ময়নাগুড়ি: রাজ্যে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা। বৃহস্পতিবার ময়নাগুড়ির দোমহানিতে বেলাইন হয়ে যায় বিকানের-গুয়াহাটি এক্সপ্রেস। এই দুর্ঘটনায় এখনও অবধি ৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। নর্থ ফ্রন্টিয়ার রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার আনসুল গুপ্ত এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ইতিমধ্যেই নিহতদের পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। অন্যদিকে শুক্রবারই ঘটনাস্থলে যান রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণ। বৃহস্পতিবার বিশেষ ট্রেনে হাওড়া থেকে ময়নাগুড়িতে পৌঁছন তিনি।
অশ্বিনী বৈষ্ণ বৃহস্পতিবারই জানান, খুবই দুঃখজনক এই ঘটনা। রেল ও অন্যান্যরা যৌথভাবে উদ্ধারকাজ শেষ করেছে। যাঁরা আহত হয়েছেন তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কী কারণে এই ঘটনা ঘটল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত হবে। প্রযুক্তিগত কোনও কারণ হোক বা অপারেশনাল কোনও কারণ, ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় সেদিকে নজর থাকবে।
রেল দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এবার দায়ের হল এফআইআর। এফআইআর দায়ের করলেন উত্তম রায় নামে এক ব্যক্তি । উত্তম রায় ওই ট্রেনের এস-১২ কামরায় ছিলেন । ট্রেনের চালক ব্রেক করেন, আর তাই তিনি ও তার স্ত্রী আহত হন বলে অভিযোগ জানিয়েছেন উত্তম বাবু । অভিযোগকারী উত্তম রায়ের বাড়ি কোচবিহারে ।
উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ির দোমহনীতে বিকানের – গুয়াহাটি এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু হওয়া যাত্রীদের মধ্যে রয়েছেন এক রেলকর্মী। মৃত রেলকর্মীর নাম অজিত প্রসাদ (৩৩), বাড়ি হীরাপুর থানার বার্ণপুরের রাধানগর রোডের তালপুকুরিয়া এলাকায়। ওই রেলকর্মী সহ মোট ৯ জনের দেহ পুলিশ এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছে। ৬ জনের দেহ অসমে যাচ্ছে, ২ জনের দেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোচবিহার জেলায় এবং ওই রেলকর্মীর দেহ যাচ্ছে আসানসোলে।
জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়ির কাছে ট্রেনের দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন প্রাক্তন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেতা রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। আচমকাই তাঁর বুকে যন্ত্রণা শুরু হয়। তরিঘড়ি তাঁকে সেখান থেকে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
ময়নাগুড়ি হাসপাতালে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। রেল দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। এর পাশাপাশি, রাজস্থান সরকারের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের মন্ত্রী গোবিন্দ রাম মেঘওয়াল এবং রাজস্থানের আরও এক মন্ত্রী ভানওয়ার সিং জলপাইগুড়ি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে আহতদের সঙ্গে দেখা করেন।
ময়নাগুড়ির রেল দুর্ঘটনা নিয়ে একাধিক প্রশ্নের উত্থাপন। শীতে রেললাইনে সংকোচন প্রসারণ স্বাভাবিক ঘটনা? গ্যাংমানদের নজরদারি কি ছিল না? গুয়াহাটি বিকানির এক্সপ্রেসের সব বগি নিয়মিত পরীক্ষা হত? কেন ওই ট্রেনে এলএইচবি কোচ লাগানো হয়নি? এই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে রেলমন্ত্রককে। পাশাপাশি রেলের ভূমিকা নিয়েই উঠে আসছে একাধিক প্রশ্ন। রেল ইউনিয়নগুলির কথাতেই উঠে আসছে একাধিক ফাঁক ফোকড়ের কথা। পরিকাঠামো-রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, বেসরকারি সংস্থার হাতে রেলের ট্র্যাক রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব, নিয়োগে ঢিলেমি- রেলের একাধিক ‘অক্ষমতার’ তথ্য উঠে আসছে।
বিস্তারিত পড়ুন: Bikaner-Guwahati Express Accident: ‘লোক নেই, নেই রেলের নিজস্ব কিছুই’, ময়নাগুড়ির ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর প্রশ্নের মুখে রেলের পরিকাঠামো
একটা ঝাঁকুনি অনুভব করেছিলেন। কিন্তু সে মুহূর্তে পিছনের দিকের বগিগুলিতে কী হয়েছে, তা সামনে থেকে তাঁর পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি। বিপদ বুঝে এর্মাজেন্সি ব্রেক কষেছিলেন তিনি। দুর্ঘটনার সময়ের বিবরণ দিলেন বিকানের-গুয়াহাটি এক্সপ্রেসের লোকো পাইলট।
বিস্তারিত পড়ুন: Bikaner-Guwahati Express Accident: ‘একটা প্রবল ঝাঁকুনি, দু’বার ব্রেক কষেছিলাম…’ অভিশপ্ত সেই ট্রেনের লোকো পাইলটের কথায় উঠে এল ঘটনার বিবরণ
জলপাইগুড়ির দোমহানিতে রেল দুর্ঘটনায় এখনও পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। জানিয়েছেন নর্থ ফ্রন্টিয়ার রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার আনসুল গুপ্ত। তিনি এও জানিয়েছেন এখনও পর্যন্ত ৩৬ জন আহতের খোঁজ মিলেছে। তার মধ্যে ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহতদের তিনটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা কমিশনার অফ রেলওয়ে সেফটি তদন্ত করে দেখবে বলে জানিয়েছেন জেনারেল ম্যানেজার আনসুল গুপ্ত।
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, ময়নাগুড়ি নিয়ে সঠিক তদন্ত হওয়া দরকার। আহত ও নিহতদের পরিবারের কাছে দ্রুত যে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া হয় সেই দাবিও তোলেন সুজন চক্রবর্তী।
কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী জন বার্লা শুক্রবার সকালে দোমহানিতে যান। ঘুরে দেখেন দুর্ঘটনাস্থল।
জলপাইগুড়ি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে দুর্ঘটনাগ্রস্তদের ২৮ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এছাড়া উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে রয়েছেন সাতজন এবং ময়নাগুড়িতে সাতজন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। প্রত্যেকেই স্থিতিশীল বলে জানা গিয়েছে। তবে শুক্রবার সকালে নিউরো সার্জেন না থাকায় একজনকে জলপাইগুড়ি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল থেকে মেডিকেল কলেজে স্থানান্তরিত করা হয়।
দুর্ঘটনাস্থল দোমহানি থেকে জলপাইগুড়ি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে যান রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণ। সেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন দুর্ঘটনাগ্রস্তদের অনেকেই। ঘুরে দেখেন রেলমন্ত্রী। আহতদের সঙ্গে কথা বলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে রেলমন্ত্রী জানান, যাত্রী সুরক্ষায় কোথাও কোনও খামতি ছিল কি না তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তদন্তসাপেক্ষ। ডিজি সেফটি যাচ্ছেন ঘটনাস্থলে। সেখানে তদন্ত করে দেখা হবে। তারপরই চূড়ান্ত কিছু বলা সম্ভব। জলপাইগুড়ি থেকে রেলমন্ত্রী উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাবেন। পাশাপাশি শিলিগুড়িতে বেসরকারি একটি নার্সিংহোমে ট্রেনের চালক ভর্তি রয়েছেন। তাঁর সঙ্গেও দেখা করবেন। রেলমন্ত্রী জানিয়েছেন, রাজ্য সরকার সবরকমভাবে রেলকে সাহায্য করছে। উদ্ধারকাজ চলছে, আহতদের ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছে।
দুর্ঘটনার খবর পেয়েই রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট শোক প্রকাশ করেন। একইসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে যাতে সবরকমভাবে সহায়তা করা হয়, তার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। জানা গিয়েছে, রাজস্থানের দুই মন্ত্রী ভানওয়ার সিং ভাটি ও গোবিন্দ রাম মেঘওয়ালকে ময়নাগুড়ির দুর্ঘটনাস্থলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন গেহলট।
সবিস্তারে পড়ুন: ময়নাগুড়ির রেল দুর্ঘটনায় শোকপ্রকাশ রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রীর, দুর্ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন সে রাজ্যের ২ মন্ত্রী
উত্তরবঙ্গে রেল দুর্ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে বিস্ফোরক বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। রূপা লেখেন, “ট্রেন কি নিজে নিজেই ডি-রেল হয়? রেল ট্র্যাক কি বেচারা বোঝে, ভাই, ইলেকশন সামনে, রেল নিয়ে অনেক বছর কোনও বাজে খবর হয়নি, মানুষের প্রাণ নিয়ে ছেলেখেলা…সিবিআই তদন্ত হওয়া উচিত।”
সবিস্তারে পড়ুন: ‘মানুষের প্রাণ নিয়ে ছেলেখেলা…সিবিআই তদন্ত হোক’
রাত আড়াইটে নাগাদ শেষ মৃতদেহটি উদ্ধার করা হয়। গ্যাস কাটার ব্যবহার করে বহু চেষ্টার পর মৃতদেহটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি রাত ৩টে নাগাদ রেলের ব্রেক ডাউন ট্রেন ও হাইড্রোলিক ডিরেল্ড মেশিন এসে পৌঁছেছে। দুর্ঘটনাগ্রস্ত রেলের ইঞ্জিনটিকে লাইনে বসানোর কাজ চলছে। কনকনে ঠান্ডায় রেলের ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে উদ্ধারকারী দল এই কাজে হাত লাগিয়েছেন। রয়েছে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট টিম।
দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিকানের গুয়াহাটি এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনের নিচে থাকা ট্রাকশন মোটর রেললাইনের উপরে পড়ে যাওয়া কি এই দুর্ঘটনার বড় কারণ? তাই নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। আধিকারিকরা কিছু না বললেও রেললাইনের উপর পড়ে যাওয়া ট্রাকশন মোটরের স্থানটি বার বার ঘুরে দেখছেন তাঁরা। তদন্তেও এই বিষয়টিতে জোর দেওয়া হচ্ছে বলে সূত্রের খবর। কী কারণে এই রেল দুর্ঘটনা ঘটল? রেলওয়ে লাইন থেকে ১২টি কামরা কীভাবে উল্টে পড়ে গেল? এই সমস্ত নিয়ে তদন্ত হবে রেলওয়ে সেফটি কমিশনারের নেতৃত্বে।
সবিস্তারে পড়ুন: ট্র্যাকেই গোলমাল? রেললাইনে ট্রলি চালিয়ে পরিদর্শন রেলকর্তাদের
মৃতদের মধ্যে কোচবিহারের তিনজন বাসিন্দা রয়েছেন। জলপাইগুড়ি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে শুক্রবার সকালেই পৌঁছন এনবিএসটিসির চেয়ারম্যান পার্থপ্রতিম পাল। এদিন ময়না তদন্ত হলে দেহ নিয়ে যাওয়া হবে কোচবিহারে।
বিকেল ৪টে ৫৩। দোমহানি স্টেশন ছাড়ে আপ বিকানের এক্সপ্রেস। ৪টে ৫৮ দুর্ঘটনা। আচমকাই ব্রেক কষে থমকে যায় ট্রেন। সে সময় ট্রেনের গতি ছিল ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। লাইনচ্যুত হয়ে ছিটকে যায় ট্রেনের বগিগুলি। কী কারণে এই দুর্ঘটনা তা নিয়ে শুক্রবার রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণ জানান, যান্ত্রিক কোনও ত্রুটির কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। তবে বিস্তারিত তদন্তের পর চূড়ান্তভাবে কিছু বলা সম্ভব।
সবিস্তারে পড়ুন: ‘যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই দুর্ঘটনা, কোচের কোনও সমস্যা নয়’
রেল মন্ত্রকের প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, “ট্রেন লাইনের দিকে কি নজর দেয়নি রেল? কী ভাবে এমন একটা ঘটনা ঘটল?” তাঁর দাবি, অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দিচ্ছে রেল মন্ত্রক। সেই কারণে নিরাপত্তায় খামতি থেকে যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। বর্তমানে আলাদা করে রেলের বাজেট হয় না। মোদী সরকারের আমলে বাজেট পদ্ধতিতে বদল এসেছে। অধীরের দাবি, এর ফলে রেলের জন্য যে আলাদা ব্যবস্থা ছিল, সেটা উঠে গিয়েছে। তিনি বলেন, “যাত্রীরা টিকিট কাটছেন গন্তব্যে পৌঁছনোর জন্য। আর সেই যাত্রাপথে যদি মৃত্যু হয় তা মেনে নেওয়া যায় না।”
বিজেপি সাংসদ ও কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী জন বার্লা শুক্রবার সকালেই ঘটনাস্থলে যান। তাঁর কথায়, “খুব দ্রুত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত হওয়া উচিত। কেন এভাবে দুর্ঘটনা হল তা খতিয়ে দেখতে হবে। রেলমন্ত্রী খতিয়ে দেখছেন। আশা করছি, দ্রুত সুরাহা হবে।”
শুক্রবার দোমহানিতে গিয়ে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণ বলেন, “মনে হচ্ছে কোনও যান্ত্রিক গোলমাল হয়েছিল। কেন কীভাবে তা হয়েছে তা তদন্তসাপেক্ষ। হঠাৎ করে ফেলিওর হয় কোনও ইক্যুইপমেন্ট। তদন্তে বিস্তারিত জানতে পারব। লোকো পাইলটের সঙ্গে কথা হয়েছে। ইক্যুপমেন্টে হঠাৎ কোনও ফেলিওর হয়েছে। তদন্ত করা হবে।” এর পিছনে কোনও ষড়যন্ত্র রয়েছে কি না, এই প্রশ্নের জবাবে রেলমন্ত্রী বলেন, “এখনই কোনও কিছু চূড়ান্ত করে বলা সম্ভব নয়। খতিয়ে সবকিছু দেখেই বলা যাবে।”