‘বাঁকুড়া মিমস’ ছাড়তে ‘বাধ্য’ হয়ে কি ‘বাতেলাবাজ’ হলেন সৌমিত্র-সম্রাট-কিরণ?
বাঁকুড়া মিমস শর্টস্। দল ছেড়ে বেরিয়ে এলেন সৌমিত্র-সম্রাট-কিরণ! কী তার কারণ? বন্ধুত্বের টানাপড়েন নাকি অন্যকিছু?
বাঁকুড়া মিমস শর্টস্। কোভিড এবং পরবর্তী লকডাউনের সময় থেকে এই নাম সোশ্যাল ‘স্ক্রোলার’দের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। শুধু ‘পরিচিতি’ শব্দে ইউটিউব চ্যানেলটির সম্পূর্ণভাবে মূল্যায়ণ সম্ভব নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিং চার্টে বহুবার নিজেদের চ্যানেলের নাম খোদাই করেছে বছর পচিঁশ-ছাব্বিশের ছেলেপুলেদের এই ‘বিএমএস’ চ্যানেল। উন্মেষ গঙ্গোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, কিরণ পাল এবং সম্রাট মুখোপাধ্যায়। গত ন’বছর ধরে তিলে তিলে লালন-পালন করা একটা ইউটিউব চ্যানেল। ১২ টি প্লেলিস্ট। সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। তারপর আরেকটি চ্যানেল। ভ্লগিং চ্যানেল। সে চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা প্রায় ৬৫,০০০। কমেডি স্কেচ থেকে ওয়েব সিরিজ ওঁরা চারজন সমানতালে কাঁধে-কাঁধ ঠেকিয়ে কাজ করেছেন। জ্ঞানীগুণীরা বলেন মানুষের ঠোঁটে হাসি গুঁজে দেওয়া কঠিন কাজ। প্রতিনিয়ত ‘বিএমএস’ এক একটি ভিডিয়োতে হাসতে বাধ্য করেছে এবং মানুষও ঢেলে দিয়েছে অফুরান শুভেচ্ছা।
কিন্তু সব ভালর শেষ ভাল হয় কি?
বাঁকুড়া মিমস শর্টসের ওঁরা চারজন আজ আলাদা। আলাদা হয়েছে দু’ভাগে। একদিকে উন্মেষ গঙ্গোপাধ্যায়, আর অন্যদিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, কিরণ পাল এবং সম্রাট মুখোপাধ্যায়। এতগুলো বছরের এক জার্নির সমাপতন। কী কারণে ভাঙন? কেন ভাঙল এক দারুণ বন্ধুত্ব? গতকাল অর্থাৎ শনিবার সৌমিত্র-কিরণ এবং সম্রাট তিনজন নিজেদের ফেসবুক পোস্টে যা জানিয়েছেন তা মোটামুটি একই রকম।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ফেসবুক পোস্ট
“হ্যাঁ যেটা বলছিলাম, গত ২৩ শে ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে আমি, সম্রাট, কিরণ ‘বাঁকুড়া মিমস শর্টস্’ তথা ‘বিএমএস এক্সট্রাজ’–এর পার্ট নই। আবার বলছি আমরা আর ‘বিএমএস’–এর অংশ নই। তোমরা যারা আমাদের ভালবাসো তাদের সবার এটা জানার অধিকার আছে কী হয়েছে, কেন হয়েছে? কিন্তু সেইসব কথা বলার প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক নয়, তাই এখানে সে সব বলা থেকে আমরা সবাই বিরত থাকব। আর হ্যাঁ, আমরা ৩জন একটা ইউটিউব চ্যানেল শুরু করছি ‘বাতেলাবাজ’ বলে। আগামীকাল সন্ধ্যে ৭টায় আমাদের প্রথম ভ্লগ আসছে। সেখানে আমরা বলেছি কেন নতুন চ্যানেল খুললাম, আমাদের নতুন চ্যানেলে আমরা কেমন কন্টেন্ট বানাবো এবং তার সাথে ভ্লগে আছে কয়েকজন বন্ধুর নিখাদ বন্ধুত্বের গল্প। তোমরা আমাদের অনেক ভালবেসেছ, অনেক সাহস দিয়েছো। তার জন্য আমরা আজীবন তোমাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ! আশা রাখি এই নতুন চ্যানেলেও তোমাদের ভালবাসা পাব। আমরা চেষ্টা করে যাব সবসময় তোমাদের জীবনে এক টুকরো আনন্দ হয়ে আসার, তোমাদের জীবনে একটা জায়গা করে নেওয়ার। কমেন্টে আমাদের নতুন চ্যানেল “বাতেলাবাজ” এর ইউটিউব চ্যানেলের লিংক দিলাম, সাবস্ক্রাইব করে নিতে পারো। প্রথম ভিডিও আসছে আগামীকাল সন্ধ্যে ৭ টায়। নতুন এক যাত্রাপথে কাল আমাদের প্রথম পদক্ষেপ, আশা রাখি পিছনে ফিরে তাকিয়ে তোমাদের সব্বাইকে সাথে পাব…”
সম্রাট মুখোপাধ্যায়ের ফেসবুক পোস্ট
“গত ২৩ শে ফেব্রুয়ারি থেকে আমি, সৌমিত্রদা আর কিরণদা ‘বাঁকুড়া মিমস শর্টস্’এবং ‘বিএমএস এক্সট্রাজ’ এর পার্ট নই। কেন, বা কী হয়েছে সেটা নিয়ে আমরা কোন কথা বলতে চাই না। এটুকুই বলতে চাই বিগত বছরে আমরা তোমাদের সবার কাছ থেকে অনেক ভালবাসা পেয়েছি, অনেক কিছু শিখেছি। এটা এক বছর আগে ভাবতেই পারতাম না যে একটা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে মানুষকে কিছুক্ষণের বিনোদন উপহার দিয়ে এতটা ভালবাসা আর সম্মান পাওয়া যায়! সেই ভালবাসার উপর বিশ্বাস রেখে আমরা তিনজন আবার নতুন করে শুরু করার সাহস পেয়েছি। আমাদের নতুন চ্যানেল ‘বাতেলাবাজ’ লিংক আমি কমেন্টে দিলাম এবং আমাদের এই নতুন যাত্রা পথে তোমাদের অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানালাম আর আশা রাখলাম আরো অনেক বেশি ভালবাসা আর সমর্থন পাব। কালকে সন্ধে সাতটায় আমাদের প্রথম ভ্লগ আসবে। আমরা চেষ্টা করব এমন কিছু কনটেন্ট বানিয়ে যাবার যেটা তোমাদের দেখতে ভাল লাগবে এবং আশা করব ভবিষ্যতে আমাদের জন্যে তোমাদের আর কখনও হতাশ হতে হবে না।”
কিরণ পালের ফেসবুক পোস্ট
“গত ২৩ শে ফেব্রুয়ারি থেকে আমি, সৌমিত্র আর সম্রাট ‘বাঁকুড়া মিমস শর্টস্’ এবং ‘বিএমএস এক্সট্রাজ’ এর সদস্য নই। কী দারুণ জার্নি ছিল!! আমরা তিনজন একটা চ্যানেল শুরু করছি । চ্যানেল এর নাম ‘বাতেলাবাজ’ আগামীকাল সন্ধ্যা সাতটায় প্রথম ভ্লগ আসছে । সেখানে আমরা অল্পবিস্তর বলেছি কি হয়েছে , কেন নতুন চ্যানেল, পরবর্তী সময়ে কী কী করব আর সাথে থাকবে নির্ভেজাল বন্ধুত্ব । এতদিন এত ভালোবাসার জন্য সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ । আশা করি এই চ্যানেল–এও তোমাদের ভালবাসা পাব । লিঙ্ক কমেন্ট বক্স-এ।”
‘মানুষ কী ভাবছে’, ‘অমানুষ কী ভাবছে’, ‘যদুবাবুর টিউশানি’ কিংবা ‘এলে বাট গেলে না’র মতো ইন্ডিপেনডেন্ট ওয়েবসিরিজে কাজ করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। উন্মেষের ঠিক পাশে-পাশে ‘বিএমএস’ নৌকার হাল ধরেছেন তিনি। টিভি নাইন বাংলার পক্ষ থেকে তাঁকে ফোনে ধরা হলে তিনি বলেন, “গত জানুয়ারি মাস থেকে বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছিল, আমাদের তিনজনের। ক্রিয়েটিভ ডিফারেন্স মারাত্মক পর্যায় চলে যাচ্ছিল। উন্মেষদা যেভাবে চাইছিল চ্যানেলের কনটেন্ট, সেটা আমাদের সঙ্গে মিলছিল না। সে কারণেই আমাদের বেরিয়ে আসা। এর থেকে বেশি কিছু আমি বলতে চাই না।” বিএমএসের আরেক সদস্য (প্রাক্তন) সম্রাট মুখোপাধ্যায়। ভিডিয়োতে তাঁকে দেখা গিয়েছে হাসিখুশি। উন্মেষ যতবার তাঁকে বিব্রত করুক না কেন, শিশুসুলভ হাসিতে ভরে গিয়েছে সম্রাটের ঠোঁট। টিভি নাইন বাংলার পক্ষ থেকে ফোনে ধরা হলে সম্রাট বলেন, “একটা সময় পর কারও ব্যবহার শুধু খারাপলাগা হয়ে থেকে যায় না, আত্মসম্মানে আঘাত আনে। এটুকুই বলতে পারি।” ‘যদুবাবুর টিউশানি’র পর্দার পিছনের অনেকটা দায়ভার থাকত সম্রাটের কাঁধে। সম্রাটের মনখারাপ করছে না টিউশানি বন্ধ হয়ে গেল যে? “উন্মেষদা যদবাবু নিয়ে তো আর ভাবছে না…ও অন্য কিছু করবে হয়তো…” খানিক চুপ করে উত্তর সম্রাটের।
উন্মেষ গঙ্গোপাধ্যায়। বিএমএস চ্যানেলের স্রষ্টা এবং পুরোনো সদস্য। পরে বাকি তিনজন যোগ দিলে তৈরি হয় আজকের ‘বিএমএস’। আর আজ উন্মেষ গঙ্গোপাধ্যায় একা। কিছুদিন আগেই বিএমএস কাস্টিং কল নিয়ে পোস্ট করেছিলেন ফেসবুকে এমনকি পোস্টে ছিল অডিশন ফর্মও। তাহলে কি অনেক আগে থেকেই এমন এক সম্ভাবনার কথা ভেবে এগচ্ছিলেন উন্মেষ। তাঁকে ফোনে ধরা হলে তিনি বলেন, “আমি কিছু বলতে চাইছি না এই মুহূর্তে। আমাকে একটু সময় দিন, আমি সবটাই জানাব। সব কিছু ক্লিয়ার হয়ে যাবে। আমি নিজের মতো থাকতে চাই। গোটাটাই ভীষণ প্রফেশনাল। সবাই সব কিছু বুঝতে পারবে। আমি এ বিষয়ে এখন কিছু বলতে পারব না। কেন হয়েছে কী হয়েছে, ওটা আমার মধ্যেই থাক।”
সম্পর্কের চিড় যে গভীর তা বোঝা যায় বারবার, প্রত্যেকের কথায়। নতুন চ্যানেল নিয়ে ব্যস্ত সৌমিত্র-সম্রাট এবং কিরণ। ‘বিএমএস’ সংক্রান্ত পোস্টে জানিয়েছেন নতুন চ্যানেল ‘বাতেলাবাজ’-এর প্রসঙ্গেও। কী থাকবে সে-ই চ্যানেলের কনটেন্টে? সম্রাট বললেন, “খুব তাড়াতাড়ি শুরু করতে হল চ্যানেল, তা-ই সময় খুব কম। চ্যানেলটাকে দাঁড় করাতে র্যাপিড কনটেন্ট দিতে হয়। ভ্লগ করার প্ল্যান করছি এবং বাংলায় গেমিং নিয়ে খুব একটা বড় কিছু হয়নি, ভাবছি ওইদিকটা নিয়েও কিছু করব।”
‘যদুবাবুর টিউশানি’-র ‘ডাই হার্ড ফ্যান’ রেডিও মির্চি দুই আরজে সোমক ঘোষ ও অগ্নিজিৎ সেন। সোমকের রোজকার নিয়মের মধ্যে পড়ে যদুবাবুর গোটা স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করে ফেলা। গোটা খবরটি পেয়ে বেশ আশাহত জকি। সোমক বললেন, “সেই বাংলা ব্যান্ডের যুগে, যখন একটার পর একটা নামকরা ব্যান্ড উঠে আসছে, তখন একটা ব্যান্ডের ব্রেকআপ খুব কষ্ট দিত। মনে হতো এরা আর গান না বানালে শুনব কী? ‘বিএমএস’-এর খবর শুনে সেইরকম মনে হচ্ছে। খুব চেয়েছিলাম যে এই দলটা থাকুক। যাই হোক, ‘বিএমএস’-এর সবাইকে অনেক শুভেচ্ছা…এগিয়ে যাওয়াই জীবনের মন্ত্র। আরও ভালো কাজ করুক সবাই, নতুন প্রজেক্টগুলো মানুষের মনে দাগ কাটুক।” আরজে অগ্নি কথা বলা শুরু করলেন যদবাবুর পেটেন্ট সংলাপে, “টিরিপইন্ডিয়া—ওই অ্যাক্সেন্ট, আমি উন্মেষকেও এটা নিয়ে বলেছি! কীভাবে ওরকম বাঁকড়ি অ্যাক্সেন্ট রপ্ত করল। ওটা মিস করব। যাই হোক, টিউশানি ভেঙে যাচ্ছে, এবং যদবাবুও নিশ্চয়ই কষ্ট পাচ্ছেন। কিন্তু যদবাবুকেও বুঝতে হবে ছাত্র-ছাত্রীদেরও তো বয়স বাড়ে…তাঁরাও গ্র্যাজুয়েশনের দিকে এগোয়। তাঁদের যদবাবুকে আর দরকার পড়ে না। যেটা থেকে যায় সেগুলো মুহূর্ত। সেই মুহূর্ত কাটানোর আনন্দ। ছাত্রছাত্রীরা যেন কোনওদিনও না ভোলে সেই বকুনি খাওয়ার মুহূর্তগুলো এবং যদবাবুও যেন না ভোলে তাঁদের দুষ্টুমির মুহূর্ত…। এগিয়ে যাওয়া জীবনের মূলমন্ত্র, কিন্তু তাও যেন আমরা প্রত্যেকে না ভুলি আমরা কি ছিলাম আর আজ আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে…ব্যস এটুকুই।”
ভাঙা-গড়া নিয়ে চলে বহমান এই জীবন। কিন্তু কিছু-কিছু ভাঙন চিরতরে কোথাও এক ফাটল রেখে যায়। ঠিক যেমন ‘বিএমএস’ চ্যানেলে ধরা পড়ল বিরাট এক ফাটল। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিএমএস চ্যানেল অ্যাডমিন সংক্রান্ত যাবতীয় প্রক্রিয়া থেকে সরে এসেছে সৌমিত্র-সম্রাট-কিরণ। পাসওয়ার্ড বদলে দেওয়া হয়েছে চ্যানেল আইডিতে। কিন্তু আজও ‘বাঁকুড়া মিমস শর্টস’-এর চ্যানেল কভার ছবিতেও সৌমিত্র-উন্মেষ একসঙ্গে। ‘বিএমএস এক্সট্রাজ’-এর কভার ছবিতেও রয়েছে উন্মেষ- সৌমিত্র-সম্রাট-কিরণ। কিন্তু কভার ছবিতে একসঙ্গে থেকেও কনটেন্টে ওঁরা চারজন আর নেই! ‘যদবাবু’র ভীষণ দুষ্টু ছাত্র ‘গজা’ কি তাহলে সত্যি-সত্যিই ছেড়ে দিল টিউশানি? নাকি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল অঙ্কের টিউশানি? প্যাঁড়া, টুকাই, গজা কিংবা নিতাই এক ক্লাসের বিচ্ছু বন্ধুরা কি সত্যিই ভীষণ বড় হয়ে গেল, যে তাঁরা ‘সিরিয়াস’ বড়দের মতো ঝগড়া করছে? এত তাড়াতাড়ি কি বড় হয়ে গেল ওঁরা চারজন!
আরও পড়ুন Chakda Xpress: ২২ গজে বিরাটপত্নী, পারফেক্ট শট-এর প্রস্তুতিতে ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ভাইরাল অনুষ্কা