Motorcycle Ride: মোটরসাইকেল ডায়েরিজ: পর্ব ২৭–চার দিন ও তিন রাতের জন্য পুরুলিয়া জুড়ে রোমাঞ্চকর ভ্রমণ

Purulia: যাঁরা জঙ্গল এবং পাহাড়ে উঠতে ভালবাসেন, তাদের জন্য এই জায়গাটি সত্যিই ভাল লাগবে। এই আশ্রম থেকে পাহাড়ে উঠতে পারেন, পাহাড়ের উপরে আছে মোক্ষ্ধাম বাবার মন্দির। এই মন্দির থেকে গোটা বেলপাহাড়িকে সত্যিই খুব সুন্দর দেখায়।

Motorcycle Ride: মোটরসাইকেল ডায়েরিজ: পর্ব ২৭–চার দিন ও তিন রাতের জন্য পুরুলিয়া জুড়ে রোমাঞ্চকর ভ্রমণ
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Nov 19, 2023 | 9:55 AM

কাটোয়ার কার্তিক লড়াই দেখে প্রায় ভুলেই গেছিলাম যে বাইক ডাইরির এই পর্বের লেখাটা লিখতে হবে। কাটোয়ায় যাব বলে আগেই এই পর্বের লেখা কিছুটা যদিও হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু শেষ হয়নি। তাই তাড়াহুড়ো করে আজ রবিবার লেখাটা শেষ করলাম। যদি কেউ দেখে না-থাকেন, তবে জীবনে একবার হলেও কার্তিক পুজোর পরের দু’দিন কাটোয়া এবং দাঁইহাটের কার্তিক লড়াই দেখতে ভুলবেন না। এই পর্ব এবং আগামী পর্বে পুরুলিয়ার বেশ কিছু স্থানের বাইকের অবিশ্বাস্য এবং রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলব।

চলুন তবে… আর দেরি না করে চার দিন এবং তিন রাতের জন্য বেরিয়ে পড়ি এই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। পুরুলিয়ার এই চার দিনের ট্যুর প্ল্যানে আমাদের সঙ্গে ছিল চারদিনের জামা কাপড়, শুকনো খাবার, এক লিটার করে দু’টো জলের বোতল এবং ওআরএস। আর কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের সঙ্গে ছিল মশা দূরে রাখার ক্রিম, বাইকের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সঙ্গে ইলেকট্রনিক হাওয়া দেওয়ার মেশিন, ক্যামেরা। আর অবশ্যই আমার প্রিয় মোটরসাইকেল। এই তিন রাতের প্ল্যানে আমরা হোটেলে থাকব না, তাই আমাদের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে দু’টি টেন্ট। এই জায়গায় যাওয়ার আদর্শ সময় হল অক্টোবর থেকে মার্চ মাস। এর পরে এখানে বর্ষাকাল শুরু হয়ে যাওয়াতে আবার তার সৌন্দর্য আলাদা। কিন্তু বেলপাহাড়ি, ঝিলিমিলি গ্রামের সৌন্দর্য থাকে দেখার মতো। আমি বলব ভারতের যে কোনও জায়গায় ভিউ শীতকাল এবং বর্ষাকালে আলাদা-আলাদা থাকায় দুই সময়ের দুই ধরনের বৈচিত্র দেখা খুবই দরকার।

সকালে একটু তাড়াতাড়ি উঠে প্রতিদিনের নিয়মিত কাজকর্ম সেরে ৬টা নাগাদ বাইক স্টার্ট দিলাম। বাকি দু’জনের সঙ্গে দেখা করার জায়গা ছিল কোলাঘাট। গতকাল রাতেই বাইকের তেল ভরে নিয়েছিলাম এবং সেই সঙ্গে হাওয়া চেক করে নিয়েছিলাম। তাই আজ সকালে কোথাও না দাঁড়িয়ে সোজা চলে এলাম মুম্বই-কলকাতা হাইওয়ে ধরে কোলাঘাট হয়ে মেদিনীপুর, যার দূরত্ব কলকাতা থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার। পৌঁছতে সময় লাগল প্রায় ২ ঘণ্টা। তাই আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি বেলপাহাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। যার দূরত্ব আরও ৭০ কিলোমিটার। সকাল সাড়ে ন’টার সময় আমরা এখানেই ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম।

তারপর আর সময় নষ্ট না-করে পৌঁছে গেলাম আজকের দিনের প্রথম স্পট, যার নাম তারাফেনি নদী এবং তার ড্যাম (বাঁধ)। তারাফেনি নদীর ওপর গড়ে ওঠা এই জলাধারের সৌন্দর্য সত্যিই অসাধারণ। এখানে আপনি বোর্ডিংও করতে পারবেন। চারিপাশে ছোট-ছোট পাহাড়ের এবং জঙ্গলের কোলে গড়ে ওঠা এই নদীর ভূপ্রকৃতির বৈচিত্র খুবই সুন্দর। এরই কিছুটা দূরে নদীর উপরেই তৈরি হয়েছে ছোট্ট একটি জলপ্রপাত। যার নাম ঘাগরা জলপ্রপাত। এখানে আমরা অনেকটা সময় কাটিয়ে এবং অনেক ছবি তুলে বাইক নিয়ে পৌঁছে গেলাম বেলপাহাড়ি এলিফ্যান্ট করিডরের মধ্যে অবস্থিত খান্দারানি জলাধারে। যার দূরত্ব মাত্র ১৬ কিলোমিটার। এখানে জঙ্গলকে উপভোগ করার জন্য এই লেকের পাশেই আছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। শীতকালে এখানে নানা ধরনের পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে। তারপর এই জলাধারের সৌন্দর্য আরো বেড়ে যায়। এখানে অনেকটা সময় কাটিয়ে আমরা বাইক নিয়েই পৌঁছে গেলাম পাহাড় এবং জঙ্গলের মাঝের রাস্তা দিয়ে গররাসিনি আশ্রমে। পাহাড় এবং জঙ্গলের মাঝে এই রাস্তার বাইক চালানোর অভিজ্ঞতা সত্যিই অবিশ্বাস্য।

যাঁরা জঙ্গল এবং পাহাড়ে উঠতে ভালবাসেন, তাদের জন্য এই জায়গাটি সত্যিই ভাল লাগবে। এই আশ্রম থেকে পাহাড়ে উঠতে পারেন, পাহাড়ের উপরে আছে মোক্ষ্ধাম বাবার মন্দির। এই মন্দির থেকে গোটা বেলপাহাড়িকে সত্যিই খুব সুন্দর দেখায়। যেমন দেখায় কোনও একটি উঁচু পাহাড়ের মাথায় উঠে পুরো ৩৬০° ভিউ দেখার মজা। পাহাড়ে উঠে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার ফলে আমরা ঠিক করলাম ঝিলিমিলিতে গিয়ে তালবেড়িয়া জলাধারে একটু বিশ্রাম নিতে হবে। তাই কথামতো বাইক নিয়ে পলাশ বন হয়ে পৌঁছে গেলাম তালবেড়িয়া জলাধারের কাছে। জলাধারের শান্ত-শীতল পরিবেশে শরীরের ক্লান্তি দূর করে এবং ওআরএস আর শুকনো খাবার গ্রহণ করে বাইক স্টার্ট দিয়ে পৌঁছে গেলাম পরবর্তী জায়গায়—পুরুলিয়ার মার্বেল লেকে। যার দূরত্ব মোটামুটি ১০০ কিলোমিটার। এই পথ অতিক্রম করে বড়বাজার, বলরামপুরের ডান দিক নিয়ে পৌঁছে গেলাম অযোধ্যা পাহাড় এবং অরণ্য সংরক্ষণ এরিয়ায়।

স্থানীয়দের মতে, এই মার্বেল লেকটি সম্পূর্ণরূপেই দুর্ঘটনার জেরে তৈরি হয়েছিল। এই অঞ্চলে চতুর্থ বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের সময় অজান্তেই এটি সৃষ্টি হয়। জায়গাটি লাল-সাদা পাললিক শিলা দ্বারা সৃষ্ট এই লোকটি একটি জনপ্রিয় স্পট। নীল আকাশের রং প্রতিফলিত হয়ে এই লেকটি নীল বর্ণ ধারণ করে। তাই এই লেকটিকে ব্লু ড্যাম-ও বলা হয়ে থাকে। এই লেকের শান্ত শীতল জলে স্নান করার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ আলাদা। তারপর আমরা চারজনে মিলে অযোধ্যা হিল রোডের একটি ইকো রিসোর্টে দুপুরের খাওয়া শেষ করে পৌঁছে গেলাম পরবর্তী স্পট—অযোধ্যা আপার ড্যামে।

অযোধ্যা আপার ড্যামের উপরে বিকেলের পড়ন্ত রোদে অনেক ছবি তুলে সন্ধের আগেই পৌঁছে গেলাম স্থানীয় এক দাদার বাড়িতে, যার নাম শ্রীপতি সামন্ত। এই দাদার সঙ্গে পরিচয় হয় এর আগের বারে, পুরুলিয়া এসে। এই দাদা ছিল আমাদের লোকাল ট্যুরিস্ট গাইড। তারপর আর কী… সন্ধের পরে ঠিক হল আজ রাতে দেশি মুরগির মাংস খাওয়া হবে। তারপর সেই সময় একটি দোকান থেকে ২টো দেশি মুরগি কেনা হল এবং শ্রীপতিদা আর আমরা মিলেই তাকে ছাড়িয়ে পরিষ্কার করে দাদার ঘরে হল রান্না। বাড়ির সবাই মিলে এবং আমরা একসঙ্গে খেয়ে ঠিক করলাম, আজকে ময়ূর পাহাড়ের উপরেই থাকা হবে। তাই রাত দশটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ২টি টেন্ট, চারটে স্লিপিং ব্যাগ এবং একটি ত্রিপল নিয়ে চললাম পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। দাদার বাড়ি থেকে দশ মিনিট হাঁটার পরে আমরা পৌঁছে গেলাম ময়ূর পাহাড়ের পাদদেশে। এখান থেকে শুরু লো পাহাড়ে ওঠা। প্রায় ২০ থেকে ২৫ মিনিট হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের চূড়ায়। অনেকটাই কষ্ট হল, তার কারণ খাওয়ার পর পাহাড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা আগে কখনও ছিল না। তারপর রাত ১১টায় আমাদের ফোন এবং ট্রেকিং হেডলাইটের সাহায্যে টেন্ট খাটাতে আরও আধ ঘণ্টা সময় কেটে গেল। গত বছর লক্ষ্মীপুজোয় যাওয়ার ফলে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় চারিদিকের জঙ্গলকে অপরূপ মহীয়সী লাগছিল। রাতে পাহাড়ের মাথায় ঝিঁঝিঁপোকার আওয়াজ কম ছিল ঠিকই; কিন্তু পাহাড়ের মাথায় হাওয়ার শোঁ-শোঁ শব্দে ঘুম প্রায় হলই না। দূরে কোথাও শোনা যাচ্ছে লক্ষ্মীপুজোর বাজনার শব্দ। মাঝরাতে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে অপরূপ শোভা দেখে মুগ্ধ হয়ে রইলাম। চাঁদের আলোয় পরিষ্কার খোলা আকাশের নীচে গোটা পৃথিবী যেন সুন্দরী-মহীয়সী।