বিশ্লেষণ: কেন বিষ খেলেন পাঁচ শিক্ষিকা? দাবি কীভাবে বদলে গেল আন্দোলনে?
SSK/MSK: বাম আমলে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী বিধানসভায় এই শিক্ষাকর্মীদের বেতন বৃদ্ধির জন্য বিল এনেছিলেন। তার কয়েকটা অংশ নিয়ে প্রতিবাদে মুখর হন বিরোধীর আসনে থাকা তৃণমূল বিধায়করা। সেই বিলের খসড়া বিধানসভায় ছিঁড়ে ফেলে প্রতিবাদ জানান বিরোধী নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
পশ্চিমবঙ্গ: চাকরির স্থায়ীকরণের দাবি। অভিযোগ মূলত জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে। সেই আন্দোলনই বদলে গেল চাকরির বদলি আটকাতে বিক্ষোভে। আর সেই চাকরিতে বদলির নির্দেশে ক্ষুব্ধ হয়ে বিষ খেলেন পাঁচ শিক্ষিকা! মঙ্গলবার দুপুরে সল্টলেকের বিকাশ ভবনের সামনে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজ্য রাজনীতিতে শুরু চাপানউতোর। কিন্তু কেন বিষ খেতে হল এই পাঁচ শিক্ষিকাকে?কোন পরিস্থিতি তাঁদের আত্মহননের দিকে ঠেলে দিল? কী ছিল তাঁদের প্রকৃত দাবি? তাঁদের এই আন্দোলনের ইতিহাসই বা কী? গ্রাউন্ড জ়িরোতে দাঁড়িয়ে এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখা যাক।
ঘটনার সূত্রপাত ১৯৯৭ সালে:
বাম সরকারের আমলে পঞ্চায়েত এবং গ্রামোন্নয়ন বিভাগের অধীনে SSK এবং MSK-র সহায়ক/সহায়িকা, সম্প্রসারক/সম্প্রসারিকারা চাকরি পান। তখন বেতন বলতে কিছু ছিল না। তবে সাম্মানিক ছিল মাত্র ৫০০ টাকা। সেটা ১৯৯৭ সাল। তবে ধাপে ধাপে বেতন বাড়ানো হয়।
২০১১-তে এক ধাক্কায় বাড়ল বেতন:
SSK এবং MSK-র সহায়ক/সহায়িকা, সম্প্রসারক/সম্প্রসারিকাদের বেতন বেড়ে হয় ৫ হাজার ৪০০ টাকা। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী বিধানসভায় এই শিক্ষাকর্মীদের বেতন বৃদ্ধির জন্য বিল এনেছিলেন। তার কয়েকটা অংশ নিয়ে প্রতিবাদে মুখর হন বিরোধীর আসনে থাকা তৃণমূল বিধায়করা। সেই বিলের খসড়া বিধানসভায় ছিঁড়ে ফেলে প্রতিবাদ জানান বিরোধী নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ঘটনাক্রমে পরে যাঁর শিক্ষামন্ত্রিত্ব কালে তীব্র হয় এই শিক্ষাকর্মীদের আন্দোলন। সেই বিলে বলা হয়েছিল তিন বছর অন্তর ৫ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি হবে এই শিক্ষাকর্মীদের। কিন্তু তৃণমূল জমানায় তা মানা হয়নি বলে অভিযোগ।
ফের বেতন বৃদ্ধি:
২০১৮ সালে তৃণমূল সরকারের আমলে শিক্ষাকর্মীদের বেতন বৃদ্ধি হয়। ২০১৮ সালে মমতার সরকার এক ধাক্কায় পার্শ্বশিক্ষকদের ৪০ শতাংশ ভাতা বাড়িয়ে দেয়। সহায়ক সহায়িকাদের সাম্মানিক বাড়িয়ে মাসিক ১০, ৩৪০ টাকা এবং সম্প্রসারক সম্প্রসারিকাদের সাম্মানিক বাড়িয়ে ১৩,৩৯০ টাকা করা হয়। এছাড়াও বাৎসরিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট চালু করা হয়েছে। তবে তিন বছরে যে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট শুরু হয়েছিল সেটা তুলে দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেও আন্দোলন হয়।
আন্দোলনরত শিক্ষাকর্মীদের এখনকার দাবি ঠিক কী কী?
১) বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরে প্রায় ৩,৬০০ শিক্ষিকা শিশুশিক্ষা কেন্দ্র ও মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রে কর্মরত রয়েছেন। রয়েছেন ৩৬ জন অ্যাকাডেমিক সুপার ভাইজার। তাঁদের শিক্ষা দফতরে নিয়ে আসার বিষয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পৌর ও নগরোন্নয়ন দফতর থেকে তাঁদের ফাইল অর্থ দফতরে এবং শিক্ষা দফতরে দীর্ঘদিন ধরে আটকে রয়েছে। ফলে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরেও বার্ষিক ৩ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ও অবসরকালীন তিন লক্ষ টাকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
২) বিক্ষোভকারীদের দাবি, পঞ্চায়েতের অধীনস্ত এসএসকে, এমএসকে ও এএস-রা যেমন শিক্ষা দফতরে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, ঠিক তেমনই পৌর ও নগরোন্নয়নের অধীনস্ত এসএসকে, এমএসকে ও এএসদের শিক্ষা দফতরের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। তাঁদের বার্ষিক ৩ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ও অবসরকালীন তিন লক্ষ টাকার সুবিধা দিতে হবে। রাজ্যের ৬০০ জন একাডেমিক সুপার ভাইজার ও ১৭ জন ডিকিউএম কর্মীকে শিক্ষা দফতরে সম্মানজনক পদ মর্যাদা সহ বকেয়া বার্ষিক ৩ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ও অবসরকালীন তিন লক্ষ টাকা যাতে তাঁরা দ্রুত পান সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
৩) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল চাকরির নিরাপত্তা। হালে যে জাতীয় শিক্ষানীতি তা এই চুক্তিভিত্তিক শিক্ষাকর্মীদের মান্যতা দেয় না। তাই তাঁদের চাকরির স্থায়ীরকরণ এবং নিশ্চয়তার দাবিতে লড়াই করে আসছিলেন তাঁরা। কয়েকদিন আগে শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ির সামনে জমায়েত হয়েছিলেন। তার পর গত ১৭ অগস্ট পোস্টার গলায় ঝুলিয়ে বিকাশ ভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখান পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মঞ্চের ছাতার তলায় আসা এই শিক্ষাকর্মীরা। তবে কিছুক্ষণ বাদেই বিক্ষোভকারীদের আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। এদিকে এর পর পাল্টা শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু নিখোঁজ, এই মর্মে পুলিশের কাছে একটি জেনারেল ডায়েরি দায়ের করতে চায়! যদিও পুলিশ এই অভিযোগ গ্রহণ করেনি বলে খবর।
ওই অভিযোগপত্রে চুক্তিভিত্তিক পার্শ্ব শিক্ষক, এসএসকে, এমএসকে, শিক্ষকবন্ধু, স্পেশাল এডুকেটর এবং ম্যানেজমেন্ট স্টাফরা অভিযোগ করেন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতির জেরে তাঁরা আতঙ্কিত এবং উদ্বিগ্ন। কারণ, জাতীয় শিক্ষানীতির ফলে চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের চাকরিতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
সংক্ষেপে বললে এই শিক্ষাকর্মীদের মূলত তিনটি দাবি। প্রথমত, কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় শিক্ষা নীতির কবল থেকে সমগ্র শিক্ষা মিশনের কর্মীদের যথা SSK/MSK শিক্ষক, পার্শ্বশিক্ষক সহ চুক্তিভিত্তিক ভিত্তিকদের রক্ষা করা। দ্বিতীয়ত, বেতনবৃদ্ধি করা কারণ, ১০ হাজার টাকা অথবা তার কম ভাতাতে আর সংসার চলছে না এই মূল্যবৃদ্ধির বাজারে। আর তৃতীয়ত, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরেও বার্ষিক ৩ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট এবং ৩ লাখ টাকা অবসরকালীন সুবিধা তাঁরা পাচ্ছেন না।
আন্দোলনের অভিমুখ বদল:
চুক্তিবদ্ধ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এই দাবিগুলির অভিমুখ বদলে গেল চাকরির বদলির নির্দেশে। মূলত স্থায়ী চাকরির দাবিতেই আন্দোলন করছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি আন্দোলনরত শিক্ষিকাদের বদলি করা শুরু হয়। গত মঙ্গলবার বিষপান করা পাঁচজনের এক শিক্ষিকাকে শালবনি থেকে বদলি করা হয়েছে জলপাইগুড়ির একটি হিন্দি স্কুলে। আরেকজনকে মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জ থেকে বদলি করা হয়েছে জলপাইগুড়িতে।
এ নিয়ে শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মঞ্চের প্রধান মইদুল ইসলাম বলেছেন, তাঁদের কথা কেউ শুনছেন না। তাঁরা শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর বাড়িতে কয়েকবার গিয়েও মন্ত্রীর দেখা পাননি। সোমবার তিনি হাইকোর্টে মামলা করতে যাচ্ছিলেন। তখন তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তার প্রতিবাদেও মঙ্গলবার বিক্ষোভ দেখানো হচ্ছিল। সেখানে শিক্ষিকারা আন্দোলন করছেন বলেই তাঁদের উত্তরবঙ্গে বদলি করা হয়েছে। আর তার পরেই এই বিষপানের ঘটনা।
এ নিয়ে সরকার কী বলছে?
এই পরিস্থিতির মধ্যেই সেই পাঁচ শিক্ষিকাকে বিজেপি ক্যাডার বলে এদিন তোপ দাগলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। এই ঘটনা অনভিপ্রেত বলে একটি দীর্ঘ ফেসবুক পোস্ট করেছেন তিনি। তাতে তিনি যে দাবি করেছেন তা হল, বাম সরকারের আমলে পঞ্চায়েত এবং গ্রামোন্নয়ন বিভাগের অধীনে SSK এবং MSK-র সহায়ক/সহায়িকা, সম্প্রসারক/সম্প্রসারিকারা নামমাত্র সাম্মানিক-এর বিনিময়ে কাজ করতেন। কাজের নিশ্চয়তা, আর্থিক নিরাপত্তা এবং অবসরকালীন সুযোগ সুবিধা বলে কিছু ছিল না। কিন্তু মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল সরকার ১ ডিসেম্বর, ২০২০ সাল থেকে SSK এবং MSK-গুলিকে বিদ্যালয় শিক্ষা বিভাগের অধীনে এনে একটি সুসংবদ্ধ রূপ দেয়। সহায়ক-সহায়িকাদের সাম্মানিক বাড়িয়ে মাসিক ১০,৩৪০ টাকা এবং সম্প্রসারক-সম্প্রসারিকাদের সাম্মানিক বাড়িয়ে ১৩,৩৯০ টাকা করা হয়েছে। এছাড়াও বাৎসরিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট চালু করা হয়েছে। যদিও আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, এই ইনক্রিমেন্ট কেবল খাতায় কলমে। এর সুবিধা তাঁরা পাননি।
এদিকে ব্রাত্য জানাচ্ছেন, এঁদের প্রত্যেককে স্বাস্থ্যসাথী (Swasthya Sathi) প্রকল্পের অধীনে নিয়ে আসা হয়েছে। যাঁরা ৬০ বছর বয়সে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন, তাঁদের অবসরের সময়ে প্রত্যেকের জন্য ৩ লক্ষ টাকা এককালীন অবসর ভাতা চালু করা হয়েছে। বাকিদের জন্যও এই সুবিধা দানের বিষয়ে অর্থদপ্তরের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এমনকি ৬০ বছর বয়সে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত যাঁরা জানিয়েছেন, তাঁদের জন্য চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু করা হয়েছে। মহিলাদের জন্য সরকারি নিয়মানুযায়ী মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও প্রত্যেকের জন্য চিকিৎসা সংক্রান্ত বাৎসরিক ১৮ দিন ক্যাজুয়াল লিভ বা ছুটির অধিকার দেওয়া হয়েছে।