Kolkata Derby Retro Story: “বড় ম্যাচের আগের দিন থেকে কথা বলা বন্ধ করে দিতাম”
এখন তো ইস্টবেঙ্গল-মহমেডান কিংবা মোহনবাগান-মহমেডানকে মিনি ডার্বি বলে সবাই। আমাদের সময় সেই ম্যাচগুলোও বড় ম্যাচ হিসেবেই দেখা হত।
ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস সেই কবে থেকে ময়দানের জার্সি পরে বসে রয়েছে। নতুন শতাব্দীতে পা দিয়েও ময়দান ঘিরেই পায়ে পায়ে এগিয়ে রয়েছে ইতিহাস। কত গল্প উপহার দিয়েছে এই ময়দান। আরও ভালো করে বলতে গেলে, কলকাতা ডার্বি ঘিরে কত উত্তেজনা, কত উত্তাপ। তিন বছর পর আবার ডার্বি (Kolkata Derby) ফিরছে কলকাতায়। সেই চিরকালীন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান (East Bengal vs Mohun Bagan) ডার্বির নানা গল্প নিয়েই TV9 Bangla -র এই ধারাবাহিক— ডার্বির হারিয়ে যাওয়া গল্প। আজ অতীতে ফিরলেন অলোক মুখোপাধ্যায়।
এখন তো ইস্টবেঙ্গল-মহমেডান কিংবা মোহনবাগান-মহমেডানকে মিনি ডার্বি বলে সবাই। আমাদের সময় সেই ম্যাচগুলোও বড় ম্যাচ হিসেবেই দেখা হত। আমার প্রথম বড় ম্যাচ খেলা মহমেডান জার্সিতেই। ১৯৮১ সালে সাদা-কালো জার্সি গায়ে চাপিয়ে ছিলাম। আর ওই বছরই আমরা কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হই। সাদা-কালো জার্সিতে ভালো না খেললে ময়দানে কোনওদিন প্রতিষ্ঠাই পেতাম না। মহমেডানে খেলার সুবাদেই পরের বছর ইস্টবেঙ্গলে ডাক পাই। ওই বছর ক্রীড়া সাংবাদিকদের বিচারে বর্ষসেরা ফুটবলারের সম্মান পেয়েছিলাম। আমার বড় ম্যাচ শুধু ফুটবলার জীবনেই থেমে থাকেনি। কোচিং জীবনেও অনেক বড় ম্যাচের সাক্ষী থেকেছি। কলকাতার তিন প্রধানে কোচিং করিয়েছি। ফুটবল খেলার সুবাদেই এ সব সম্ভব হয়েছে। বড় ম্যাচের কথা মনে করলেই অনেক কিছু স্মৃতিতে ভেসে ওঠে।
১৯৮২ সালে ইস্টবেঙ্গল জার্সিতে কলকাতা লিগের বড় ম্যাচে খেলতে পারিনি। তখন আমি জাতীয় দলে। সে বার ডুরান্ড কাপেই আমার ডার্বি অভিষেক হল। তাও আবার টুর্নামেন্টের ফাইনাল। জীবনের প্রথম বড় ম্যাচেই সবার মন কেড়ে নিয়েছিলাম। অমলদা (অমল দত্ত) তখন কোচ। ম্যাচের পর আমার প্রশংসা করেছিলেন। ডুরান্ড ফাইনাল অমীমাংসিত ভাবে শেষ হওয়ায় যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। আমি জানতাম, এই বড় ম্যাচের দিকেই সবাই তাকিয়ে থাকে। তাই কখনও ঘাবড়ে যাইনি। অন্য ম্যাচে যতই ভালো খেলি, ডার্বিতে পারফর্ম করতে না পারলে কখনই বড় আসনে ঠাঁই পাব না। নিজেকে প্রমাণের তাগিদেই বড় ম্যাচে মাঠে নেমেছিলাম। মোহনবাগান তখন শক্তিশালী দল ছিল। ‘৮২-র ডুরান্ড ফাইনালই ছিল আমার প্রথম অগ্নিপরীক্ষা।
‘৮৪-র বড় ম্যাচের স্মৃতি কোনওদিন ভুলব না। ইডেন গার্ডেন্সে লিগের ডার্বি ঘিরে সে বার তুমুল উত্তেজনা। সে দিন আমি ম্যাচের আগেই কিছুটা অসুস্থ বোধ করছিলাম। তাও মাঠে নামি। খেলার ৭ মিনিটে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হই। আলসারের জন্য রক্তক্ষরণ হতে থাকে। ম্যাচের মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমাকে আরজি কর হাসপাতালে প্রথমে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখান থেকে পরে নিয়ে যাওয়া হয় এক বেসরকারি হাসপাতালে। আমি জানতামও না সেই ডার্বিটা আমরা হেরে গিয়েছিলাম। মাঠে ফেরাই সংশয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফুটবল কেরিয়ার নিয়ে তৈরি হয়েছিল প্রশ্নচিহ্ন। মনের জোরকে হাতিয়ার করেই তিন মাস পর আবার মাঠে ফিরি। আড়াই মাস শুধু সেদ্ধ খাবার খেয়েছিলাম। বিখ্যাত চিকিৎসক জয়ন্ত সেনের তত্ত্বাবধানে ছিলাম। মাঠে ফিরেই তারপর ‘৮৫ সালে ডুরান্ড কাপে খেললাম। ওখান থেকে আবার জাতীয় দলে ডাক পেলাম। নেহরু কাপে গোল করলাম। নাগজি ট্রফির সেমিফাইনালেও গোল করেছিলাম। এ ভাবে যে ফিরে আসতে পারব ভাবিনি।
১৯৮৬ সালে জব্বলপুরে সন্তোষ ট্রফি খেলতে গিয়ে শৈল চট্টোপাধ্যায় আমাকে মোহনবাগানে নিয়ে যান। অমলদাই আমাকে ভীষণ ভাবে চেয়েছিলেন। ডুরান্ড কাপের সেমিফাইনালে ইস্টবেঙ্গলকে ৩-০ হারালাম। অনেক বড় ম্যাচ খেলে প্রশংসিত হলেও, ‘৮৯-র বড় ম্যাচ জীবনের সেরা। ইস্টবেঙ্গল সে বার তুখোড় টিম। লিগের ম্যাচে দু’গোলে জিতলাম। আমার সেন্টার থেকে হেডে প্রথম গোল শিশির ঘোষের। অপর গোল করেছিল প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।
সবারই কিছু না কিছু কুসংস্কার থাকে। আমারও ছিল। বড় ম্যাচের আগের দিন থেকে অন্যদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিতাম। ঘরে একাই থাকতাম। একটা টেনশনও কাজ করত ভেতরে ভেতরে। তবে ভয় পেতাম না। অনেকে ম্যাচের টিকিটের জন্য আবদার করত। বাড়িতে টিকিট দিয়ে বলে দিতাম, তাদের হাতে দিয়ে দিতে। কারও সঙ্গে দেখা করতাম না। যত বছর বড় ম্যাচ খেলেছি, একই কাজ করেছি।
১৯৯৪ সালে শেষ বার ডার্বি খেলি। তখনও আমি মোহনবাগানেই। সে বছরও ক্রীড়া সাংবাদিকদের বিচারে বর্ষসেরা ফুটবলার হয়েছিলাম। বড় ক্লাবের শুরু আর শেষ- দু’বারই এই সম্মান আমার জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি। ‘৯৪ সালে মোহনবাগানে তখন চিবুজোর, বিজয়ন, আনচেরিরা ছিল। ইস্টবেঙ্গলে বাইচুং, কৃষানুর মতো ফুটবলাররা। ওদেরকে ছাপিয়ে বর্ষসেরা হয়েছিলাম। সে বার ডার্বির পর টুটুদা আমার বাড়ি এসে একটা দামি ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন। এগুলোই তো সারাজীবনের সুখস্মৃতি হয়ে থাকবে। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, সুব্রত ভট্টাচার্য, তরুণ দে, সত্যজিৎ ঘোষ সবার পাশেই খেলেছি। অমলদা, প্রদীপদারা শুধু একটাই কথা বলতেন, বাঁ-দিকে অলোক আছে মানে নিশ্চিন্ত। এর চেয়ে বড় সম্মান আর কিই বা হতে পারে!
বাংলার তিন প্রধানে কোচিং করানোও তো গর্বের। ২০০৩ সালে মোহনবাগানের কোচ হই। সে বছর আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে খেতাব জিতেছিলাম। ফুটবলার জীবনে অনেক ট্রফিই জিতেছি। কোচিং জীবনে এই সাফল্যও কোনও অংশে কম নয়। ফুটবলার জীবনের পাশাপাশি কোচিং জীবনও যে অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জের। ফুটবলার জীবনে ভুল করলে তাও শুধরে নেওয়ার সুযোগ থাকবে। কোচিং জীবনে ভুল করলে শোধরানোর সুযোগ খুব কমই পাওয়া যায়। ডার্বি হারলেই চাকরি খোয়ানোর অশনি সংকেত তাড়া করে বেড়াত।
(কৌস্তভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক অনুলিখন)