Roman & Parthian Food Recipe Part I: খানা খানদানি-পর্ব ০৩, ১৬০০ বছরের প্রাচীন রোমান খাবার ‘পুল্লুম পার্থিকুম’ আসলে কী?
Roman & Parthian Food Recipe––কুক্কুটী পারসিক বা পুল্লুম পার্থিকুম আসলে কী, তা পড়তে-পড়তে আমরা শুনব কী ভাবে সেই রোম সাম্রাজ্যের সেরা কৃতদাস-পাচকেরা সারা দুনিয়া থেকে আসা নানা উপকরণের নির্জাস বের করে আনছিলেন নিজেদের হেঁশেলে।
নীলাঞ্জন হাজরা: পর্ব ৩
পুল্লুম পার্থিকুম
কুক্কুটী পারসিক
মূল রেসিপি
‘‘মুরগিটিকে উল্টিয়ে ডানা-মেলা ঈগল পাখির মতো করে রাখুন। গোলমরিচ, লাভেজ-পাতা ও একটু শাহি-জিরা থেঁতো করুন। ফিশ সস্ দিয়ে ভিজিয়ে নিন। ওয়াইনে গুলে নিন। একটা কুমান পাত্রে মুরগিটা রাখুন। রান্নাটা করতে-করতেই কড়া হিং হাল্কা গরম জলে গুলে মুরগিটার ওপর ছড়িয়ে দিন। গোলমরিচ ছড়িয়ে পরিবেশন করুন।’’
–আপিকিউস
রেসিপিটা নিলাম ১৬০০ বছর আগে কথ্য লাতিন ভাষায় লেখা আপিকিউস কেতাব থেকে। সঙ্গে রইল ব্রিটিশ মিউজিয়াম-প্রকাশিত অ্যান্ড্রু ড্যালবি এবং স্যালি গ্রেইঙ্গারের সটীক অনবদ্য রেসিপি সংকলন ‘The Classical Cookbook’ থেকে নেওয়া টিপ্পনি। এ পাকপ্রণালী দেখে মনটা উদাস হল। বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে আকাশের এ দিক-ও দিকে ভেসে বেড়ানো কাটা ঘুড়ির মতো মনে ভেসে-ভেসে এল অনেক কাটা-কাটা ছবি। কলোসিয়ামে শিউরে ওঠার ছবি। ভেনিসের এক রেস্তোরাঁয় অপমানিত হওয়ার ছবি। শিরাজের অনতিদূরে সোনালি রোদ্দুরে আশ্চর্য এক প্রাচীন শহরের ছবি। আর সব থেকে বেশি ভেসে উঠল যুগ-যুগ ধরে সাম্রাজ্য গড়া আর ভাঙার ইতিহাসে ভয়ঙ্কর সব যুদ্ধের ছবি। সে কী মশাই, খাবার থালে সাম্রাজ্য ভাঙা-গড়ার যুদ্ধের ছবি?
বিলকুল। দেখব ক্রমে-ক্রমে।
আমার আদ্যোপান্ত মধ্যবিত্ত বাড়ির হেঁশেলে এ খানা তৈরি করে মুখে দিয়েই বুঝলাম এর স্বাদও সেই উদাস মনের নানা রঙিন ছবির মতোই ডেলিকেট। এ লেখার শেষে ১৬০০ বছরের প্রাচীন এই খানদানি রোমান খানার একটু রদবদল করে নেওয়া আধুনিক রেসিপিটি দেখলেই বোঝা যাবে, আসলে এ এক রকমের গ্রিল্ড চিকেন। কিন্তু হলফ করে বলতে পারি ইউরোপে, মার্কিন মুলুকে বা আমাদের এই উপমহাদেশেও যে হরেক কিসিমের গ্রিল্ড চিকেন খেয়েছি, এর স্বাদ তার থেকে আকাশ-পাতাল আলাদা। এর নরম আকাশি স্বাদে কোনও তাড়াহুড়ো নেই—ভেসে বেড়ানো কাটা ঘুড়ির মতোই। আর তেমনই নানা রঙের। ভালো কথা, গ্রিল্ড চিকেন আর তন্দুর মর্ঘ বা চিকেন তন্দুরির মধ্যে গুলিয়ে ফেলবেন না প্লিজ!
এই কুক্কুটী পারসিক বা পুল্লুম পার্থিকুম আসলে গ্রিল্ড চিকেন। তা পাকাতে-পাকাতে আমরা শুনব কী ভাবে সেই রোম সাম্রাজ্যের সেরা কৃতদাস-পাচকেরা সারা দুনিয়া থেকে আসা নানা উপকরণের নির্জাস বের করে আনছিলেন নিজেদের হেঁশেলে।
কাজেই সব্বার আগে হাজির ইতালি। আমার ভাল লাগেনি। সে দেশের কম সে কম রকম দশেকের চিজ (cheese) আজও আমার নাকে-জিভে-গলায় লেগে আছে অনির্বচনীয় স্বাদে-গন্ধে। কিন্তু সে সব গপ্পো অন্য কোনও দিন। আজ মনে পড়ছে রোমা আর ভেনেৎজিয়ার কিছু-কিছু ঘটনা।
খুব নিরুপায় না হলে আমি বিদেশ ভ্রমণে বড় হোটেলে উঠি না, বড়ো রেস্তোরাঁয় খাই না। সাধ্যে কুলায় না। কিন্তু তার থেকেও একটা বড় কারণ আছে। সত্যি বলতে কী, চেষ্টা করি হোটেলেই না উঠতে, ‘হোম-স্টে’ করতে। তার মজাই আলাদা। নদী-অরণ্য-পাহাড়-পর্বত, মন্দির-মসজিদ-প্রাসাদ এসব নয়, আসল দেশ দেখা দেশের মানুষকে অন্দর থেকে দেখা। সেটা হোটেলে থেকে তারা-মারা রেস্তোরাঁয় খেয়ে হতেই পারে না। কিন্তু ভেনেৎজিয়াতে সে উপায় ছিল না। যাই-ই হোক, স্নান-টান সেরে হোটেল থেকে যখন ডিনারে বার হলাম, তখন রাস্তা জনশূন্য। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ। একটা ধারাল নোনতা শিরশিরে বাতাস। রাস্তা সরু-সরু। রাস্তার আলোগুলো কেমন যেন টিমটিমে। একটা লম্বা গম্ভীর হর্ন ভেসে এল। জাহাজের ভেঁপু। চটপট যে রেস্তোরাঁটা সামনে পড়ল, তাতেই গেলাম ঢুকে। কপাল, পরে জেনে ছিলাম সে নাকি এ শহরের বেশ নামজাদা রিস্তোরান্তে। ফলত, যা হওয়ার তাই-ই হল। আলো-আঁধারি হাল্কা গন্ধের হলঘরে শরীর ডুবে-যাওয়ার মতো চেয়ারে-চেয়ারে কিছু ফিসফিসে সুগন্ধী নর-নারী, টুংটাং, মৃদু হাসি, ধবধবে উর্দি আর বো-টাই ওয়েটার। কাচের পলকাটা নির্জীব হাসির পর ইয়া মোটা চামড়া-বাঁধানো খান তিন খানা-পিনা মেনু। খুলেই প্রথম রিয়্যাকশন হল—ভাগ চল্ নাট্টু! এ রেস্তোরাঁয় ঢোকার রেস্তো তোমার জিন্দেগিতে হবে না। বিচিত্র ইতালিয়ান নামের পাশে যে সব সংখ্যা লেখা, তার মধ্যে সব থেকে ছোটটিও আমার গোটা একদিনের থাকা-খাওয়ার বাজেট! তেমনই সব থেকে ছোট অঙ্কের একটা খানা বেছেছিলাম। সে অর্ডার দেওয়ার পরেও দেখি উর্দিধারী হাত দু’টো সামনে গুছিয়ে মৃদু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন।
‘‘কিছু বলছেন?’’
‘‘ওয়াইন অর্ডারের জন্য অপেক্ষা করছি সিনিয়র।’’
‘‘না-না এতেই চলবে।’’
‘‘রিয়েলি?’’
‘‘আর মেন কোর্স?’’
‘‘না-না, এতেই চলবে।’’
‘‘ওহ্!’’
চোখের সামনে কাচ পাথর হয়ে যেতে দেখলাম। এর পরেই উর্দিধারীর মুখের চামড়ায় একটুও ভাঁজ না-ফেলে স্রেফ শরীরী ভাষায়-বুঝিয়ে-দেওয়া যে অসভ্যতাটা সহ্য করতে হল, তাতেই মনটা এমন বিষিয়ে গিয়েছিল যে আমার মনে হয় না আমি আর সুযোগ পেলেও কোনও দিন ভেনিস ফিরে যাব। সেই তেতো রাতে অর্ডার করেছিলাম গ্রিল্ড চিকেন। কী আর বলব, নানা বাক্তাল্লা ও মানানসই ইউরোর চোখরাঙানি সত্ত্বেও, হাজার দেড়েক বছর আগের পুল্লুম পার্থিকুম তাকে বসিয়ে-বসিয়ে তেরো গোল দেবে।
এখন কথা হল, পুল্লুম তো কুক্কুটী অথ মুরগি। কিন্তু পার্থিকুম। অনেক ভেবেচিন্তে লাতিন পার্থিকুম, ইংরেজি ‘পার্থিয়ান’-এর বাংলা করলাম পারসিক। কিন্তু সেটা একশো ভাগ ঠিক নয়। আর সেই থেকেই রোমের কথা মনে পড়ল। রোমে অবশ্য হোটেল-টোটেল নয়, একটা ছোট্ট গলতায় একটা রুম ভাড়া করেছিলাম। তেরমিনি রোমের প্রধান ট্রেন স্টেশন। আমাদের হাওড়া স্টেশনের মতই গমগমে। সেখানে ট্রেন থেকে নেমেই মালুম চলল জাঁদরেল শহর । দুরু-দুরু বুকে বাইরে এসে সবে ভাবছি কী করে সেই গলতায় পৌঁছই। সহসা দেবদূতের আবির্ভাব। ছাতা বিক্রি করছেন। চিরকুটে ঠিকানাটা লিখে, কিন্তু-কিন্তু করে ক্ষমাটমা চেয়ে ইংরেজিতে জিগ্যেস করলাম সে ঠিকানায় পৌঁছনোর সব থেকে সস্তা উপায় কী? দেবদূতের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল নিমেষে—‘‘আপনাগো দেইক্কা বাঙ্গালি মনে হতেসে!’’ কান এঁটো করা হাসি। জানলাম গলতাটি দেবদূতের পরিচিত আর এক বাংলাদেশির। বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল তাঁদের সঙ্গে। বাংলাদেশের গরিব প্রত্যন্ত হাউর-ঘেরা সবুজ গ্রামের শিকড় ছিড়ে একমুখী টিকিট নিয়ে জীবনের বারদরিয়ায় বেরিয়ে পড়া তাঁদের গল্পও তাজ্জব।
কিন্তু সে সব এখানে নয়। এখানে রোম সাম্রাজ্যের কথা, পার্থিয়ার কথা। সম্রাট কায়সার নেরভা ত্রাইয়ানুসের কথা। ইংরেজিতে যিনি পরিচিত সম্রাট ট্রেজান নামে। তাঁর শাসনকাল ৯৮ থেকে ১১৭ সাধারণাব্দ। প্রশ্ন হল, মুরগি রান্নার ধান ভান্তে ট্রেজান-শিবের গাজন কেন? আর কী সব যুদ্ধ-টুদ্ধের কথা হচ্ছিল, তা-ই বা কোথায়?
দু’টোরই উত্তর ওই একটি শব্দে—পার্থিকুম।
মনে আছে, রোমে সেই গলতার ঘরে লটবহর রেখে চানটান করেই দৌড়েছিলাম কলোসিয়াম। পৃথিবীর তিনটি প্রাচীন মহাসাম্রাজ্যের অবশেষ দেখার সুযোগ আমার হয়েছে—আথিনার অ্যাক্রোপোলিস, রোমার কলোসিয়াম, রোমান ফোরাম, ট্রেজান ফোরাম, আর শিরাজ শহরের অনতিদূরে ন্যাগ্শ-এ-রুস্তম বা পার্সেপোলিস।
অবধারিতভাবে সব সাম্রাজ্যের জৌলুসের কাঁটা-মারা জুতোর তলায় রক্তে-অশ্রুতে মিশে বীভৎস কাদার পিণ্ড জমে আছে। কিন্তু কলোসিয়াম দেখতে-দেখতে যে রকম শিউরে উঠেছিলাম, তেমনটা আর কোথাও হয়েছে বলে মনে পড়ে না। ৭২ থেকে ৮০ সাধারণাব্দ, ১৯৪১ বছর আগে, সম্রাট ভেসপাসিয়ান আর সম্রাট টাইটুসের রাজত্বে তৈরি বিশ্বের বৃহত্তম এই অ্যাম্পিথিয়েটার ছিল রোমান সম্ভ্রান্তদের ক্রীড়া-বিনোদনের মহাআখড়া। আশি হাজার দর্শক এক সঙ্গে বসতে পারতেন এই স্টেডিয়ামে। আর তুমুল হট্টগোল, চিৎকার, সিটি, হাততালির মধ্যে কখনও চলত দুই গ্ল্যাডিয়েটরের মধ্যে সশস্ত্র লড়াই, কখনও যাত্রাপালা, কখনও বন্য পশুর সঙ্গে নিরস্ত্র অপরাধীর মরণপণ যুদ্ধ।
সেই সুড়ঙ্গগুলো এখনও আছে যার মধ্যে দিয়ে পশুরা বেরিয়ে এসে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত নিরস্ত্র, উলঙ্গ লোকগুলোকে ছিঁড়েকুড়ে মারত ৬০-৬৫ হাজার দর্শকের তুমুল হাততালির মাঝে। কিংবা বর্মে-বল্লমে সজ্জিত গ্ল্যাডিয়েটর আর সিংহরা কোনও এক পক্ষ না-মরা পর্যন্ত একে-অপরকে রক্তাক্ত করতে দেখাটাই ছিল সম্ভ্রান্তদের চূড়ান্ত বিনোদন।
এই কলোসিয়ামে, কথিত আছে, টানা ১২৩ দিন ধরে এমনই এক রক্তাক্ত মহাবিনোদনের আয়োজন করেন সম্রাট ট্রেজান, ডেসিয়া রাজ্য (বর্তমান রোমানিয়া, মলডোভা, বুলগারিয়া অঞ্চল) জয়ের আনন্দে। সেটা ১০৭ সাধারণাব্দ। এই সব রক্তাক্ত আনন্দোৎসবের ইতিহাস বেশ বিশদে দেখতে পারেন এখানে—
এর ঠিক ছ’ বছর পরেই সম্রাট ট্রেজান ছকে ফেলেন তাঁর জীবনের শেষ যুদ্ধাভিযান—চলো পার্থিয়া। এই যে ‘চলো পার্থিয়া’, মানে আজকের ইরান, তার সঙ্গে আমাদের কুক্কুটী পারসিকের সম্পর্ক কী জানতে হলে পড়ে নিতে হবে এ কিস্সার শেষটুকু। আগামিকাল।
আরও পড়ুন- Roman Food Recipe Part I: খানা খানদানি-পর্ব ০১, আপেল সহযোগে বরাহমাংস
আরও পড়ুন- Roman Food Recipe Part II: খানা খানদানি-পর্ব ০২, আপেল সহযোগে বরাহমাংস
খানা-খানদানি প্রকাশিত হবে প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে শনিবার-রবিবার