ভ্যাঙ্কুভার: শুনশান রাস্তা, দূর-দূরান্তেও দেখা নেই কাক-চিলের। রাস্তার ধারে যে কয়েকটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তারমধ্যে কোনওটির বনেট গলে গিয়েছে, কোনও গাড়ির আবার কাচ ভেঙে গিয়েছে। এই সব কিছুই হচ্ছে তাপপ্রবাহ(Heat Wave)-র কারণে। গত সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া এই তাপপ্রবাহ ক্রমশ ভয়ানক আকার ধারণ করছে, এ দিকে, শুকনো পাতা থেকে জঙ্গলের আগুন দাবানল(Wild Fire)-র রূপ নিয়েছে। ক্রমশ জনবসতির দিকে ধেয়ে আসছে সেই দাবানল। সব মিলিয়ে ঘরে-বাইরে কোথাওই সুরক্ষিত নন কানাডাবাসী। পরিস্থিতি কানাডা(Canada)-র মতো ভয়াবহ না হলেও খুব একটা সুরক্ষিত নন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমভাগের বাসিন্দারাও। ওয়াশিংটন(Washington), ওরেগন(Oregon)-র তাপমাত্রা পৌঁছেছে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তাপপ্রবাহে বিগত পাঁচ দিনে পশ্চিম কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়াতেই মৃত্যু হয়েছে সাড়ে চারশোরও বেশি মানুষের। ওরেগনে মৃত্যু হয়েছে ৭৯ জনের।
তাপ প্রবাহে যেখানে সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত, সেখানেই দোসর হয়ে জুড়েছে দাবানল। গোটা বিশ্বের প্রায় ১০ শতাংশ দাবানলই কানাডায় হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। আচমকা তাপমাত্রা অতিরিক্ত পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ায় দাবানল লেগেছে ব্রিটিশ কলোম্বিয়ার একাধিক জায়গায়। ইতিমধ্যেই কানাডার অন্যতম জনবহুল শহর ভ্যাঙ্কুভার থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লিটন গ্রাম বুধবার রাতেই সম্পূর্ণ খালি করে দেওয়া হয়েছে। ২০ হাজার একরের এই গ্রামের প্রায় ৯০ শতাংশই পুড়ে গিয়েছে বলে জানা গিয়েছে। ব্রিটিশ কলম্বিয়াতেও দুটি জায়গায় নতুন করে আগুন লাগার খবর মিলেছে।
রেকর্ড ভাঙা তাপ প্রবাহ ও দাবানলের কারণে কানাডার উপরই তৈরি হচ্ছে “ফায়ার স্টর্ম” (Fire Storm), যার ফলে বৃষ্টিপাত না হলেও বজ্রবিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে। ক্রমাগত তাপপ্রবাহ চলতে থাকায় জলীয় বাষ্পের অভাব দেখা দিয়েছে। তার উপর যদি বাজ পড়ে, তবে আরও দ্রুত আগুন ছড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা। কিন্তু আচমকাই এই ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হল কীভাবে?
কানাডা বা আমেরিকার পশ্চিম অংশের তাপপ্রবাহ নিয়ে জানতে গেলে আগে বুঝতে হবে তাপপ্রবাহ কী। টানা কয়েকদিন ধরে যখন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় কয়েক ডিগ্রি বাড়তে থাকে, তখনই তাপপ্রবাহের সৃষ্টি হয়। স্থান বিভেদে তাপপ্রবাহের মাত্রাও আলাদা হয়। যখন বায়ুমন্ডলে উচ্চ চাপের সৃষ্টি হয় এবং গরম বাতাসকে ঠেলে নীচে নামিয়ে দেওয়া হয়, তখনই হিট ওয়েভ (Heat Wave) বা তাপপ্রবাহের সৃষ্টি হয়। শুষ্ক, গরম বাতাস ভূ-পৃষ্ঠের যত কাছাকাছি আসে, ততই তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। হাওয়ার গতি না থাকায় এবং মেঘ না জমতে পারায় তাপমাত্রা আরও বাড়তে থাকে।
কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম অংশেও একইভাবে তাপপ্রবাহের সৃষ্টি হয়েছে। তবে জলীয় বাষ্পের অভাবে ওই অঞ্চল জুড়ে তৈরি হয়ে গিয়েছে একটি হিট ডোম (Heat Dome) বা উষ্ণ বলয়, যা পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলছে।উচ্চ তাপমাত্রায় যখন গরম বাতাস একটি নির্দিষ্ট স্থানের মধ্যে আটকে পড়ে, তখন হিট ডোমের সৃষ্টি হয়। এটি অনেকটি সাইকেলের চাকায় হাওয়া ভরার মতো, যেখানে টায়ারের ভিতরে হাওয়া পাম্প করলে তা গরম হয়ে ওঠে, কিংবা উনুনে ঢাকনা চাপা দিয়ে কোনও কিছু সেদ্ধ বসানোর মতো, যেখানে উষ্ণ বাতাস একটি নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এই হিট ডোম তৈরি হলে আকাশে মেঘও সৃষ্টি হতে পারে না, এ দিকে টানা তাপ প্রবাহ চলায় মাটিতে যে পরিমাণ জলীয় বাষ্প উপস্থিত থাকে, তাও শুকিয়ে যায়। ফলে সূর্যালোক সরাসরি ভূপৃষ্ঠে পড়ে এবং তাপমাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
এ তো গেল তাপ প্রবাহের কথা, এ বার আসা যাক দাবানলের কথায়। কানাডা বা আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলিতে অতি সাধারণ বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে দাবানল। ২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়ার ভয়াবহ দাবানলের কথা নিশ্চয়ই মনে রয়েছে, যেখানে কয়েক মাস ধরে সাড়ে ছয় লক্ষ হেক্টর জমিতে আগুন জ্বলেছিল একাধিক জঙ্গলে। কিংবা ২০১৯ সালের আমাজনের দাবানল, যার কালো ধোঁয়া দেখা গিয়েছিল আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেও। একইভাবে কানাডাতেও আকছার দাবানলের ঘটনা শোনা যায়। কোথাও শুকনো জমিতে আগুন লাগানো থেকে গোটা বন পুড়ে যায়, কোথাও আবার শুকনো পাতা থেকে আপনাআপনিই ছড়িয়ে পড়ে আগুন। কেবল ২০১৮ সালেই ব্রিটিশ কলম্বিয়ার প্রায় ১৩ লক্ষ হেক্টর জমি পুড়ে গিয়েছিল দাবানলে। অতীতে কানাডার দাবানলে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হলেও বর্তমানে প্রশাসনের আগাম সতর্কতা ও তৎপরতায় সেই সংখ্যাটা প্রায় শূন্যে এসে দাঁড়িয়েছে।
তবে এ বারের দাবানল নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন আবহাওয়াবিদরা, কারণ যেই যেই অঞ্চলে আগুন লেগেছে, তার উপরই তৈরি হয়েছে পাইয়োকিউমিলোনিম্বাস (pyrocumulonimbus) বা ফায়ার ক্লাউড (Fire Cloud)। ল্যাটিন ভাষা থেকে উৎপত্তি হওয়া এই শব্দটির অর্থ হল আগুন থেকে তৈরি মেঘ। সাধারণত উষ্ণ কিন্তু জলীয়বাষ্প পূর্ণ বায়ু যখন বায়ুমন্ডলের একটি নির্দিষ্ট স্তরে পৌছয়, তখন আচমকাই তা ঠান্ডা হয়ে যায়। তাপমাত্রার এই হেরফের থেকেই বজ্রবিদ্যুতের সৃষ্টি হয়। কিন্তু যখন দাবানলের উষ্ণতা মাটি থেকে বায়ুমন্ডলে পৌছে মেঘের সঙ্গে মিশে যায়, তখন তা ফায়ার ক্লাউডে পরিণত হয়। বাকি বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাতের মতোই এক্ষেত্রেও মেঘ থেকে বৃষ্টি হলেও তা জলকণার বদলে মাঝেমধ্যে ভারী বাতাসও সরাসরি ভূ-পৃষ্ঠে নেমে আসে, যারফলে আরও দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ক্যালিফোর্নিয়ায় ২৭৫ স্কোয়ার মাইল জুড়ে যে আগুন লেগেছিল, সেটিও এই ফায়ার ক্লাউড থেকেই ছড়িয়ে পড়েছিল।
মূলত শুকনো আবহাওয়া ও ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই দাবানল সৃষ্টি হলেও, এর পিছনে জলবায়ু পরিবর্তনও বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। তাপপ্রবাহ আবহাওয়ারই একটি অংশ হলেও এর পিছনে জলবায়ু পরিবর্তনের হাতও রয়েছে। বিগত কয়েক দশক ধরে দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যপকভাবে আবহাওয়ার পরিবর্তনও হয়েছে। যার জেরে আমরা বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং শব্দটির সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি। তবে জলবায়ুর পরিবর্তন আবহাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটা স্টেরয়েডের মতো কাজ করে। অর্থাৎ যে হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি অনুমান করা গিয়েছিল, তা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে।
কানাডা ও আমেরিকার কিছু অংশের ক্ষেত্রে, বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরেই তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে জলাশয়গুলির জল বাষ্পে পরিণত হতে শুরু হয়েছিল। হিট ডোম সৃষ্টির ফলে সেখানে জলীয় বাষ্পও তৈরি হচ্ছে না এবং সূর্যালোকও তা শোষণ করতে পারছে না। তার ফলে গোটা অঞ্চলেরই তাপমাত্রা আরও বাড়ছে।
আরও পড়ুন: বিশ্লেষণ: আজ নীল রঙে মিশে গেছে ভেজাল…কারা চড়েন জেনে নিন