড়ল আক্ষেপ, “যদি সত্যিই আমাদের কলকাতাতেও এভাবে সকলে একসঙ্গে রাম-নাম করত! রাম নিয়ে দলাদলি ছেড়ে আগের মতো সবাই একসঙ্গে অস্ত্র নয়, খোল-করতাল নিয়ে রাম নবমীর শোভাযাত্রায় যোগ দিত!”

ram procession

হাওড়ার রামরাজাতলায় রাম ঠাকুরের বিসর্জনের শোভাযাত্রা।

রিমার ছোটবেলা কেটেছে হাওড়ায়। তাই হাওড়ার রামরাজাতলার রামপুজো এখনও তাঁর মনে অমলিন। সেই স্মৃতিচারণা করে রিমা বলতে থাকে, রামতলায় লক্ষ্মণ, সীতা-সহ সপরিবারে রাম এবং একাধিক দেবতা একসঙ্গে পূজিত। দেবী দুর্গার মতো যেন রাম সপরিবারে বেড়াতে আসেন। রাম নবমীর দিন এই বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা হয়। তারপর টানা তিন মাস ধরে চলে পুজো। মেলাও বসে। তারপর শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার রাম-সহ এই বিগ্রহের বিসর্জন হয়। সেটাও হয় বিশাল শোভাযাত্রা করে। ব্র্যান্ড বাজিয়ে, গানের সঙ্গে নাচতে-নাচতে এগিয়ে চলে ছেলে-ছোকরারা। পুরুষদের পাশাপাশি মা-বোনেরাও সিঁদুর খেলতে-খেলতে এই শোভাযাত্রায় পা মেলায়। রাম-বিসর্জন দেখতে রাস্তার দু-ধারেও বহু মানুষ জমায়েত হন। রামের এই শোভাযাত্রার জন্য দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হত। তবে এটা নিয়ে কারও কোনও অভিযোগ, আক্ষেপ ছিল না। একবেলা পাখা চলবে না, আলো জ্বলবে না তো কী আসে যায়! রাম ঠাকুরের এই বিসর্জন তো রোজ হয় না! আসলে এখানে তো গোপালের মতোই রাম ঘরের মানুষ, ভক্তের ভগবান।

বাংলায় রামকে তো এভাবেই দেখা হয়। এখানে রামচন্দ্র কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রেমিক পুরুষ। তাই লঙ্কায় রাবণের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ইন্দ্রজিতের নাগপাশবাণে রাম ও লক্ষ্মণকে সাপের কবল থেকে উদ্ধারের সময় গরুড়কেও রণংদেহি মূর্তিতে দেখা যায়নি। কেবল তিনি সেখানে পৌঁছতেই সাপ উধাও। ঠিক যেমন মায়ের চোখরাঙানি দেখেই ছোট ছেলে দুষ্টুমি ছেড়ে বই নিয়ে পড়তে বসে। আবার যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছনোর আগে অজগর সবে মুখে পুড়েছিলেন গরুড়, জরুরি তলব পেয়ে সেটাও উগরে দেন তিনি। অর্থাৎ বারে-বারে অহিংসার বার্তাই উঠে এসেছে কৃত্তিবাসী রামায়ণে। এমনকি, প্রাণে বেঁচে শ্রীরাম গরুড়কে বর দিতে চাইলে গরুড় দ্বিভুজ মুরলীধরের রূপ দেখার মনোবাঞ্ছা প্রকাশ করলেন। অর্থাৎ লড়াকু যুদ্ধবাজ নয়, বংশীধারী প্রেমিক রাম দেখতেই ভালবাসে গ্রাম বাংলা। তাই রামরাজাতলাতেও রামের মূর্তিও দুর্ব্বাদলঘনশ্যাম অর্থাৎ দুর্ব্বার সবুজ ও মেঘের রঙের মিশেলে যে কালচে সবুজ রং আসে, সেটাই তো মুরলীধরের গায়ের রং। তাই বাংলায় রামের বর্ণও দুর্ব্বাদলঘনশ্যাম। তাই বিশিষ্ট পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়িও বলেছেন, “সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে রামের মূর্তির থেকে আলাদা রামরাজাতলার মূর্তি। বলা হয়, এটাই বাঙালির মূর্তি। এর কারণ চৈতন্যদেব। তাঁর সময়েই আমরা রামকে ভজনা করা শিখেছি।”

কিন্তু, বর্তমান প্রজন্মের কাছে তো রাম হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা-পুরুষোত্তম বীর। এটা ভেবেই অজানা ভয়, বিরক্তিতে রিমার চোখ লাল হয়ে উঠল। এরপরই বিরক্তির স্বরে রিমা বলে উঠল, “এখন তো একটি রাজনৈতিক দলের স্লোগান হয়ে গিয়েছে রামের নামে।”

অযোধ্যায় রাম মন্দিরের উদ্বোধন করে রামলালার অভিষেক করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

এই বীর-রূপী রাম তো বাংলার নয়, উত্তর ভারতের। অযোধ্যায় রাম জন্মভূমি নিয়ে তো এক সময়ে কম রক্তারক্তি কাণ্ড হয়নি। যদিও সুপ্রিম-রায়ে বর্তমানে অযোধ্যায় রামের বিশাল মন্দির তৈরি হয়েছে, অধিষ্ঠিত হয়েছে রামলালার মূর্তি। বলা ভাল, দেশ থেকে গোটা বিশ্বের কাছে একটা তীর্থক্ষেত্র ও দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে অযোধ্যার রাম মন্দির ও রামলালা। সেখানে ৫ বছরের রামলালার হাতেও রয়েছে অস্ত্র। অভয়মুদ্রার সঙ্গেই একটি হাতে তীর এবং অপর হাতে ধনুক। অযোধ্যায় গেলে মনে হবে, রাম মানেই গেরুয়া বসন আর বীরত্ব প্রদর্শন। কিন্তু, সুজলা-সুফলা, সংস্কারময়, শান্ত বাংলায় রামের এই রূপ কীভাবে প্রবেশ করল? এর উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে রিমার মতো অনেকেরই মন।

এর উত্তর খুঁজতে গেলে অবশ্য যেতে হবে রাজনীতির গভীরে। রাম হয়ে উঠেছেন হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) ও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) রাজনৈতিক কল্পনার কেন্দ্রবিন্দু। বাংলা বাদে ভারতের অন্যান্য অংশে বিজয়া দশমী আদতে দশেরা হিসাবে পালিত হয়। অর্থাৎ বাণবিদ্ধ করে দশাননকে ভূপতিত করে বিজয়ী রাম। রামের এই বিজয় স্মরণ করেই ১৯২৫ সালে বিজয়া দশমীর দিনে স্থাপিত হয় RSS। যদিও তখন নাম ঠিক হয়নি। ১৯২৬ সালের রাম নবমীর দিনে এটির নাম দেওয়া হয় “রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ”। এই সংগঠনের প্রথম জনলক্ষ্য ছিল, রাম নবমীর সংগঠনকে সহায়তা করা। তাই সংগঠনের পতাকায় গেরুয়া রং বেছে নেয়। পরবর্তীকালে ১৯৬৭ সালের রাম নবমীর দিন নাগপুরে, আরএসএস-এর সদর দফতর থেকে একটি বিশাল শোভাযাত্রা বের করা হয়। মূলত, সেখানকার ঐতিহ্যবাহী আড়ম্বপূর্ণ রথযাত্রার বিপরীতে রাম নবমীর এই শোভাযাত্রা বের করে আরএসএস। ওই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের হাতে ছিল অস্ত্র। উত্তেজনাপূর্ণ স্লোগানও দেওয়া হয়েছিল। নাগপুর থেকে ধীরে-ধীরে দিল্লি-সহ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রাম নবমীর এই শোভাযাত্রা শুরু হয়। তবে বাংলায় এভাবে অস্ত্র নিয়ে রাম নবমীর শোভাযাত্রা শুরু হয় সাম্প্রতিককালে।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই বাংলায় আরএসএস-এর রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়। তারপর ধীরে-ধীরে রাম নবমীর রাশ হাতে নেওয়ার চেষ্টা শুরু করে বিজেপি। শুরু হয় অস্ত্র নিয়ে রাম নবমীর শোভাযাত্রা। ২০১৯ সাল থেকে এই শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে রক্তাক্ত হয়েছে বাংলার মাটি। ক্রমে ‘হরে রাম’ নাম-জপ পরিণত হয়েছে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানে। একটা সময়ে তো এই শ্রীরাম স্লোগান হয়ে ওঠে বিপক্ষকে লাঞ্ছিত করার, দমানোর হাতিয়ার। বিশেষত, বিজেপি তথা গেরুয়া শিবিরের কাছে বাংলার শাসকদল, তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দকে বিপাকে ফেলার একটা হাতিয়ার হয়ে ওঠে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি। তৃণমূল শিবিরও পিছু হটার দল নয়। তারা পাল্টা বাংলাকে তুলে ধরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শুরু করে। আর এর মধ্য দিয়েই যেন প্রাচীর পড়ে যায় ‘রাম’ আর ‘বাংলা’-র মধ্যে। ২০২৩ সালেও রাম নবমীতে বিজেপির অস্ত্র মিছিলকে কেন্দ্র করে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের সাক্ষ্য হয়েছে বাংলা।

ram navami procession

অস্ত্র হাতে রাম নবমীর শোভাযাত্রা।

যদিও কৃত্তিবাসী রামায়ণে রাম আমাদের ঘরের সদস্য। তারপর অবশ্য ২০২৩-এর শেষে অযোধ্যার রাম মন্দিরের উদ্বোধনের ছায়া বাংলাতেও পড়ে। বলা যায়, গোটা দেশেই এক উৎসবের চেহারা তৈরি করা হয়েছিল। রাম মন্দির উদ্বোধনের সন্ধ্যায় দেশজুড়ে পালিত হয় ‘অকাল দীপাবলি’। গোটা দেশকে এক সুতোয় গেঁথেছে রাম-ভাবনা। সেই কথাই স্মরণ করিয়ে সাহারানপুরে লোকসভা নির্বাচনের এর প্রচারে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, “ভগবান রামকে ছাড়া কি দেশের কল্পনা করা যায়! আমাদের এখানে তো সকাল-সন্ধে যখনই কারও সঙ্গে দেখা হয়, রাম-রাম বলে কথা শুরু হয়। অন্তিম যাত্রাও রামের নাম নিয়েই হয়।”

রাম ছাড়া দেশের কল্পনা করা যায় না ঠিকই, তবে অস্ত্রধারী রাম সকলের নাপসন্দ! তাই অস্ত্র নিয়ে রাম নবমীর মিছিলের প্রথম থেকেই তীব্র বিরোধিতা করেছিল বাংলার শাসকদল। বাংলার শান্তিপ্রিয় বাঙালি রামকে নিয়ে এই উগ্র রাজনীতি, মর্যাদা-পুরুষোত্তম রামকে মেনে নিতে পারেনি। রাম আর হনুমানকে নিয়ে ভালবেসে যারা রঙ্গ করত, তাদের কাছে রণংদেহি রাম শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রেমিক রাম, প্রভুবৎসল হনুমানই তো বাংলার ঘরের সদস্য। তাই রাম-রাবণের যুদ্ধের থেকে রামকে নিয়ে হনুমান এবং গরুড়ের ভালবাসার যুদ্ধ বাংলার মানুষের বেশি মন কাড়ে। আর এখানেই বাংলায় ‘স্ত্রী-প্রেমী’ রামের কাছে পরাজিত অযোধ্যার তীর-ধনুকধারী রামলালা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ‘প্রেমিক’ রামকে ‘বীর’ রামে পরিণত করার প্রয়াস যে বাংলার মানুষ ভালভাবে নেয়নি, তারই প্রতিফলন এবারের লোকসভা নির্বাচনের ফল। ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে বাংলায় বিজেপির সাংসদ সংখ্যা ১৮ থেকে কমে দাঁড়ায় ১২। এপ্রসঙ্গে সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, “যাঁরা ভাবছিলেন, রামের হাত ধরে বাংলায় বিজেপি উত্থান ঘটানো হবে, সেটা ধাক্কা খেয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারছেন, পারবে না।” তাহলে এবার কী বঙ্গে রাম-রাজনীতির অবসান হবে? বন্ধ হবে জয় শ্রীরাম-এর নামে রাম নবমীর রক্তক্ষয়ী অস্ত্র মিছিল?

যদিও বাংলাতেও ‘লালা’ কথাটির প্রচলন রয়েছে। এখানকার অবাঙালিরা ছোট শিশুদের লালা বলে। তবে এতকিছুর পরেও অস্ত্র হাতে রামলালার মূর্তি বাংলা মেনে নিতে পারেনি বলেই মনে করেন বিশিষ্ট পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি। তাঁর কথায়, “বাঙালির রাম স্বতন্ত্র। এখানে রামকে কাছের মানুষ করে তোলা হয়েছে। দেবতার মানবায়ন করেছি আমরা। আবার মানুষের মধ্যে দেবতাকে খুঁজি অর্থাৎ দেবায়ন করি।”

রামের মধ্য দিয়ে বাংলায় গেরুয়া শিবিরের আধিপত্য বিস্তারের কথা অবশ্য অস্বীকার করেছেন বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ শমিক ভট্টাচার্য। তাঁর দাবি, “বিজেপি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে না।” আর বিজেপির খারাপ ফল করার কথা একেবারে নস্যাৎ করে দিয়েছেন তিনি। একইভাবে ধর্মের ভিত্তিতে ভোটের ফলের প্রসঙ্গ কার্যত এড়িয়ে গিয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী তথা প্রবীণ তৃণমূল নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি হয় না।”

রামরাজাতলায় ঐতিহ্যবাহী রামপুজো।

শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ও শমিক ভট্টাচার্যের বক্তব্য একেবারে ভুল নয়। তাই নৃসিংহপ্রসাদ বলেন, “আমাদের কাছে রাম আধ্যাত্মিকতার থেকে বেশি ধার্মিক। আর বাঙালির মনে ধর্ম নিয়ে যে ভাব রয়েছে সবটুকু ভালবাসা। আমরা ধর্মটা ভালবাসি, বৈদি ভক্তিতে বিশ্বাস করি না। আমরা ভক্ত হতে ভালবাসি। আমরা শ্রীরাম, চৈতন্যদেব, শ্রীকৃষ্ণের পুজো যেভাবে করি সেটা ভালবাসা ছাড়া কিছু নয়। ভালবাসা না থাকলে গঙ্গারাম, গোবর গনেশ, কেলে কার্তিক, কলির কেষ্ট বলতে পারতাম না। ভালবাসা আছে বলেই তাদের আমরা ঘরের মধ্যে নিয়ে এসেছি।” এটা সম্ভব হয়েছে শ্রীচৈতন্যদেবের ভক্তি আন্দোলনের কারণে। আর এখানেই উত্তর ভারতের রামলালার সঙ্গে বাংলার রামের পার্থক্য। উত্তর ভারতে আজও প্রশ্ন ওঠে, রাম আর্য নাকি অনার্য? রাম কি ক্ষত্রিয়? ব্রাহ্মণ তো নয়! বাংলায় আমরা রামকে এভাবে ভাবব নাকি সাধারণ মানুষ হিসাবে মানব? নৃসিংহপ্রসাদের মতে, বাঙালির মধ্যে জাত-পাতের বিষয়টি এখনও সেভাবে আসেনি ভক্তি আন্দোলনের প্রভাব। বিবেকানন্দও তো ব্রাহ্মণ ছিলেন না। বাংলায় জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে দেবতার মানবায়ন করা হয়েছে। আসলে বহুত্ববাদী সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বাঙালির মনন তৈরি হয়েছে। তাই রাম এখানে অনেক বেশি রোমান্টিক চরিত্র, যাকে আমরা ভালবাসি। রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও একথার উল্লেখ রয়েছে, ‘রামকে আমরা ভালবাসি।’

আসলে রামের মধ্যে বৈপরীত্য নেই। তবে উত্তর ভারতের মতো বাংলায় উন্মাদনা ছিল না এবং এখনও সেটা নেই বলেই জানান নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির। তাই আজও রিমা আশা করে, আবার সেই শ্রীচৈতন্য-রামকৃষ্ণের সময়ের রাম-সংস্কৃতি দেখবে বাংলার মানুষ। অস্ত্রমিছিল নয়, রাম নবমীতে রামকে ঘরের সদস্য মনে করে শঙ্খ, কাঁসর নিয়ে শোভাযাত্রায় মেতে উঠবে বাংলার আপামর জনগণ। মহিলারাও মেতে উঠবে সিঁদুরখেলায়। আশাতেই তো বাঁচে বাঙালি!