Taslima Nasrin: ইদ্রিস আলি গ্রেফতার, কোন পরিস্থিতিতে কলকাতা ছেড়েছিলেন তসলিমা?

Taslima Nasrin: ২০০৭-এর ওই নভেম্বর মাসেই তাঁকে কলকাতা ছাড়তে হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক অশান্তির আবহে এমনটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তৎকালীন বাম সরকার। সম্প্রতি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর প্রয়াণের পরও, সেই ঘটনা নিয়ে ক্ষোভের সুর শোনা গিয়েছে তসলিমার লেখনিতে। কিন্তু, ঠিক কী ঘটেছিল? কোন পরিস্থিতিতে কলকাতা ছাড়তে হয়েছিল বিতর্কিত এই লেখিকাকে?

Taslima Nasrin: ইদ্রিস আলি গ্রেফতার, কোন পরিস্থিতিতে কলকাতা ছেড়েছিলেন তসলিমা?
কলকাতাতেই দ্বিতীয় ঘর বেঁধেছিলেন তসলিমাImage Credit source: TV9 Bangla
Follow Us:
| Updated on: Oct 28, 2024 | 9:15 PM

‘ভারতকে ভালোবাসি বলেই এখানে রয়েছি… আমাকে ভারতে থাকতে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব।’ গত সোমবার (২২ অক্টোবর), কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে ট্যাগ করে সোশ্য়াল মিডিয়ায় লিখেছিলেন বাংলাদেশি লেখিকা তসলিমা নাসরিন। এর পরের দিনই তাঁর ভারতে থাকার লং টার্ম রেসিডেন্সিয়াল পারমিট-এর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। কাজেই নয়া দিল্লিতে থাকতে তাঁর আর কোনও বাধা নেই। তবে, দিল্লিতে কি থাকতে চেয়েছিলেন লেখিকা? মৌলবাদীদের চাপে ১৯৯৪ সালে তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। এক দশকের বেশি সময় ইউরোপ-আমেরিকায় কাটিয়ে, ২০০৪-এ তিনি তো আশ্রয় নিয়েছিলেন শহর কলকাতায়। কলকাতাকেই নিজের বাড়ি করতে চেয়েছিলেন। ২০০৭-এ রাজস্থানের জয়পুর থেকে ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি প্রতিদিন স্বপ্ন দেখছি পশ্চিমবঙ্গ এবং কলকাতায় ফিরে যাওয়ার। কলকাতা আমার বাড়ি এবং আমি ফিরে আসতে মরিয়া।” কিন্তু, কলকাতা তাঁকে জায়গা দেয়নি। ২০০৭-এর ওই নভেম্বর মাসেই তাঁকে কলকাতা ছাড়তে হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক অশান্তির আবহে এমনটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তৎকালীন বাম সরকার। সম্প্রতি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর প্রয়াণের পরও, সেই ঘটনা নিয়ে ক্ষোভের সুর শোনা গিয়েছে তসলিমার লেখনিতে। কিন্তু, ঠিক কী ঘটেছিল? কোন পরিস্থিতিতে কলকাতা ছাড়তে হয়েছিল বিতর্কিত এই লেখিকাকে?

২০০৪ সাল। ভারত সরকার তসলিমাকে অস্থায়ী রেসিডেন্ট পারমিট দিয়েছিল। সেই পারমিট নিয়ে কলকাতায় থাকতে এসেছিলেন তসলিমা। দীর্ঘদিন বাদে বাংলায় কথা বলার, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি চর্চা করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। মাতৃভূমিতে ফেরার উপায় নেই, সেই অবস্থায় মাতৃভাষায় কথা বলার সুযোগটাই বা কম কী! তাই কলকাতাকে অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের শহর করে নিয়েছিলেন লেখিকা। কলকাতার শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য জগতের সঙ্গে গড়ে উছেঠিল তাঁর প্রতিদিনের যোগাযোগ। কলকাতার পত্রপত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখাও শুরু করেন তিনি। সব মিলিয়ে কলকাতায় নিজের এক নতুন জগৎ খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। তসলিমা নিজেই জানিয়েছেন, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সঙ্গেও তাঁর সখ্য গড়ে উঠেছিল। নন্দনে প্রায়শই শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুজনের আড্ডা হত। এমনকি, কলকাতায় থাকাকালীন, এখানকার ‘গণদর্পণ’ সংগঠনের কাছে দেহদানের অঙ্গীকার পর্যন্ত করেছিলেন তসলিমা।

কিন্তু, কলকাতাতেও বিতর্ক-অশান্তি তাঁর পিছু ছাড়েনি। পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয় যে কেউ তাঁর মুখে কালি লাগিয়ে দেওয়ার জন্য, কেউ বা আবার শিরচ্ছেদের নিদান দিয়ে অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করে। এক পক্ষ জানায়, একমাত্র তসলিমা নাসরিন তাঁর বিতর্কিত লেখনির জন্য ক্ষমা চাইলে এবং তাঁর সব লেখা, বইপত্র পুড়িয়ে ফেললে, তবেই এই ফতোয়া তোলা হবে। রাজনীতিবিদরাই বা কেন পিছিয়ে থাকেন? ২০০৭ সালে, অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন বা এআইমিম-এর বিধায়করা প্রকাশ্যে তসলিমা নাসরিনের প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছিলেন। ওই বছরের ৯ অগস্ট, তসলিমা হায়দরাবাদে গিয়েছিলেন, তাঁর একটি বইয়ের তেলুগু অনুবাদ প্রকাশ করতে। সেই অনুষ্ঠানে দলবল নিয়ে তাঁর উপর চড়াও হয়েছিলেন ৩ এআইমিম বিধায়ক – মহম্মদ মুক্তাদা খান, মহম্মদ মোয়াজ্জম খান এবং সৈয়দ আহমেদ পাশা কাদরি। পরে অবশ্য তাঁদের গ্রেফতার করা হয়।

এক সপ্তাহ পরই, তসলিমাকে নিয়ে গন্ডোগোল শুরু হয় কলকাতাতেও। ১৯৯৩-এ লজ্জা বইটি প্রকাশের সময়ই তাঁর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছিলেন এক ইমাম। তসলিমাকে ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়। তাঁকে হত্যা করার বিনিময়ে সীমাহীন অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। ২১ নভেম্বর তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে ধুন্ধুমার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। আর এবারের বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল ২০০৩ সালে প্রকাশিত হওয়া তসলিমা নাসরিনের লেখা বই, ‘দ্বিখন্ডিত’। বইটি লেখিকার আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ড। বইটি প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তারপর, কলকাতাতেও বইটি নিয়ে বিতর্ক হয়। মুসলিমদের একাংশ দাবি করেন, এই বইটি মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আবেগে আঘাত করেছে। কলকাতা খিলাফত কমিটির অনুরোধে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার স্বার্থে, বইটি নিষিদ্ধ করার জন্য রাজ্য সরকারকে অনুরোধ করেছিল কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের একাংশ। এরপর, বইটি নিষিদ্ধ করেছিল বাম সরকার।

কিন্তু, তারপরও এই বইটিকে কেন্দ্র করে তসলিমাকে ভারত-ছাড়া করার দাবি নিয়ে কলকাতা শহরের বুকে প্রবল অশান্তি বাঁধল। তাদের দাবি ছিল,মহিলাদের বৃহত্তর অধিকার দেওয়ার জন্য কোরান পরিবর্তন করার দাবি জানিয়েছেন তসলিমা। অথচ, লেখিকা এই ধরনের কোনও মন্তব্য করেননি বলে দাবি করলেও, তাতে কোনও কাজ হয়নি। শহরের প্রধান প্রধান সড়কগুলি অবরোধের ডাক দিয়েছিল একাংশের উত্তেজিত জনতা। সেই অবরোধ কর্মসূচি প্রায় সংঘর্ষের রূপ নেয়। দাঙ্গাকারীরা বহু গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। শাসক দল সিপিআইএম-এর কমপক্ষে ২টি কার্যালয়েও আগুন ধরানো হয়। অন্তত ২৭ জন আহত হয়েছিলেন। তাদের ছোড়া পাথরের আঘাতে সংবাদমাধ্যমের বেশ কয়েকজন কর্মীও আহত হন।

বেশিরভাগ হিংসাই হয়েছিল মধ্য ও পূর্ব কলকাতার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায়। পার্ক সার্কাস, তপসিয়া, তিলজলা, ট্যাংরা, পার্ক স্ট্রিট, মল্লিকবাজার, ইলিয়ট রোড, রিপন স্ট্রিট, রয়ড স্ট্রিট, কলিন স্ট্রিট, মারকুইস স্ট্রিট, রাজাবাজার, শিয়ালদহ, মৌলালি, সিআইটি রোড – কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে কাঁদানে গ্যাসের গোলা ছুড়ে ও লাঠিচার্জ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিল পুলিশ। তবে, তাতে কোনও কাজ হয়নি। বাধ্য হয়ে বিকেলের দিকে দশ প্লাটুন সেনা চেয়ে পাঠায় রাজ্য সরকার। শেষে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে শহরে সেনা ঢোকার পর, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। বিকাল ৪টায় ব্রিগেডিয়ার সোলাঙ্কি সামরিক আইন জারি করেন। শহরের বিভিন্ন এলাকায় কঠোরভাবে কারফিউ জারি করা হয়। সিপিআইএম এবং বিরোধীদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে পরের দিন পর্যায়ক্রমে কারফিউ প্রত্যাহার করেছিলেন তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী। পরের দিন বিকেলে সামরিক আইন তুলে নেওয়া হয় এবং সন্ধ্যার মধ্যে স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছিল।

এই অশান্তির দায়ে তৃণমূল কংগ্রেস নেতা ইদ্রিস আলিকে ২২ নভেম্বর সন্ধ্যায় গ্রেফতার করা হয়। যদিও অশান্তির জন্য ক্ষমতাসীন সিপিআইএমকেই দায়ী করেছিলেন ইদ্রিস আলি। তিনি বলেছিলেন, “ওরা আমাদের মধ্যে মিশে গিয়ে হিংসা ছড়িয়েছে। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু মার্কসবাদীরা আমাদের অপমান করার চেষ্টা করছে।” অভিযোগ অস্বীকার করেছিল সিপিআইএম। বিমান বসু বলেছিলেন, “তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা ছিল না। তারা ঝামেলা করার পরিকল্পনা করেছিল। এই বিপর্যয়ের দায় তাদেরই নিতে হবে।” তবে যাইহোক, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য প্রশংসিত হয়েছিল বাম সরকার।

আর তসলিমা নাসরিনের কী হয়েছিল? সেই অশান্তির পর, ওই ২১ নভেম্বরই তাঁর ভালবাসার শহর কলকাতা থেকে রাতারাতি পাত্তারি গোটাতে বাধ্য হয়েছিলেন তসলিমা নাসরিন। প্রথমে গিয়েছিলেন রাজস্থানের জয়পুরে এবং পরে গিয়েছিলেন নয়া দিল্লিতে। নয়া দিল্লিতে এক অজ্ঞাত স্থানে, সাত মাসেরও বেশি সময় ধরে তাঁকে গৃহবন্দী করে রেখেছিল ভারত সরকার। ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে, মহিলাদের অধিকার নিয়ে লেখার স্বীকৃতিস্বরূপ সিমোন দে বোভার পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, পুরস্কার নেওয়ার জন্য প্যারিসে যাননি তসলিমা। তিনি বলেছিলেন, “আমি এখন ভারত ছেড়ে যেতে চাই না। এখানে আমার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করব।” এরপরই তাঁর গৃহবন্দি দশা ঘোচাতে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হয়। তলিমা নাসরিন যাতে নিরাপদে কলকাতায় ফিরতে পারেন, তার জন্য ভারত সরকারকে চাপ দিতে, মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে চিঠি দিয়েছিলেন ভারতের এক প্রাক্তন আমলা। কিন্তু, তাঁর কলকাতায় আর ফেরা হয়নি। ২০০৮ সালের ১৯ মার্চ তাঁকে ভারত ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। এর কয়েক বছর পর, তিনি আবার ভারতে ফিরে আসেন। ততদিনে বাম সরকারের পতন ঘটেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তবে বাংলায় প্রবেশের অনুমতি মেলেনি। ফলে, নয়া দিল্লিতেই থাকছেন তিনি। আজও সেখানেই রয়েছেন ‘নির্বাসিত’ লেখিকা।

তবে এখনও তাঁর মন কলকাতা জন্য কাঁদে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর প্রয়াণের পর তিনি লিখেছিলেন, “আমি ইউরোপ থেকে বাংলা ভাষার টানে, প্রাণের টানে, কলকাতায় বাস করতে গিয়েছিলাম, যেহেতু বাংলাদেশের কোনও সরকারই আমাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেয়নি। কিন্তু আমি কল্পনাও করতে পারিনি নন্দনে যে বুদ্ধবাবুর সঙ্গে সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে আড্ডা দিতাম, প্যারিস থেকে তাঁর জন্য তিনি যা চাইতেন উপহার এনে দিতাম, সেই মানুষটি একসময় আমার বাংলা মা’কে, বাংলায় আমার শেষ আশ্রয়টিকে চিরকালের মতো টেনে নিয়ে যাবেন আমার পায়ের তলা থেকে। মমতা দিদি আমার ব্যাপারে বুদ্ধবাবুরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছেন, সুতরাং তিনিও আমাকে একই অচ্ছুৎ হিসেবে ট্রিট করবেন, এতে অবাক হই না।”