খানাকুল: এক সময় রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে কাজ করতেন। তারপর ধীরে-ধীরে প্রবেশ রাজনীতিতে। দু’বারের গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান। স্ত্রী উপ-প্রধান। অনেকে ঠাট্টা করে বলেন, ‘হুগলির খানাকুলের চিংড়া গ্রাম পঞ্চায়েত যেন তাঁদের সংসার! কর্তা-গিন্নিই তো পঞ্চায়েত চালান।’ সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজনৈতিক নেতাদের যে সব প্রাসাদোপম বাড়ি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, সেই তালিকায় রয়েছে ওই পঞ্চায়েতের প্রধান কার্তিক ঈশ্বরের বাড়িটিও। সবুজ রঙের তেতলা বাড়ি। সামনে হাজারো রং। লাল, নীল, গোলাপি কী নেই তাতে! যার বাড়ির এত রং, জীবনও যে রঙিন হবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বলছেন, ঈশ্বর ঘনিষ্ঠরাই।
আশপাশে ছোটখাটো কাঁচা-পাকা বাড়ির মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ঈশ্বরের পেল্লাই বাড়িখানি। বিরোধীদের অভিযোগ, খাস জমিতে নাকি তৈরি হয়েছে এই বাড়িটি। যদিও পঞ্চায়েত প্রধান মানতে নারাজ। তাঁর দাবি, চক্রান্ত করছেন বিরোধীরা।
ঈশ্বরের রাজনৈতিক উত্থান
কলকাতায় রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করতেন কার্তিক ঈশ্বর। ২০১১-তে রাজ্যের পালা বদলের পর রাজমিস্ত্রির জোগাড় ছেড়ে সরাসরি রাজনীতিতে নামেন তিনি। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১৩ সালে প্রথম গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান। ২০১৮ তে ফের প্রধানের আসনে তাঁকেই বেছে নেন এলাকাবাসী। শুধু ঈশ্বর নন, ভোটে জিতে উপ-প্রধানের আসনে বসেন তাঁর স্ত্রী নীলিমাও। দীর্ঘ নয় বছর ধরে একটানা প্রধানের চেয়ারে ঈশ্বর।
বাড়ি নিয়ে বিতর্ক
বিরোধীদের অভিযোগ, সরকারি কাজের টাকা তছরুপের ফল তাঁর এই বাড়ি। কোটি টাকা দিয়ে তৈরি হয়েছে। আরও অভিযোগ, সরকারি জমির উপর তৈরি হয়েছে ঈশ্বরে বাড়িটি। বিজেপি বিধায়ক সুশান্ত ঘোষ বলেন, “পঞ্চায়েত প্রধান যে বাড়িটি করেছেন সেটা ওনার নিজের জায়গা নয়। খাস ল্যান্ডকে একশো দিনের জব কার্ড দিয়ে ভরিয়ে…ওখানে সরকারি আবাসন হওয়ার কথা ছিল। সেই জায়গায় নিজস্ব বাড়ি তৈরি করেছেন। বাড়িটির দাম সাত-আট কোটি টাকা তো হবেই। আমরা প্রতিবাদ করলে আমাদের বাড়ি ঘর ভাঙচুর, হুমকি, মারধর চলেছেই। বহুবার পুলিশ দিয়ে অত্যাচার করেছেন।”
শুধু বিরোধীরাই নয়, খোদ দলের লোকজনই ঈশ্বরের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছেন। এক তৃণমূল নেতা বলেন, “যে জায়গায় তাঁর শখের বাড়িটি জলা ভূমি বুজিয়ে তৈরি হয়েছে। ক্ষমতার বলে পুকুর বুজিয়েছেন ঈশ্বর।”
ত্রাণের টাকা তছরুপের অভিযোগ
বন্যা কবলিত অঞ্চল বলেই পরিচিত হুগলির খানাকুল। বর্ষার একটু বৃষ্টিতেই নদী-বাঁধ ভেঙে ছাপিয়ে যায় জল। ভেসে যায় কয়েক হাজার মানুষের বাড়ি। নষ্ট হয়ে যায় ধান জমির ক্ষেত। গতবছরও তার অন্যথা হয়নি। বিঘার পর বিঘা জমি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কপালে হাত পরে অসহায় চাষিদের। এলাকাবাসী বলেছেন, সরকারি ত্রাণের টাকা পঞ্চায়েতে ঢোকে, কিন্তু তা পৌঁছায় না গরিব মানুষগুলোর হাতে। কারণ সেই টাকা নাকি সব ঢোকে এই তৃণমূলে নেতার বাড়িতে। তৃণমূলের আর এক নেতা বললেন, “শুনেছি উনি নাকি বলেছিলেন ত্রাণের টাকা নিয়ে পালিয়ে যাব…”
গ্রাম পঞ্চায়েতের এক তৃণমূল সদস্য বলছেন, “স্বামী স্ত্রীর পঞ্চায়েতে গিয়ে কি লাভ? ওরা নিজেদের মত করে পঞ্চায়েত চালাচ্ছেন। উনি আর ওঁনার স্ত্রী লুটে খাচ্ছে। দলের একটা অংশ ওনাদের ভয়ে কথা বলতে পারছে না। তাঁরা মুখ খুলতে পারছে না। দেদার চুরি হচ্ছে। খানাকুল বন্যা কবলিত এলাকা। চাষিদের এই বার কত ক্ষতি হয়েছে। সমবায়ে তাঁরা লোন আনতে যাচ্ছেন যখন টাকা পাচ্ছেন না। কারা এই টাকা মেরেছে? এগুলো তদন্ত হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। বন্যা ত্রাণের সময় প্রচর মাল-পত্র এসেছে। সেগুলো কোথায় গেল?”
অন্যদিকে এক পঞ্চায়েত সদস্য বলেন, “পঞ্চায়েতে যাব কী, আমাদের ঢুকতেই দেয় না। স্বামী-স্ত্রী প্রধান ও উপপ্রধান। যা ইচ্ছা তাই করছেন। মিটিংয়ে গেলে গালিগালাজ করছেন। আমি যবে থেকে সদস্য হয়েছি আমাদের ঢুকতেই দেয় না। আমি একবারও যাইনি। স্বামী-স্ত্রী চালাচ্ছেন।”
সাংবাদ মাধ্যমের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ নস্যাৎ করে দেন কার্তিক ঈশ্বর। তাঁর সাফ জবাব, “আমার সাত থেকে আট বিঘা জমি আছে। আমার বিরুদ্ধে কোনও দুর্নীতি নেই। আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো হচ্ছে। জানি না কেন করা হচ্ছে।” তাঁর স্ত্রী নীলিমাদেবীকে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয় TV9 বাংলার তরফে। ফোন তোলেননি তিনি।
আরও পড়ুন: Bachchu Hansda: মন্ত্রী হয়েছিলেন একবার, বাচ্চু হাঁসদার বাড়ি দেখলে চমকে যাবেন আপনিও
আরও পড়ুন: Modasser Hossain: ‘কাটা তেলের’ ব্যবসায়ী থেকে পঞ্চায়েত প্রধান, তৃণমূল নেতার ‘লাভ হাউসের’ খরচ জানেন?