FIFA World Cup 2022 : মুরগীর খামারে কাজ,কষাইয়ের ছেলে, ভবিষ্যৎ ডিপ্লোম্যাট! ক্রোয়েশিয়ার চার ফুটবলারের অজানা কাহিনি
Croatia: মুরগীর খামারের কাজ এবং ভলিবল, এর মাঝেই বন্দি ছিল জীবন। স্বপ্ন ছিল স্থানীয় ক্লাব হাদুকে কোনওদিন খেলবেন। সেই ক্লাবেরই একনিষ্ঠ সমর্থক পেরিসিচ। সেই স্বপ্ন কোনও দিন পূরণ হয়নি।
দোহা : সাফল্য সকলের নজরে পড়ে। প্রত্যেকের কাছে সাফল্যের অর্থও ভিন্ন। সাফল্য় যতটা নজরে পড়ে, এর নেপথ্য কাহিনি অজানাই থেকে যায়। ক্রোয়েশিয়ার এই চার ফুটবলারের কথাই মনে করুন। টানা দ্বিতীয় বার বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল খেলছে ক্রোয়েশিয়া। গত বারের রানার্স। দ্বিতীয় স্থানাধিকারীদের কেই বা মনে রাখে! ক্রোয়েশিয়াকে রেখেছে। রাশিয়া বিশ্বকাপের শুরুতে লুকা মদ্রিচ একটা মন্তব্য করেছিলেন। বিশ্বকাপের বদলে ক্লাব ফুটবলে জেতা সমস্ত ট্রফি হারাতে হলেও তিনি রাজি। অনেকে হেসেছিলেন, কেউ বা বলেছিলেন- বিশ্বকাপ! সে তো অলীক কল্পনা। সেই ক্রোয়েশিয়াই গ্রুপ পর্বে হারিয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। সেটাই তাদের সেরা সাফল্য তা নয়। ফাইনালেও উঠেছিলেন মদ্রিচরা। অনেকের কাছে মনে হয়েছিল, চমৎকার, ফ্লুক। টানা দ্বিতীয় বার সেমিফাইনালে ওঠার পর ধারনা বদলেছে। এই দল কোনও চমৎকারে নয়, পারফরম্যান্সেই এতটা পথ পেরিয়ে এসেছে। দলের নেপথ্য় কাহিনি থাকে। ফুটবলারেরও তো। যেমন ক্রোয়েশিয়ার এই চার সদস্য়। মুরগীর খামারে কাজ করতেন, একজন হতে চান ডিপ্লোম্যাট। স্থানীয় ভাষা বলতে পারতেন না, আর এক জন কষাইয়ের ছেলে। এখন এগুলো তাদের পরিচয় নয়। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালিস্ট ক্রোয়েশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তাঁরা। তবে নেপথ্য কাহিনি কিংবা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলোই বা কীভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায়! তাঁদের কাহিনিই তুলে ধরল TV9Bangla।
ক্রোয়েশিয়া ডিফেন্সের অন্যতম স্তম্ভ দেজান লভরেন। মাত্র তিন বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে জেনিকা (বসনিয়ার শহর) ছাড়তে হয়। যুদ্ধের পরিস্থিতি এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। জার্মানির মিউনিখ শহরে ঠাঁই নেয় পরিবার। যুদ্ধ এবং তার ক্ষতি বোঝার বয়স হয়নি। শরণার্থী শিবিরই হোক না কেন, মিউনিখ শহর ভালোই লেগেছিল লভরেনের। সাতটা বছর সেই শহরে থাকা, স্কুলে পড়া, স্থানীয় ক্লাবে ফুটবল খেলা, জার্মান ভাষাও নিখুঁত রপ্ত করেছিলেন। তার বয়স তখন ১০, আবারও জীবন বদলে গেল। স্থায়ী ঠিকানা মেলেনি মিউনিখে। জার্মান সরকার বসনিয়ায় তাদের ঠিকানায় (যুদ্ধের পর সেই অংশ ক্রোয়েশিয়ায়) ফেরার নির্দেশ দেয়। লভরেন একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন,স্থানীয় ভাষা ঠিকঠাক না বলতে পারায় জানায় স্কুলে সকলে তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করতেন। লভরেন যা বলতেন, বাকিদের বোধগম্য হত না। কয়েকটা বছর পর সব ঠিকঠাক হয়েছিল। জীবনের শুরুর সেই লড়াই, পাঁচটি দেশের ক্লাবে খেলা, এখন ক্রোয়েশিয়া ওয়ালের গুরুত্বপূর্ণ ইট।
মার্সেলো ব্রোজোভিচ। ক্রোয়েশিয়ার এই মিডফিল্ডার স্কুলছুট। বাবা ছিলেন কষাই। পরিবার চায়নি স্কুলে পাঠাতে। পড়াশোনার পাশাপাশি ফুটবলে ব্যস্ত থাকতেন ব্রোজোভিচ। সেটাই চায়নি পরিবার। স্কুল ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। অনেকের জীবনেই ‘গডফাদার’ বলে একজন উদয় হন। ব্রোজোভিচের জীবনে ক্রোয়েশিয়ার পপ সিঙ্গার নিভেস সেলজিউস যেন তাই। রাতস্কি দ্রাগোভোলাচ ক্লাবের অ্যাকাডেমিতে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন ব্রোজোভিচ। নিভিসের সৌজন্যেই এই সুযোগ তাঁর জীবন বদলে দেয়।
ডমিনিক লিভাকোভিচ, এখন আর অপরিচিত নাম নয়। ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলপ্রেমীদের মনে একটা বড় জায়গা করে নিয়েছেন। বিশ্ব ফুটবলেও। একের পর এক দুরন্ত সেভ, টাইব্রেকারে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে জয়, ক্রোয়েশিয়ার এই গোলরক্ষককে চেনার অনেক কারণ রয়েছে। তাঁর স্বপ্ন শুধুই গোল আগলানো নয়। তাঁর ‘গোল’, কোনও একদিন কুটনীতিবিদ হবেন লিভাকোভিচ। ২৭ বছরের লিভাকোভিচ ছেলেবেলায় বাস্কেটবল খেলতেন। পাশেই ফুটবল ক্লাব। সেখানে অনুশীলন করতেন ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক ড্য়ানিয়েল সুবাসিচও। লিভাকোভিচের বাবা ইঞ্জিনিয়ার, ক্রোয়েশিয়ার প্রাক্তন মন্ত্রী। গ্র্য়ান্ডফাদার ডাক্তার, গ্র্য়ান্ডমাদার ইংলিশ টিচার ছিলেন। এমন পরিবারে পড়াশোনার বিষয়টিকেই প্রাধান্য় দেওয়া হবে, সেটাই স্বাভাবিক। লিভাকোভিচের জীবনে নতুন মোড় নেয় স্থানীয় এক ফুটবল কোচের সৌজন্য়ে। তবে ফুটবল কেরিয়ারের বেশিরভাগ সময় কেটেছে সুবাসিচের ছায়ায়। এই বিশ্বকাপ একান্তই লিভাকোভিচের। এখন আর তাঁর পরিবার এই নিয়ে দুঃখ করে না, ‘কেন বইয়ের বদলে, বল হাতে নিয়েছিলেন’ লিভাকোভিচ।
ক্রোয়েশিয়াতেই শুধু নয়, বিশ্ব ফুটবলে অতি পরিচিত নাম ইভান পেরিসিচ। তার ছেলেবেলা ফুটবলে কাটেনি। তাঁকে টানত ভলিবল। সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে বাস ছিল। বিচ ভলিবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। এতটা সুখোর জীবন ছিল না। বাবা মুরগীর খামার চালাতেন। মুরগীর খামারের কাজ এবং ভলিবল, এর মাঝেই বন্দি ছিল জীবন। স্বপ্ন ছিল স্থানীয় ক্লাব হাদুকে কোনওদিন খেলবেন। সেই ক্লাবেরই একনিষ্ঠ সমর্থক পেরিসিচ। সেই স্বপ্ন কোনও দিন পূরণ হয়নি। হাদুকের অ্যাকাডেমিতে থাকাকালীন তাঁর খেলা দেখে ডাক আসে ফরাসি ক্লাব (দ্বিতীয় ডিভিশন) সোসোউয়ের। পেরিসিচের জন্য বিশেষ বিমান পাঠানো হয়, হাদুক ক্লাবকে ৩৬০০০০ ইউরো দেওয়া হয় পেরিসিচের জন্য়। ১৭ বছরের পেরিসিচ পাড়ি দেন ফ্রান্সে। সেই সিদ্ধান্তও তাঁর ছিল না। বাবা ঋণে জর্জরিত ছিলেন। মুরগীর খামারের ব্যবসায় লোকসানে কার্যত দেওলিয়া হয়েছিলেন। পেরিসিচের জন্য় এত অর্থ পেলে ব্যবসা নতুন করে দাঁড় করানো যাবে, এই আশাতেই ফরাসি ক্লাবে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত।
নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন বাধা পেরিয়ে, ক্রমশ ‘খ্যাতির’ শিখরে তাঁরা। সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছতে এখনও দুটো ম্যাচ জিততেই হবে। বিশ্বকাপ ছাড়া সাফল্য়ের চূড়ায় পৌঁছনো, এক কথায়-অসম্ভব।