Motorcycle Ride: মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়: চতুর্থ পর্ব, কলকাতা থেকে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের কোলে বগুড়ান জলপাই

Baguran Jalpai: একটি অবিকৃত এবং অদ্ভুত সুন্দর সমুদ্র সৈকত হল বগুড়ান জলপাই—যা কলকাতা থেকে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের কোলে একটি শান্ত সমুদ্র সৈকত। এই সমুদ্র সৈকত সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সোনালি মহীয়সী রঙে নিজেকে ঢেকে রাখে।

Motorcycle Ride: মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়: চতুর্থ পর্ব, কলকাতা থেকে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের কোলে বগুড়ান জলপাই
মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়: চতুর্থ পর্ব, কলকাতা থেকে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের কোলে বগুড়ান জলপাই
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: May 29, 2023 | 9:30 AM

এ পৃথিবীতে আমরা যা কিছুই দেখি তা সবই নিজের নিয়মে পরিবর্তনশীল। গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, জীবজগৎ, এমনকী পরমাণু স্কেলেও এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। শুধু একই রকম থেকে যায় এ বিশাল সমুদ্রের জলরাশি, যা অনবরত ঢেউয়ের মাধ্যমে বলে যায়, ‘আমি আছি, থাকব এ পৃথিবীর সময়ে’। তাই আজ চলুন আমার সঙ্গে, বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ি সমুদ্রের উদ্দেশ্যে, একটু জনমানবহীন স্থান যেখানে সমুদ্রের সঙ্গে এখনও অনন্ত কথোপথনে লিপ্ত হওয়া যায়। এমন একটি সমুদ্র সৈকত যাতে সামুদ্রিক কচ্ছপ, সমুদ্রের ঢেউয়ে আসা অসংখ্য শামুক ও ঝিনুক, লক্ষ-লক্ষ লাল কাঁকড়া শব্দ, ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া সমুদ্রের হাওয়ার শব্দ… একটি অবিকৃত এবং অদ্ভুত সুন্দর সমুদ্র সৈকত হল বগুড়ান জলপাই—যা কলকাতা থেকে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের কোলে একটি শান্ত সমুদ্র সৈকত। এই সমুদ্র সৈকত সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সোনালি মহীয়সী রঙে নিজেকে ঢেকে রাখে। এখানের এই চমৎকার সময় উপভোগ করার কৌশলটি হল খালি পায়ে হাঁটা। আপনার ফেলে আসা সেই পায়ের ছাপে সূর্যের সোনালি আলো পড়ে অদ্ভুত ক্যানভাস তৈরি করে, সেই ক্যানভাস আবার মুছে দিয়ে যায় সমুদ্রের জল। এখানে এসে প্রথমে গন্তব্যস্থলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতল হাওয়া আর আপনার সামনে শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করুন। আর এখানকার মানুষ ভীষণই বন্ধুত্বপূর্ণ। সকাল, সন্ধ্যা এরা সমুদ্রের মাঝে মাছ ধরতে যায়। আপনি চাইলে তাদের কাছ থেকে মাছ কিনতেও পারেন। এছাড়াও আপনাকে মুগ্ধ করবে আশপাশের পরিবেশ যেমন সোলা ফিশিং পিয়ের, পিচাবনি নদীর সমুদ্রের মিলনস্থল, আর বানকিপুট সি বিচ থেকে শঙ্করপুর সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত বাইক চালানোর অভিজ্ঞতা।

বেশি কিছু না নিয়ে শুধু দু’দিনের ব্যবহারের জিনিসপত্র, তাঁবু খাটানোর সরঞ্জাম, বাইকের শাড়িগার্ডের সঙ্গে বেঁধে, কিছু শুকনো খাবার, জলের বোতল আর বাইকের কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন বগুড়ান জলপাইয়ের উদ্দেশ্যে। সকাল ছটার মধ্যে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে আসুন কোলাঘাটের শের-ই-পঞ্জাব হোটেল, যার দূরত্ব কলকাতা থেকে ৭০ কিলোমিটার। এই হোটেলে আসতে মোটামুটি আপনার এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট সময় লেগে যাবে। তারপর এখানে ব্রেকফাস্ট অথবা এখানকার এক গ্লাস চা খেয়ে সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়ুন নন্দকুমার হয়ে কাঁথির উদ্দেশ্যে, যার দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। কোলাঘাট থেকে সোনাপেত্যা টোল প্লাজা হয়ে নন্দকুমার পর্যন্ত কোলাঘাট হলদিয়া এনএইচ ১১৬ রাস্তা খুব ভাল। নন্দকুমার সার্কেল পার্ক থেকে ডান দিক নিয়ে সোজা চলে আসুন কন্টাই নন্দকুমার রোড ধরে কাঁথিতে। এই পঞ্চাশ কিলোমিটার রাস্তা পেরোতে আপনার মোটামুটি দু’ঘন্টা লেগে যাবে, তার কারণ এখানকার রাস্তা। ছোট-ছোট গ্রামের মধ্যে দিয়ে এই এক লেনের রাস্তা একটু বেশি জ্যামজটপূর্ণ। আর বাইক একটু সাবধানেই চালাবেন, কারণ এখানে বাস এবং বাণিজ্যিক গাড়ির মধ্যে রেষারেষি লেগে থাকে প্রায়শই। এরপর আপনি চলে আসুন কাঁথি থেকে বাঁ দিক নিয়ে কপালকুণ্ডলা মন্দির হয়ে বানকিপুট সমুদ্র সৈকতে, যার দূরত্ব আরও ১৫ কিলোমিটার। বানকিপুট সমুদ্র সৈকত আসার আগে কপালকুণ্ডলা কালী মন্দির দেখতে ভুলবেন না। কপালকুণ্ডলা মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “কপালকুণ্ডলা” উপন্যাসে। সেই বর্ণনা অনুসারে জানা যায়, এখানে কাপালিকরা তন্ত্রসাধনার জন্য নরবলি দিতেন। এই মন্দিরটি দীর্ঘকাল জীর্ণ ভগ্নপ্রায় অবস্থায় ছিল। এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবিতে ২০০৯ সালে এই মন্দিরের সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়।

বানকিপুট সমুদ্র সৈকতে যখন পৌঁছবেন, ততক্ষণে সূর্য মধ্যগগনে। দৌলতপুর থেকে বানকিপুট সমুদ্র সৈকতে আসার রাস্তায় আপনি পাবেন একাধিক অ্যাকোয়াকালচার ফর্ম, রাস্তার দু’পাশে জঙ্গল আর ঝাউগাছের সমাহার। এই সমুদ্র সৈকতের বিশেষ আকর্ষণ হল এখানকার পরিবেশ, গাছপালা, জনমানবহীন এলাকা, বিশাল সাগরের ঢেউ আর উত্তপ্ত বালুরাশি। এখানকার সবুজ বুনো অঞ্চলের প্রতিচ্ছবি আর বিশাল নীল আকাশের ছবি বালিতে পড়ে প্রতিফলিত হয়। ছবি তোলার জন্য এ এক আদর্শ জায়গা। এখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে সি ডিকে রোড ধরে চলে আসুন জুনপুট সমুদ্র সৈকতে। আসার সময় এই রাস্তায় অনেক খাবারের দোকান পাবেন, তাই দুপুরের খাওয়া এখানেই সেরে নিতে পারেন। দুপুরের খাবারের মধ্যে নানা ধরনের মাছের সঙ্গে পাবেন কাঁকড়া, দেশি মুরগির মাংস ইত্যাদি।

একটা মজার বিষয় হল জুনপুট সমুদ্র সৈকত থেকে হরিপুট হয়ে বগুড়ান জলপাই সমুদ্র সৈকতে আসতে পারেন সমুদ্রের উপর দিয়ে বাইক চালিয়ে। এখানকার সমুদ্রসৈকত এতটাই চওড়া এবং শক্ত বালুরাশির কারণে আপনার সমুদ্রের পাড় থেকে বাইক চালাতে কোনও অসুবিধা হবে না। হরিপুর সি বিচে সকাল এবং সন্ধ্যেয় মাঝিরা সমুদ্র থেকে মাছ ধরে নিয়ে আসে এবং এখানেই বিক্রি করে থাকে। তার ফলে আপনি এখানে মাছ কিনেও রান্না করতে পারেন। যাই হোক, এই তিনটি সমুদ্র সৈকত ভাল করে দেখে ঘুরে সময় কাটিয়ে তাঁবু খাটানোর জায়গা ঠিক করলাম বগুড়ান জলপাইয়ে। যেই রাস্তাটা সোজা বগুড়ান জলপাইয়ের গ্রামে ঢুকছে, সেই রাস্তার পাশেই আমরা তাঁবু খাটালাম (আমরা মানে আমি এবং আমার স্ত্রী)। এখানে অনেকের মাথায় ভয়ের প্রশ্ন আসতে পারে, সমুদ্রের ধারে জঙ্গলের মাঝে টেন্ট খাটিয়ে থাকা কি আদৌ নিরাপদ? আমরা যখন কোস্টাল ট্র্যাক করি, তখন ১৫ থেকে ৩০ দিন এভাবেই সমুদ্রের পাড়ে হেঁটে বেড়াই… এখনও পর্যন্ত কোনওই বিপদ হয়নি। আপনি যেখানে তাঁবু খাটাবেন তার আশেপাশের মানুষের সঙ্গে একবার কথা বলে নেবেন। তাঁদের কাছ থেকে জিনিসপত্র কিনবেন। তাঁদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করবেন। কোনও সমস্যা হবে না বলেই বিশ্বাস। হোটেলে না থেকে প্রকৃতির মাঝে থাকার মজাই আলাদা। প্রকৃতি থেকে আপনি সবকিছুই নিতে পারবেন।

জঙ্গলের মাঝে এক ছোট খোলা প্রান্তরে সবুজ ঘাসের উপর তাবু খাটালাম। রাতের খাবার একটা হোটেলে বলে দিলাম। বগুড়ান জলপাইয়ের অপরূপ শোভা দেখলাম সন্ধ্যেবেলায়, সমুদ্র সৈকত লাল হয়ে আছে লাল কাঁকড়ায়। আমরা কিছুক্ষণ সেই কাঁকড়াদের সঙ্গে খেলা করলাম। আমাদের পায়ের শব্দের কাঁকড়া গুলো বালির তলায় ঢুকে যাচ্ছে আবার কখনো বেরিয়ে আসছে। প্রকৃতির রং লাল থেকে ধীরে ধীরে কালো হয়ে আসছে আর জানিয়ে দিচ্ছে রাত্রি হয়ে এসেছে। শুধু শোনা যাচ্ছে চারিদিকে শো শো করা বাতাসের শব্দ আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক।

তাবুতে ফেরার পথে কিছু শুকনো কাঠ জোগাড় করে নিয়ে আসলাম আগুন জ্বালাবো বলে। তাঁবুর পাশে একটি হামক দুটি ঝাউ গাছের সাথে বেঁধে নিলাম। তারপর আগুন জ্বালিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করলাম যখন রাত আটটা বাজে তখন ঠিক করলাম হোটেলে গিয়ে খেয়ে আসা দরকার কারণ এখানের সবাই তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয়। তারপর আগুন নিভিয়ে হোটেলে গিয়ে রাতের খাবার শেষ করে যখন আবার সমুদ্র সৈকতে ফিরলাম, তখন সমুদ্রের অপরূপ দৃশ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। দেখলাম আকাশ হাজারো তারায় ভরা আর সমুদ্রে ছোট-ছোট নৌকায় জ্বলছে লাল বাতি, সমুদ্রের সেই কালো জল আছড়ে পড়ছে পাড়ে… আর জন্ম নিচ্ছে সাদা ফেনা। আর আমাদের সেই পাশের জঙ্গলে হাজারো জোনাকির আলো এবং ঝিঁঝি পোকা ডেকে যাচ্ছে অনবরত। আমি কতক্ষণ যে আকাশের দিকে চেয়েছিলাম, তা নিজেও জানি না। মাঝে তো আবার বালির মাঝখানেই আমরা দু’জনে বসে পড়লাম।

রাত তখন দশটা বাজে। ঠিক করলাম এবার আমাদের ঘুমোতে যেতে হবে। এই প্রকৃতির মাঝে বসে থেকে সারা দিনের ক্লান্তি কখন যে দূর হয়ে গিয়েছে, তা টেরও পাইনি। জানি না বাড়ির খবর, তার কারণ একবারও ফোন করা হয়নি। তাই বাড়িতে ফোন করে আমরা আমাদের টেন্টে চলে আসলাম। বালির উপরে প্রথমে পাতা হয়েছে একটা ত্রিপল। তার উপরে আমাদের টেন্ট খাটানো হয়েছে। টেন্টের মধ্যে পাতলা ম্যাট আর একটা বিছানার চাদর। আর একটা কথা বলা দরকার, রাতের আগুন ধরিয়ে কিংবা খাবার দাবার টেন্টের চারপাশে ফেলবেন না। কারণ তাতে শিয়াল কিংবা কুকুর আপনার টেন্টে সেই খাবারের গন্ধে চলে আসে। এর ফলে কোন সমস্যা হতে পারে। তাই খাবারের বাকি অংশ ২০০ থেকে ৩০০ মিটার দূরে ফেলাই উচিত।

ভোরের পাখির ডাকে ঘুম ভেঙে সমুদ্রের পাশে গিয়ে বসে সূর্যোদয়ের অদ্ভুত দৃশ্য উপভোগ করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারপাশের ঠান্ডা বাতাস কেমন যেন একটু উত্তপ্ত হয়ে উলো। দূরে কোথাও শোনা যাচ্ছে মানুষের শব্দ। রাতে জোয়ারের কারণে সমুদ্র সৈকতে পড়ে আছে হাজার-হাজার ঝিনুক ও শামুক। লাল কাঁকড়াদেরও ঘুম ভেঙে গিয়েছে। তারাও তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রোদ পোহাচ্ছে। কিছুক্ষণ সমুদ্রের পাড়ে সময় কাটিয়ে চলে গেলাম আমাদের টেন্টের কাছে। টেন্ট গুছিয়ে নিয়ে গাড়িতে জিনিসপত্র বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম সোলা ফিসিং পিয়ের-এর কাছে। এটি একটি কৃত্রিম বন্দর, যেখানে নদীতে খাল কেটে ক্যানাল বানিয়ে নদীর জল কাঁথি শহরে ঢোকানো হয় এবং তাতে চাষাবাদ করা হয়। এখানে বড়-বড় মাছ ধরার নৌকাগুলো জোয়ারের সময় সমুদ্রে চলে যায়, সারাদিন সমুদ্রে মাছ ধরার পর্ব শেষে আবার যখন জোয়ার হয়, তখন তারা এই ক্যানালে প্রবেশ করে। ভাঁটায় এই ক্যানালে খুব কম জল থাকে। শুধু নদীর জলই ঢোকে। বগুড়ান জলপাইয়ের কাছে পিচাবনী নদী সাগরে মিশেছে, আর এই মিলনস্থলেই গড়ে উঠেছে সোলা ফিশিং পিয়ার।

তারপর আমরা এখান থেকে শৌলা ব্রিজ ধরে চলে এলাম ইচ্ছেডানা বিচ ক্যাম্প হয়ে মন্দারমনি সি বিচে। এই ইচ্ছেডানা সমুদ্র সৈকত অপূর্ব সুন্দর এবং কিছুটা ম্যানমেড। এই বিচে অসংখ্য তাঁবু ভাড়া পাওয়া যায়, যার মূল্য মাথাপিছু হাজার টাকা থেকে শুরু। চাইলে এখানে কিংবা মন্দারমণিতে গিয়ে আপনি সকালের খাবার খেয়ে নিতে পারেন। তারপর মন্দারমণিতে সময় কাটিয়ে চাওলখলা হয়ে কাঁথি থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিন, যার দূরত্ব ১৭০ কিলোমিটার। তা-ও মোটামুটি সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লেগে যাবে।

এই রুট প্ল্যানটি আপনি বর্ষাকাল ছাড়া যে কোনও সময় করতে পারেন, গরমের সময় দিনের বেলায় একটু গরম লাগলেও বিকেলের পর থেকে আবহাওয়া খুব সুন্দর থাকে।