বিশ্লেষণ: ভেনেজুয়েলায় ১ টাকায় পেট্রল, ভারতে ১০২! নেপথ্যে কার কারসাজি?
যুক্তি যাই থাক, অঙ্ক মিলছে না। আর তার খেসারত গুনতে হচ্ছে আমজনতাকে। তা দেখে নেওয়া যাক কীভাবে?
কলকাতা: প্রথমে ৯৬, তারপর ৯৮, তারপর ১০০। উষ্ণতায় পারদ নয়, এ ভাবেই সেঞ্চুরি টপকেও নট আউট দেশের একাধিক রাজ্য। কীভাবে? পেট্রলের (Petrol) দামে। আর তার প্রভাবে কাড়িকাড়ি টাকা গুনতে হচ্ছে আম আদমিকে। দেশের ৬ রাজ্যে ইতিমধ্যে পেট্রল ১০০ টাকা প্রতি লিটার ছাড়িয়ে গিয়েছে। রাজস্থানের শ্রীগঙ্গানগরে তো ডিজেলও সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ফেলেছে। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে অনতিদূরে বাংলায়ও ১০০ ছাড়াতে পারে পেট্রল। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দামের ওঠানামার জন্য এই পরিস্থিতি দাবি কেন্দ্রের। আরও এক ধাপ এগিয়ে পেট্রলিয়াম মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান জানান, দেশের মানুষকে বিনামূল্যে করোনা প্রতিষেধক তুলে দিতেই না কি এই দামকে জিইয়ে রেখেছে। যুক্তি যাই থাক, অঙ্ক মিলছে না। আর তার খেসারত গুনতে হচ্ছে আমজনতাকে। তা দেখে নেওয়া যাক কীভাবে?
২০১০ সাল পর্যন্ত জ্বালানিতে ভর্তুকি দিত কেন্দ্র। যার ফলে কেন্দ্রই ঠিক করত, খুচরো বাজারে কত দাম হবে পেট্রল-ডিজেলের। কিন্তু ভর্তুকি দেওয়ার দরুন রাজকোষে যেমন ধাক্কা লাগে, রাজনৈতিক কারণেও ক্রমাগত চাপ আসতে থাকে কেন্দ্রের কাছে। দাবি উঠত, লাগাতার পেট্রল-ডিজেলের দাম কমানোর। সেই পরিস্থিতিতে ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সরকার পেট্রল থেকে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ তুলে নেয়। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে দেশের জ্বালানির দাম। ইউপিএ সরকারের দেখানো পথে ২০১৪ সালে ডিজেল থেকে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ তুলে নেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। তখন মাসের ১ তারিখ ও মাসের ১৬ তারিখে খুচরো পেট্রল ও ডিজেলের দাম বদলাত। কিন্তু এই প্রক্রিয়া কার্যকরী না হওয়ায় ২০১৭ সালের ১৬ জুন কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নেয়, বিশ্ব বাজারের ওপর নির্ভর করে রোজ বদলাবে পেট্রল ও ডিজেলের দাম। কিন্তু আদৌ কি বিশ্ববাজারের পরিবর্তনে প্রভাব ফেলছে দেশের পেট্রল-ডিজেলের দামে? উত্তর, একদমই না। গত বছরের জুন মাসের ঘটনা সারা বিশ্ব লকডাউন। স্বভাবতই তেলের চাহিদা কম। বিশ্ববাজারে ব্যারেল প্রতি অপরিশোধীত তেলের দাম হয়েছিল ৩৫.৪৪ ডলার। ২০১৯ সালের জুন মাসের থেকে ২১.৯০ ডলার কম। কিন্তু ভারতে পেট্রলের দাম কমা তো পরের কথা উল্টে বেড়েছিল।
কেন এই উলট পুরাণ?
পেট্রল-ডিজেলের দাম নির্ভর করে বিশ্ব বাজারের ওপর। সেখানে কেন্দ্রের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু সূক্ষ্ম স্তরে কেন্দ্রই বকলমে নিয়ন্ত্রণ করে জ্বালানির দাম। শুল্ক চাপিয়ে কেন্দ্রই ঠিক করে বাজারে জ্বালানির দাম কত হবে। তাই গত বছর জুন মাসে যখন বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ‘নেগেটিভে’ চলে যায় তখন পেট্রলে লিটার প্রতি ১৩ টাকা ও ডিজেলে লিটার প্রতি ১০ টাকা আন্তঃশুল্ক চাপিয়ে দেয় কেন্দ্র। ফলস্বরূপ দাম না কমে উল্টে বেড়ে যায়। পরিসংখ্যান বলছে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার পরই পেট্রল-ডিজেলে রেকর্ড শুল্ক বৃদ্ধি করেছে কেন্দ্র। ২০১৪ সালের মে মাসে পেট্রলের যখন বেস প্রাইস ৪৭ টাকা ১২ পয়সা ছিল, তখন কেন্দ্র শুল্ক বসাত ১০ টাকা ৩৯ পয়সা। এরপর রাজ্যের কর ও ডিলার চার্জ মিলিয়ে লিটার প্রতি পেট্রল দাঁড়াত ৭১ টাকা ৪১ পয়সায়। আর নরেন্দ্র মোদীর সরকার ৭ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ১৬ মে যখন পেট্রলের বেস প্রাইস ৩৪ টাকা ১৯ পয়সা, তখন কেন্দ্র শুল্ক বসাচ্ছে ৩২ টাকা ৯০ পয়সা। সবটা মিলিয়ে অঙ্ক দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৯৩ টাকায়।
তবে শুধু কেন্দ্রকে দোষ দিলে হবে না। একাধিক রাজ্যও কর বৃদ্ধি করেছে। ফলস্বরূপ আজকের দিনে ১০০ ছাড়িয়েছে পেট্রল-ডিজেল। জ্বালানির মোট যে দাম, তার ৬৬ শতাংশই যায় করের পিছনে। অর্থাৎ সরকার চাইলেই কর কমিয়ে আম আদমির সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসতে পারে পেট্রল-ডিজেলকে। কেন্দ্র সরকারের পাশাপাশি একাধিক রাজ্যেও বেড়েছে পেট্রল পিছু কর। ভোটের আগে ফেব্রুয়ারি মাসে পেট্রলে ১ টাকা সেস কমিয়েছিল বাংলা। তাতেও ফল পায়নি আম আদমি। কারণ লাগাতার দাম বৃদ্ধির কাছে ওই ১ টাকা নস্যি।
প্রতিবেশী দেশের কী অবস্থা?
কেন্দ্র জ্বালানি থেকে যখন ভর্তুকি তুলে নেয়, তখন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, কেন্দ্র ভেবেছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে তাই আর ভর্তুকি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। দেশের হাঁড়ির হাল দেখলে বোঝা যাবে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি তো পরের কথা কর্মহীন হয়ে রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধির জেরবার গোটা ভারত। ইতিমধ্যেই মে মাসের হিসেব বলছে ১২.৯৪ শতাংশ সর্বকালীন বেশি মূল্যবৃদ্ধি দেখে ফেলেছে দেশ। এই অধিক পাইকারি মূল্যবৃদ্ধিতে যথেষ্ট অবদান রয়েছে পেট্রল ও ডিজেলের। দেশের জিডিপি রেকর্ড মাইনাসে। মানুষের হাতে টাকা নেই। তখন কোথায় বা খাবার খাওয়ার ক্রয়ক্ষমতা, কোথাও বা গাড়িতে পেট্রল ভরার!
প্রতিবেশী দেশ চিনে প্রত্যেক ব্যক্তির মাসে মাথাপিছু গড় আয় ৭২ হাজার ৬৩ টাকা। সেখানে লিটার প্রতি পেট্রলের দাম ৮১ টাকা ৮৫ পয়সা। আর ভারতে মাসে মাথাপিছু গড় আয় ১৩ হাজার ৩৫৯ টাকা। কিন্তু এখানে পেট্রল লিটার প্রতি ১০২ টাকা ৫৮ পয়সা। যেখান থেকে ক্রয় ক্ষমতা ও পেট্রলের দামের বিষয়টা স্পষ্ট। এমনকি শ্রীলঙ্কাতেও যখন প্রত্যেক ব্যক্তির মাসে মাথাপিছু গড় আয় ২৩ হাজার ৩৫২ টাকা। সেখানেও পেট্রল লিটার প্রতি স্রেফ ৫৯ টাকা ৩৫ পয়সা। ভারতে প্রত্যেক ব্যক্তির প্রায় সম গড় আয় বাংলাদেশে। কিন্তু সেখানেও পেট্রলের দাম ভারতের থেকে অনেক কম। একই অবস্থা ভুটানের ক্ষেত্রেও।
উন্নত দেশে ছবিটা কেমন?
ভাবতেও অবাক লাগে ব্রিটেনে প্রত্যেক ব্যক্তির মাথাপিছু মাসিক গড় আয় প্রায় ২ লক্ষ ৮২ হাজার টাকা। অর্থাৎ ভারতের প্রায় ২৪ গুণ। কিন্তু তাঁকে পেট্রলের জন্য লিটার প্রতি দিতে হয় স্রেফ ১৩৩ টাকা ৬৮ পয়সা। যা ভারতের থেকে মাত্র ৩১ টাকা বেশি। আমেরিকার ছবি দেখলে তো চক্ষু চড়কগাছ। সে দেশে ১ লিটার পেট্রলের দাম স্রেফ ৬৫ টাকা ৩৭ পয়সা। আর একজন মানুষের এক মাসে আয় ৪ লক্ষ ১৬ হাজার ৪৯৯ টাকা। অর্থাৎ ক্রয়ক্ষমতা বেশি থাকলেও পেট্রলে তাঁদের খরচ অনেকটাই কম। সারা বিশ্বের প্রেক্ষাপটে ভারতের পেট্রলের দাম কতটা বেশি, তা আন্দাজ করাই যাচ্ছে।
১ টাকাতেই পেট্রল
যে দেশগুলিতে কাড়িকাড়ি তেল, সেই দেশের পেট্রলের দাম দেখলে আপনার ঘুম উড়ে যেতে পারে। কারণ, ভেনেজুয়েলায় ১ লিটার পেট্রলের দাম স্রেফ ১ টাকা ৪৫ পয়সা। অর্থাৎ ভারতে যে দামে রিক্সাও গড়বে না, সে দেশে তত টাকার পেট্রলে আপনি ৫০ কিলোমিটার পথ গাড়ি চালিয়ে ঘুরে আসতে পারবেন। অন্যান্য তেলউত্তোলনকারী দেশেও পেট্রলের দাম অত্যন্ত কম। ইরানে লিটার প্রতি পেট্রলের দাম ৪ টাকা ৭৩ পয়সা। অ্যাঙ্গোলাতে ১ লিটার পেট্রল কিনতে লাগে ১৮ টাকা ১৪ পয়সা। আলজেরিয়াতে লিটার প্রতি পেট্রলের দাম ২৫ টাকা ৯ পয়সা। কুয়েতে এক লিটার পেট্রল মেলে ২৫ টাকা ৪০ পয়সায়। আবার এমন একাধিক দেশ রয়েছে, যেখানে ২০০ ছুঁইছুঁই পেট্রল। হংকংয়ে ১ লিটার পেট্রলের দাম ১৮২ টাকা, নেদারল্যান্ডসে ১৫৬ টাকা ৬৭ পয়সা, নরওয়েতে ১৫২ টাকা ৫৯ পয়সা, ডেনমার্কে ১৪৫ টাকা ৩ পয়সা।
অর্থাৎ সারা বিশ্ব ঘুরে এসে ভারতে দাঁড়ালে পেট্রলের মহার্ঘতা একটু বেশিই চোখে লাগতে পারে। কারণ এ দেশে খাতায় কলমে কেন্দ্রের হাতে পেট্রল-ডিজেলের দামের নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও বকলমে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের হাতেই। বলা ভাল করের হাতে। বিশ্ব বাজারে দাম কমলে কেন্দ্রীয় সরকার শুল্ক বাড়িয়ে ঠিক মিলিয়ে দেয় অঙ্ক। তাই কখনও পেট্রলের দাম একটু হেলেদুলে আর কখনও সটান বেড়ে যায়। মোটের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই প্রবণতা কার্যত গায়ে শয়ে গিয়েছে সাধারণ মানুষের। তবু গাড়িতে তেল ভরতে গেলে বা বাজারে সবজি কিনতে গেলে একটু চ্যাক করে লাগে। আর খবরের শিরোনামে রোজ আসে পেট্রপণ্য বৃদ্ধির দাম। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে অন্যতম ইস্যু ছিল পেট্রল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি। ক্ষমতায় এসে পেট্রল ডিজেলের দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলন খোদ নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু হিসেব গিয়ে দাঁড়াল পুরো উল্টো। ৭ বছরে কেন্দ্র পেট্রল-ডিজেল থেকে কর তুলে আয় বাড়িয়েছে ৩০০ শতাংশ। আর আরও মহার্ঘ হয়েছে জ্বালানি।
আরও পড়ুন: বিশ্লেষণ: মুকুল রায়কে দলত্যাগ বিরোধী আইনে ‘শাস্তি’ দিতে পারেন শুভেন্দু? কী বলছে সংবিধান…