Surajit Sengupta: চলে গেলেন ময়দানের ‘শিল্পী’ ফুটবলার সুরজিৎ সেনগুপ্ত

প্রয়াত সুরজিৎ। না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন ভারতের প্রাক্তন ফুটবলার সুরজিৎ সেনগুপ্ত (Surajit Sengupta)।

Surajit Sengupta: চলে গেলেন ময়দানের 'শিল্পী' ফুটবলার সুরজিৎ সেনগুপ্ত
Surajit Sengupta: চলে গেলেন 'শিল্পী' সুরজিৎ সেনগুপ্ত নিজস্ব চিত্র)
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Feb 17, 2022 | 2:50 PM

কলকাতা: ১৯৭৪ সালের বিকেল। ইস্টবেঙ্গল মাঠের গ্যালারি কানায় কানায় ভর্তি। উয়াড়ির বিরুদ্ধে ম্যাচ বলে কথা। লাল-হলুদ জার্সি ঝলসে উঠছে। ম্যাচে মহম্মদ হাবিবের পা থেকে দুটো গোল এসে গিয়েছে। গ্যালারিও তেতে রয়েছে বড়ে মিয়াঁর হ্যাটট্রিক দেখবে বলে। ডান প্রান্ত থেকে বল ধরে উয়াড়ির বক্সে উঠে এসেছে ছেলেটা। বিপক্ষের কিপারও নড়বড় করছেন। যে কোনও সময় গোল করে ফেলবে তরুণ ফুটবলার। কী আশ্চর্য, সুযোগ পেয়েও সে পা বাড়িয়ে দিল হাবিবকে। ভুল করলেন না হাবিব। নিমেষে হ্যাটট্রিক করে ফেললেন।

ম্যাচটা প্রাধান্য নিয়েই জিতল ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু হাবিব বিরক্ত। ড্রেসিংরুমে পা দিয়েই খোঁজ করলেন নতুন ছেলেটার। মোহনবাগানের হয়ে গত মরসুমে সে ভালোই খেলেছিল। লাল-হলুদ জার্সিতে আরও ভালো খেলবে। তাই বলে নিজে গোল না করে হাবিবকে বল বাড়াবে!

ছেলেটা এসে দাঁড়াতে হাবিব গম্ভীর গলায় বললেন, ‘নিজে গোল না করে আমাকে পাস বাড়ালে কেন? হাবিবের কথা তোমায় ভাবতে হবে না। এমন সিচ্যুয়েশন এলে আগে নিজে গোল করো।’

ওই ছেলের বাঁ পা কথা বলে। দুরন্ত সব পাস বাড়ান। তার থেকেও বড় কথা হল তিনি ‘টিমম্যান’। ১৯৭৪ সাল থেকে টানা পাঁচটা মরসুম ইস্টবেঙ্গলেই খেললেন। লাল-হলুদ জার্সিতেই বল প্লেয়ার হয়ে ওঠা। সেখান থেকেই ময়দানের শিল্পী। সারা ভারতে যত টুর্নামেন্ট খেলতে যান, ক্লাবকে সাফল্য দেন। মহম্মদ হাবিব, শ্যাম থামা, সুভাষ ভৌমিকদের পাশে তিনিও হয়ে উঠেছেন তারকা। দলবদলের অন্যতম আকর্ষণ।

সাতের দশকের সেই শিল্পী ফুটবলার সুরজিৎ সেনগুপ্ত (Surajit Sengupta) চলে গেলেন। কোভিড (COVID 19) আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে। প্রয়াত হলেন ৭০ বছরের ফুটবলার।

চুঁচুড়ার জন্ম সুরজিতের। হুগলি জেলার ফুটবল থেকে উঠে আসা তাঁর। অশ্বিনী বরাট ছিলেন তাঁর কোচ। তিনিই কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন সুরজিৎকে। কলকাতা লিগের লোয়ার ডিভিশন ক্লাব রবার্ট হাডসন প্রথম সই করেন। ১৯৭০ সালে সেখান থেকে খিদিরপুরে যান বাঙালি উইঙ্গার। ওই বছর খিদিরপুর ছেড়ে ইস্টবেঙ্গলে চলে যান স্বপন সেনগুপ্ত। তাঁর বদলে সুরজিৎকে নেওয়া হয়। কোচ অচ্যুত্‍ ব্যানার্জির কোচিংই তাঁকে পাল্টে দিয়েছিল। ৭১ সাল পর্যন্ত খিদিরপুরেই খেলেন। ১৯৭২-৭৩ মরসুমে মোহনবাগানে সই করেন। দুটো মরসুম খেলেছিলেন সবুজ মেরুন জার্সিতে। সেখান থেকে ১৯৭৪ সালে পা দেন ইস্টবেঙ্গলে। আর পিছন ফিরে দেখতে হয়নি তাঁকে। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব থেকেই সাফল্যের শিখরে উঠে পড়েন। সাতের দশকের ময়দানে অনেক কারণে সুরজিৎ নায়ক হয়ে উঠেছিলেন। রাইট উইংয়ের প্লেয়ার। কিন্তু লেফট উইংয়েও খেলেছেন। উইং থেকে সতীর্থদের জন্য গোলের ঠিকানা লেখা পাস বাড়াতেন। দু’পায়ে জোরাল শট ছিল। উইথ দ্য রান ড্রিবলে ছিলেন পারদর্শী। দর্শনীয় গোলের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। বেশ কয়েকবার কর্নার থেকেই গোল করেছিলেন। এ সবই তাঁকে শিল্পী করে তুলেছিল।

১৯৮০ সাল সুরজিৎ সেনগুপ্তের কেরিয়ারে তো বটেই, ময়দানের ফুটবলেও এক যুগন্তকারী সময়। সুরজিতের নেতৃত্বে একঝাঁক ফুটবলার দুই প্রধান ছেড়ে মহমেডানে সই করেন। শুধু বিপ্লব করাই নয়, সুরজিৎরা ওই বছর মহমেডানকে কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়নও করেছিলেন। যা এখনও ভোলেননি ময়দানের প্রবীণরা। ১৯৮১ সালে আবার মোহনবাগানে ফেরেন। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত খেলার পর অবসর নিয়ে নেন। দু’বছর পর আবার অবসর ভেঙে ফেরেন সুরজিৎ। সে বার জর্জ টেলিগ্রাফের কোচ হয়েছিলেন সুভাষ ভৌমিক। তাঁরই অনুরোধে জর্জে সই করেন। দিন পনেরো আগে সেই সুভাষ মারা গিয়েছেন। তাঁরই এক সময়ের সতীর্থ ও ফুটবলার সুরজিৎও চলে গেলেন।

ফুটবল যেমন নেশা ছিল, পড়াশোনাতেও তেমনই ভালো ছিলেন সুরজিৎ। শুধু তাই নয়, গানবাজনার প্রতিও একই রকম ঝোঁক ছিল তাঁর। ছেলেবেলায় একবার সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে তবলা বাজিয়েছিলেন তিনি। বন্ধুমহলে গানের জন্য বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া থেকে ঐচ্ছিক অবসরের পর, ২০০৩ সালে আজকাল পত্রিকার ‘খেলা’ ম্যাগাজিনের সহযোগী সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন।

কেরিয়ার জুড়ে অসংখ্য চোখধাঁধানো ম্যাচ খেলেছেন সুরজিৎ। ১৯৭৫ সালের শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগানকে ৫ গোলে হারানো ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে প্রথম গোল ছিল তাঁরই। ১৯৭৯ সালে শিল্ডের সেমিফাইনালে থাইল্যান্ড ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে দুরন্ত গোল করেছিলেন। ১৯৭৮ সালে বরদলৈ ট্রফিতে কেরিয়ারের অন্যতম সেরা ম্যাচ খেলেছিলেন। তাঁর অসাধারণ ফুটবলের জোরেই পোর্ট অওথারিটি অফ ব্যাঙ্কককে ৪-২ হারিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। ৭৮ সাল ডুরান্ড কাপ ফাইনালে ৩-০ মোহনবাগানকে হারায় ইস্টবেঙ্গল। ওই ম্যাচে গোল করার পাশাপাশি দুরন্ত খেলেছিলেন। ১৯৭৯ সালে শিল্ডের সেমিতে থাইল্যান্ড ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গল ০-১ হারছে। হঠাত্‍ তাঁর বাঁক খাওয়া শটে গোল পেয়ে যায় লাল-হলুদ। ১৯৭৫ সালে ভেটেরেন্স ক্লাবের বিচারে বর্ষসেরা ফুটবলার হয়েছিলেন সুরজিৎ। ১৯৭৪ সালে এশিয়ান গেমসে জাতীয় টিমে অভিষেক। ১৯৭৯ পর্যন্ত টানা ভারতীয় টিমে খেলেছেন।

১৯৭২ থেকে টানা ১৯৭৯ পর্যন্ত বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফিতে খেলেছেন। ১৯৭৬ সালে সন্তোষজয়ী বাংলার ক্যাপ্টেনও ছিলেন। ১৯৭৫ সালে কর্নাটকের বিরুদ্ধে ফাইনালের সেরা হয়েছিলেন সুরজিত্‍। ৭৮ সালে পঞ্জাবের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচ ড্র হয়। দ্বিতীয় ম্যাচে নামার আগে পিকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘দৌড়াও, তোমার দৌড়কে ভয় পায় ওরা।’ ফিরতি ম্যাচে ৩-১ জয়। গোল করে বার পোস্ট ধরে ঝুলে পড়ার ছবি তখন যুগান্তরে ছাপা হয়েছিল।

সুরজিতের প্রয়াণে ফুটবলমহলে শোকের ছায়া। সুরজিতের খেলা দেখেছেন, এমন ময়দানি সমর্থকদের চোখে ভাসছে সাতের দশকের শিল্পী উইঙ্গার।