Fishing Cat: কাঁটাতার পেরিয়ে সন্ধে-রাতে ‘তারা’ আসে, ‘ফিশিং ক্যাট ফেব্রুয়ারি’তে রাজ্যপ্রাণী বাঘরোল নিয়ে বিশেষজ্ঞ কলাম
বাগনানে যেভাবে তিনটে মেছোবিড়ালকে নির্বিচারে মারা হল কিংবা অতীতেও যেভাবে মারা হয়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে এদের ভবিষ্যত কী সেটা সত্যিই কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে। হতাশ লাগে।

শেষ কয়েকদিন ধরেই বাগনানের ঘটনাটা যথেষ্ট চিন্তিত করেছে আমাকে। আমি কে? সম্রাট। সম্রাট চক্রবর্তী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ফিশিং ক্যাট’ নিয়ে ২০১৭ সালের শেষ থেকে গবেষণা করে চলেছি প্রফেসর গৌতম কুমার সাহার তত্ত্বাবধানে। ‘পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র পর্ষদ’-এর রাজ্যজোড়া যে সমীক্ষা হয়, তাতে আমি কাজ করেছি। সারা পশ্চিমবঙ্গ চষে দু’বছরে ১৯টি জায়গার (অধিকাংশ নতুন) সন্ধান পেয়েছি, যেখানে এই মেছোবিড়াল এখনও আছে। এখানে অবশ্যই বলতে চাই আমরা ২৮টি ক্যামেরা ট্র্যাপ নিয়ে কাজ করিনি। আমাদের সঙ্গে ছিল মাত্র ১৫টি ক্যামেরা এবং সময়গত কারণে সেগুলিতেও সমস্যা দেখা দেয় পরবর্তীকালে। ৮০টি জায়গাতে ক্যামেরা ট্র্যাপ লাগানোও হয়নি (কিছুদিন আগে যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়াতে পড়লাম একটি সাক্ষাৎকারে এরকম ভুল তথ্য পরিবেশিত হয়েছে, তাই-ই একটু ধরিয়ে দিলাম)। যাই হোক, এই দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ওই সমীক্ষার কাজে ঘুরে-বেড়ানোর সময়ে মেছোবিড়ালকে মেরে ফেলার ঘটনা বা অনেক সময় রাস্তার ধারে মেছোবিড়ালদের মৃতদেহ পড়ে থাকার দৃশ্য তখনও ভিতরটাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিত। আজও দেয়। এই ফেব্রুয়ারি মাসটা মেছোবিড়ালদের। ফিশিং ক্যাট ফেব্রুয়ারি। উদযাপনের তোড়জোড় চলছে সব জায়গায়। তাই মনে হল একটা গল্প আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়। গল্প না বলে, অভিজ্ঞতা বললেই ভাল হবে বোধ হয়।
‘বজরঙ্গী ভাইজান’ সিনেমার সেই দৃশ্যটা মনে আছে? যেখানে নায়ক বলছে: সে ভিসা ছাড়াই কাঁটাতারের বেড়ার নীচ দিয়ে পাকিস্তানে ঢুকেছে। আমার গল্পের মুখ্য চরিত্রও খানিকটা ওরকমই কাজ করে রোজ! কোথায়? ক্রমশঃ প্রকাশ্য!
গ্রামের নাম পদ্মপুকুর। বনগাঁ মহকুমা থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে বাগদাহ তহশিলের অন্তর্গত একটি ছোট্ট গ্রাম। হাতে গোনা শ’খানেক পরিবারের বাস এই অঞ্চলে। মেইন রাস্তা থেকে ছোট্ট একটা আঁকাবাঁকা রাস্তা ঢুকে গিয়েছে ভিতরের দিকে। দু’পাশে জঙ্গল। কোথাও বা বাঁশবন। আরেকটু এগোলে দু’পাশের দিগন্ত গিয়ে মিশেছে জলাজমিতে। কোথাও চাষ হচ্ছে ধানের, কোথাও বা সর্ষের।
বিগত চার বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়ে সংগ্রহ করে চলেছি মেছোবিড়ালের খবরাখবর। অনবরত চলছে ক্যামেরা ট্র্যাপ লাগিয়ে তাদের সঠিক অবস্থান, ছবি আর তথ্য তুলে ধরার কাজ। এরকম কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ করেই পরিচয় হল টুকাই (বিশ্বাস)দা-র সঙ্গে। আসতে বলল বনগাঁতে। নতুন একটা হ্যাবিট্যাট! নতুন একটা পরিবেশে নিয়ে যাওয়ার কথায় লোভ সামলাতে না পেরে বেরিয়ে পড়লাম বনগাঁর উদ্দেশে। সময়টা শীতকাল। সকালে দাদার সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে পড়লাম নতুন ঠিকানার দিকে। গ্রামে ঢোকার ওই আঁকাবাঁকা রাস্তা ঢেকে রেখেছে খেজুর গাছ। বুল্বুল পাখির ঝাঁক কোথাও বা খেজুর রসের হাঁড়ি থেকে রস সংগ্রহ করে চলেছে। মাঠে হলুদ চাদর বিছিয়ে হালকা হাওয়ায় দুলছে সর্ষের ক্ষেত। খুব সত্যি বলতে সে দিন থেকেই পদ্মপুকুর বেশ ভাল লাগতে শুরু করে। দু’চারটে কুঁড়ে ঘর ছাড়িয়ে মূল গ্রামে ঢুকে গেলাম কেতাব (মণ্ডল)দা-র বাড়িতে। এখানে বলে রাখা ভাল এই মানুষটা টুকাইদার সঙ্গে বিগত বহু বছর ধরে এই মেছোবিড়ালকে বাঁচিয়ে রাখার কাজটা নিজেদের মতো করে চলেছেন। একটু খাওয়া-দাওয়া সেরেই কেতাবদা নিয়ে গেলেন তাঁর ভেড়িতে।

আমাদের মতো ওদেরও পছন্দ মাছ, তাই বোধহয় রাজ্যপ্রাণী। Photo Credit: Samrat Chakraborty
দু’পাশে পুকুর কেটে মাছ চাষ হচ্ছে। শুধু জল আর জল। কিছুটা দূরে ফাঁকা মাঠ। তার পরে একটা রাস্তা আর রাস্তার ওপাশে মনে হল যেন তা রজালি দেওয়া আছে। জিজ্ঞেস করলাম, “ওই পারেই কি বাংলাদেশ?”
উত্তর এল: “হ্যাঁ , ওটাই হল তারকাঁটা। আর ওপারের অংশটা বাংলাদেশ।”
চোখ মেলে দেখে নিলাম একবার পূর্বপুরুষদের স্মৃতি দিয়ে ঘেরা ‘দ্যাশ’টাকে। খানিক ও দিকেই চোখ আটকে গিয়েছিল। হঠাৎই কেতাবদা বলল, “ওই দেখ আবার কাল রাতে মাছ খেয়ে ফেলে রেখে গেছে পাজির দল।”
দেখলাম হ্যাঁ, সেই আধখাওয়া মাছের দেহাবশেষ পড়ে আছে ভেড়ির পাশে। আরেকটু এগিয়ে চোখে পড়ল পায়ের দাগ, জলের পাশে। এতদিনে কাজের সুবাদে বিড়ালের পায়ের ছাপ চেনার কৌশল রপ্ত করে ফেলেছিলাম। বুঝতে বাকি রইল না এখানে মেছোদের আগমন যথেষ্টই। তাই আব্দারের সুরে বলে বসলাম, “ক্যামেরা কোথায় লাগানো যাবে বলো। শুধু মুখের কথা তো লোকে বিশ্বাস করবে না, পাছে হয়তো কেউ বলেই বসবে ওরা আবার কাজ জানে নাকি, সব ভুলভাল কাজ!”
যাই হোক, যাতায়াত করার পথগুলো চিনে নিয়ে সেট করলাম ক্যামেরা ট্র্যাপ। এবার আস্তে-আস্তে ফেরার পালা। সবাইকে টাটা বলে ট্রেনে বাড়ি ফিরে এলাম। ১৫ দিন পর উপস্থিত হলাম একই জায়গায়, ক্যামেরাগুলো দেখতে।

Photo Credit: Samrat Chakraborty
কিন্তু কি বিড়ম্বনা! অধিকাংশ ছবিই জলে গেছে। বুঝলাম বড্ড গায়ে-গায়ে লাগানো হয়েছে রাস্তার। অন্য ক্যামেরাতে এসেছে শুধুই খটাশ (জঙ্গল ক্যাট) আর শেয়াল। মন খারাপ হয়নি বলব না। কিন্তু কোথাও গিয়ে বিশ্বাস ছিল—ঠিক আছে, আজ আসেনি পরের বার নিশ্চয়ই আসবে ওদের ছবি।
আস্তে-আস্তে রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলাম সীমানার দিকে। উর্দিধারী এক জওয়ান এসে প্রশ্ন করলেন, কী করছি না করছি। পরিচয় দেওয়ার পর ব্যাগ চেক করে জিজ্ঞেস করলেন (ট্র্যাপ ক্যামেরাগুলোর দিকে তাকিয়ে), “এগুলো কী?” উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে মেছোদের ছবি দেখাতেই তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি উজাড় করে দিলেন। আর আমি যতটা পারলাম কুড়িয়ে নিলাম তাঁর দেওয়া তথ্যগুলো।
পঞ্জাবনিবাসী সেই জওয়ান বললেন, সন্ধে যখন নামে, তখন টর্চ মারতেই সেই রাস্তায় দেখা যায় বিড়ালদের। বাঘের মতো দাগ আছে ভেবে প্রথমে তাই তাঁরাও ভাবতেন বুঝি বাঘমামা! কিন্তু টুকাইদা, কেতাবদারা বোঝাতে পেরেছে এ আমাদের ‘রাজ্যপ্রাণী’। এদের মারা যাবে না। তাই এখন প্রায় রোজ দেখলেও ভয়টা চলে গিয়েছে। বুঝলাম এ জায়গা ছাড়া যাবে না।
তারপর বহুবার গিয়েও ঠিকমতো ছবি না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ছি। হঠাৎই টুকাইদার ফোন। বলল, “তোর ক্যামেরাতে ছবি এসেছে রে…” মনে শান্তি এল।
এরপর নিজের কাজের জায়গা হিসেবে বেছে নিলাম এই গ্রামটাকেই। সঠিক একটা জায়গায় ক্যামেরা লাগলাম। ১৩ই জানুয়ারি ২০২১। সুস্পষ্ট ছবি পেলাম মেছোবিড়ালের। সত্যি খুব আনন্দ লেগেছিল সেইদিন। তারপর থেকে সন্ধের পর ভেড়িতে থাকা শুরু করলাম। সন্ধের এই গ্রাম আরও সুন্দর। দূরে হলুদ আলোর ঝলকানি, চারপাশে ঝিঁঝি পোকার শব্দ, আকাশের গায়ে হাজার তারার চাঁদোয়া।

Photo Credit: Samrat Chakraborty
এরকমই আর একটা শীতের শুরুর দিকের সন্ধেবেলা বসেছি, টর্চ মারতেই ঠিক ১০০ হাত দূরে একটা ছায়া! হঠাৎ উঠে এল কলাবাগানের ভিতর থেকে। গুটিগুটি পায়ে, আস্তে-আস্তে এসে বসল ভেড়ির পাড়ে। একবার আমার দিকে দেখল কি দেখেনি খেয়াল নেই। কারণ তখন আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকে দেখছি, তার ক্রিয়াকলাপ চোখের সামনে দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না। উল্টো দিক থেকে আস্তে-আস্তে সে হাঁটা শুরু করতে আমিও এপাড় বরাবর এগোতে লাগলাম তার দিকে। সরু ট্রেইলের মধ্যে একটা ঝোপ। সেখানে এসেই বসল রাজকীয় ভঙ্গিতে, আমিও দাসানুদাস হয়ে খানিক তফাতে বসলাম। হাত ২০-র ফারাক মাত্র! শান্ত হয়ে বসে দেখলাম এর স্বভাব একদম বাড়ির বেড়ালদের মতোই। অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে পরিষ্কার করার পর সে আস্তে করে তার জায়গা ছেড়ে হঠাৎ হুশ করে উধাও হয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে। তার আর আমার দেখা হয়ত ১০ মিনিটের ছিল। কিন্তু সেটাই যে কত শান্তির সেটা হয়ত অনেকেই বুঝবেন না।
তারপর থেকে প্রায়ই আমি দেখেছি তাকে। কখনও শেয়ালদের দলকে এক প্রকার চোখ রাঙিয়ে কখনও বা মহারাজের মতো সে এসেছে এই পদ্মপুকুরের ভেড়িতে। এক বছর হয়ে গিয়েছে , রোজই ক্যামেরাতে ছবি আসছে।

ওরা কি বিলুপ্তির প্রহর গুনছে? Photo Credit: Nandan Paul
তারকাঁটা আমাদের জন্যে টানা হলেও এই বেড়ালদের জন্য নয়। ওদের বাসস্থান বাংলাদেশের ও দিকে অব্যবহৃত,পরিত্যক্ত কবরখানা, জলা জায়গায় আর জঙ্গলে ঢাকা ঘাসের জমিতে। এ দেশে তাদের প্রবেশ অনুপ্রবেশ নয়! অবাধ। আসতে কোনও বাধা নেই, আসতে গেলে ভিসাও লাগে না, পাসপোর্টও দেখাতে হয় না। কারণ ওরা যে এই রাজ্যের ‘রাজ্যপ্রাণী’। এ রাজ্য তাদের। কিন্তু সমস্যা হল মানুষ সেটা বোঝে না। তাই তো আজও আমাদের রাজ্যে যত্রতত্র মেছোবিড়ালদের মেরে ফেলার খবর আসে। আমি রক্তাক্ত হই মনে-মনে।
বাগনানে যেভাবে তিনটে মেছোবিড়ালকে নির্বিচারে মারা হল কিংবা অতীতেও যেভাবে মারা হয়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে এদের ভবিষ্যত কী সেটা সত্যিই কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে। হতাশ লাগে। বিরক্তি আসে সেইসব মানুষদের উপর যারা এতদিন কাজ করেছেন বলে ভীষণ গর্ব করলেও এরকম ঘটনার পর একে-অন্যের দিকে আঙুল তোলেন। জগৎ সৃষ্টি করেছেন যিনি, তিনি এদেরও তো এনেছেন! সেখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তির তালিকায় এদের না রেখে সবার সঙ্গে কাজ করার মধ্যেই বোধ হয় সুরক্ষিত হতে পারে মেছোবিড়ালদের ভবিষ্যত। আমি কাজ করেছি বলে আর কেউ কাজ করতে পারে না, এ চিন্তা যত তাড়াতাড়ি আমাদের মাথা থেকে সরে যাবে ততই আরও ভাল কাজ হতে পারে।

বাগনানে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু তিনটি মেছোবিড়ালের। Photo Credit: Nandan Paul
ফিশিং ক্যাট ফেব্রুয়ারি আমার কাছে তাই ঠিক আর পাঁচটা দিনেরই মতোই। আমি জানুয়ারিতেও যে কাজ করেছি, সেটা ফেব্রুয়ারিতেও করব, সেটা জুন কিংবা ডিসেম্বরও করব। পরিবেশ দিবসের দিন আমরা কত অনুষ্ঠানে অংশ নিই, অঙ্গীকার করি! কিন্তু বাকি ৩৬৩টা দিন গাছপালা কেটে ফেলতে উদ্যত থাকি। তাই আমার মতে বিশেষ কোনও মাসে সচেনতনতা শিবির না করে সারাবছর ধরে চলুক এই কর্মকাণ্ড। ফিশিং ক্যাট ফেব্রুয়ারির জায়গায় নাম হোক ‘ফিশিং ক্যাট ইয়ার’। যেখানে উৎসাহী ছেলেমেয়েদের নিয়ে দল বানিয়ে কাজ চলুক বছরের পর বছর। একক প্রচেষ্টার চেয়ে সমষ্টিতে বিশ্বাসী হলেই কাজ সহজে উদ্ধার হতে পারে। না হলে আজ সে আমাকে বলবে, কাল আমি অন্য কোনও নতুন কাজ করা মানুষকে বলব এবং এটা রিলে রেসের মত চলতেই থাকবে। আর ও দিকে বাসস্থান হারিয়ে মানুষের রোষের মুখে পড়ে মারা যাবে আরও কত না জানি মেছোবিড়াল!
লেখক পরিচিতিঃ সম্রাট চক্রবর্তী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক; রাজ্যপ্রাণী বাঘরোল বা মেছোবিড়ালের ওপর জুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া, পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র পর্ষদ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও নেচার-এর যৌথ উদ্যোগে যে নিরীক্ষণ চলছে, সেই সার্ভেতে কাজ করছেন সম্রাট চক্রবর্তী। নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে বাঘরোলের বাসস্থান কমছে রোজ। তাদের সংখ্যার ওপর এর প্রভাব নিয়েই সম্রাটের গবেষণা।





