Sarogate Mother: কলকাতায় ‘ভাড়াটে মা’ হওয়ার প্রবণতা কি বাড়ছে? খরচ কেমন সারোগেসিতে?
Anindita Sarbadhicari: সমাজ কী বলবে, তা নিয়ে কোনদিনই ভাবেননি সাহসী পরিচালক অনিন্দিতা সর্বাধিকারী। তাঁর কথায়, "সমাজের কথা ভাবতে গেলে নিজের কথা ভাবা যায় না। নারীর শরীরের অধিকার নারীরই হাতে থাকা উচিত।" তাই সিঙ্গল মাদার হিসাবে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর বিষয়টি তিনি গোপন রাখেননি।
বিয়ে করিনি তো কী! মা তো হতেই পারি! মা হতে গেলে বিয়ে করতে হবে, একথা কে বলেছে! আজকাল আইভিএফ পদ্ধতির মাধ্যমে তো সিঙ্গল মাদার হওয়া যায়- একথা শুনে হয়তো আজও ভ্রু কুঁচকান জ্যেঠিমা, দিদিমারা। পাড়ার কাকিমা, মাসিমারাও কম গসিপ করবেন না। আর তথাকথিত সমাজের ভয়ে সিদ্ধান্ত ভেবে দেখতে বলবেন মাও। কিন্তু, নিজের জীবন। নিজে উপার্জন করি। সন্তান মানুষ করার সামর্থ্যও রয়েছে। তাহলে আমার জীবন চালানোর অধিকার কেন অন্যের সমালোচনার উপর নির্ভর করবে? নারীর শরীরের অধিকার নারীরই হাতে থাকা উচিত।– এমনটাই ভেবেছিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক অনিন্দিতা সর্বাধিকারী। তাই কোনও কিছুর পরোয়া না করে সিঙ্গল মা হয়েছেন তিনি। কলকাতায় তিনিই সম্ভবত প্রথম সারোগেসি-সিঙ্গল মাদার। যদিও ট্রাডিশনাল সারোগেসি নয়, প্রায় জেস্টেশনাল সারোগেসির পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন অনিন্দিতা সর্বাধিকারী। অর্থাৎ আইভিএফ পদ্ধতির মাধ্যমে নিজের গর্ভেই সন্তান ধারণ করেন তিনি।
ট্রাডিশনাল সারোগেসি, জেস্টেশনাল সারোগেসির কথা শুনে অনেকেই হয়তো অবাক হচ্ছেন। সাধারণত, আমাদের ধারণা, সারোগেসি মানে তো সন্তানের জন্য অন্যের গর্ভ ভাড়া করা। তাহলে ট্রাডিশনাল আর জেস্টেশনাল সারোগেসির প্রভেদ কী?
কলকাতার এক প্রখ্যাত আইভিএফ ক্লিনিকের চিকিৎসক জানান, সারোগেসি মূলত দু’ধরনের হয়। ১) ট্র্যাডিশনাল সারোগেসি এবং ২) জেস্টেশনাল সারোগেসি।
ট্র্যাডিশনাল সারোগেসি- এই পদ্ধতিতে নিঃসন্তান দম্পতির মধ্যে কেবল স্বামীর শুক্রাণু নেওয়া হয় এবং সারোগেট মায়ের ডিম্বাণুই ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ কিছুটা ‘চোরি চোরি চুপকে চুপকে’ সিনেমার মতো। তবে এই সিনেমার মতো সারোগেট মায়ের সঙ্গে সন্তানটির বাবার যৌন সংসর্গ হয় না। কৃত্রিমভাবেই তাঁর শুক্রাণু সারোগেট মায়ের জরায়ুতে প্রতিস্থাপিত করা হয়। অনেক সময় স্পার্ম ডোনারের শুক্রাণুও ব্যবহার করা হয়। মূলত, দম্পতির মধ্যে স্ত্রী বা উভয়ই সম্পূর্ণভাবে সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হলে ট্র্যাডিশনাল সারোগেসির ব্যবহার করা হয়।
জেস্টেশনাল সারোগেসি- এই পদ্ধতিতে দম্পতিরই শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু ব্যবহার করা হয়। IVF-এর মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে তাঁদের শুক্রাণু ও ডিম্বাণু নিষিক্ত করিয়ে সেটা সারোগেট মায়ের জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে সারোগেট মায়ের সঙ্গে সন্তানের কোনও জিনগত মিল থাকে না। অর্থাৎ কোনও মহিলা গর্ভধারণে অক্ষম হলে তিনি কেবল অন্যের গর্ভ ভাড়া নেন। বর্তমানে এই পদ্ধতিই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত।
বলিউড সেলিব্রিটি আমির খান-কিরণ রাও থেকে তুষার কাপুর, একতা কাপুর, পরিচালক করণ জহর, প্রিয়ঙ্কা চোপড়া-নিক জোনাসও জেস্টেশনাল সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান লাভ করেছেন। এমনকি শাহরুখ খানের ছোট ছেলে আব্রামেরও জন্ম হয়েছে সারোগেসির মাধ্যমে। কিন্তু, সাহসলী পরিচালক অনিন্দিতা সর্বাধিকারী এই সোজা পথে হাঁটেননি। তিনি আইভিএফ পদ্ধতির মাধ্যমে ভ্রূণ নিজের গর্ভে ধারণ করেছিলেন। আর সেটা হয়েছিল তাঁর সজ্ঞানে। সেই অভিজ্ঞতা যে কী রোমাঞ্চকর, তা প্রতি মুহূর্তে উপভোগ করেছেন। অনিন্দিতা সর্বাধিকারীর কথায়, “২০১৩ সালের ৩ মে ভ্রুণ আমার গর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়। একটা ছোট্ট সার্জারির মাধ্যমে হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি স্ক্রিনে দেখায় ও সেটা আমি দেখেছি। মনে হচ্ছিল, যেন রিয়েল লাইফ সিনেমা দেখছি। স্ক্রিনে স্পষ্ট দেখি, সাদা ডটগুলো শরীরে ঢুকছে। প্রথম অনুভব করি, গর্ভে সন্তান আসছে। একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছিল। ওই ডটগুলো গর্ভে আসার মুহূর্ত থেকেই আমার সন্তানের পৃথিবীতে আসার যাত্রা শুরু। তারপর আমার গর্ভেই ধীরে-ধীরে বেড়ে ওঠে আমার সন্তান, আমার ছেলে, অগ্নিস্নাত।”
ছেলের ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রাক-মুহূর্তে তার নাম ঠিক করেছিলেন অনিন্দিতা। তাঁর কথায়, “আমার মনে হয়েছিল, সীতা যেমন আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছিল। তেমনই আমার সন্তান আগুনের মধ্য দিয়ে অনেকগুলি বাধা পেরিয়ে পৃথিবীর আলো দেখছে। তাই তার নাম হবে, অগ্নিস্নাত।”
ভ্রূণের গর্ভে প্রবেশ নিয়েও কম কাঠ-খড় পোয়াতে হয়নি অনিন্দিতাকে। চিকিৎসক তাঁর কষ্ট লাঘবের জন্য প্রথমে আইইউআই পদ্ধতির মাধ্যমে মা করানোর চেষ্টা করেছিলেন। আইইউআই পদ্ধতি অনেকটাই সাধারণ মা হওয়ার মতো পদ্ধতি। ঋতুস্রাবের নির্দিষ্ট সময় পর যখন জরায়ুতে ডিম্বাণু আসে, সেই সময় তাঁর শরীরে স্পার্ম ইনজেক্ট করে দেন চিকিৎসক। এরপর সাধারণভাবেই গর্ভে সন্তান আসার কথা। কিন্তু, এই পদ্ধতি সফল হয়নি। পরিচালকের কথায়, “সাধারণভাবে প্রেগন্যান্ট হলে ইউরিন (মূত্র) পরীক্ষা করে জানা যায়। কিন্তু, এক্ষেত্রে রক্ত পরীক্ষা করে জানতে হয়। আমার গর্ভে ভ্রূণ এলেও স্থায়ী হয়নি। ৪ বার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। একবার করে ব্যর্থ হয়, আবার একমাস ঋতুস্রাব পর্যন্ত অপেক্ষা করা। এই ধৈর্য্য আর রাখতে পারছিলাম না। তাই চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করে আইভিএফ পদ্ধতির মাধ্যমে ভ্রূণ নিষিক্ত করিয়ে সেটা আমার গর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়।” এই পদ্ধতিও খুব একটা সহজসাধ্য ছিল না।
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে অনিন্দিতা সর্বাধিকারী জানান, আইভিএফ অর্থাৎ ইন-ভিট্রো-ফার্টিলাইজেশন পদ্ধতিতে যার গর্ভে ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করা হবে, তারপর ঋতুস্রাবের সময় ডিম্বাণুর সংখ্যা বাড়াতে হয়। তার জন্য হরমোন ইঞ্জেকশন দিতে হয়। সেটার অনেক দাম। ৬-৮টি ইঞ্জেকশন দিতে হয়। এরপর স্ক্যান করে দেখে কয়টি ডিম্বাণু এল। তারপর ছোট্ট একটা সার্জারি (এপকিপা পদ্ধতি) করে ডিম্বাণু বের করা হয়। সেগুলি ল্যাবে স্পার্মের সঙ্গে নিষিক্ত করিয়ে রেখে দেওয়া হয়। তার থেকে ভ্রুণ হয়। সেই ভ্রুণ গর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়।
অনিন্দিতা জানান, তাঁর ডিম্বাণু থেকে একাধিক ভ্রূণ হয়েছিল। সেগুলি বিশেষভাবে ফ্রোজেন করে রাখা হয়। প্রথমবার তাঁর গর্ভে ভ্রূণ প্রতিস্থাপিত করার পর তিনি অন্তঃসত্ত্বা হলেও গর্ভপাত হয়ে যায়। যন্ত্রণার কথা তুলে ধরে পরিচালক বলেন, “গর্ভপাতের যন্ত্রণা ছিল প্রসব যন্ত্রণার মতোই। সেটা ছিল ২০১৩-র ফেব্রুয়ারি, সরস্বতী পুজোর দিন। আমি একাই গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হই।” তারপর আবার ওই বছরেরই ৩ মে দ্বিতীয়বার তাঁর গর্ভে ভ্রূণ প্রতিস্থাপিত হয়। গর্ভে ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করানোর পরেও বিষয়টি সহজ হয়নি। কেউ প্রাকৃতিক নিয়মে মা হলে তাঁর শরীরে হরমোনাল অনেক পরিবর্তন হয়, জরায়ুর মাপের বদল ঘটে। অনিন্দিতা সর্বাধিকারীর ক্ষেত্রে পদ্ধতিটি ছিল কৃত্রিম। তাই সন্তানের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য গর্ভাবস্থায় নিয়মিত হরমোনাল ইঞ্জেকশন নিতে হত তাঁকে। এক-একটি ইঞ্জেকশনের দাম ছিল ৬-৮ হাজার টাকা। অনিন্দিতার কথায়, “স্পার্মের থেকে হরমোনাল ইঞ্জেকশনের দাম বেশি।” কেবল অনিন্দিতা নন, সারোগেসি মা বা যাঁরা আইভিএফ পদ্ধতির মাধ্যমে মা হন, তাঁদের সকলকেই প্রায় এই একই চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর অবশেষে ২০১৩-র ২১ নভেম্বর সন্তানের জন্ম দেন, মা হন অনিন্দিতা সর্বাধিকারী। তাঁর কথায়, “সকলে তো সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনটি তার জন্মদিন হিসাবে পালন করে। কিন্তু, ভ্রূণের জন্মদিন কি কেউ পালন করে! আমি সেই দিনটিও জানি। সেই দিনটি থেকেই আমার সন্তান আমার ঔরসে তিল-তিল করে আমার গর্ভে বড় হয়েছে। নিয়মিত তার গ্রোথ চার্ট দেখেছি। তাই আমি আমার ছেলের বছরে দু-বার জন্মদিন পালন করি।”
সমাজ কী বলবে, তা নিয়ে কোনদিনই ভাবেননি সাহসী পরিচালক অনিন্দিতা সর্বাধিকারী। তাঁর কথায়, “সমাজের কথা ভাবতে গেলে নিজের কথা ভাবা যায় না। নারীর শরীরের অধিকার নারীরই হাতে থাকা উচিত।” তাই সিঙ্গল মাদার হিসাবে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর বিষয়টি তিনি গোপন রাখেননি। তবে সমাজ থেকেও অনাদর পাননি। বরং প্রথম শুভেচ্ছাবার্তা, চকোলেটের বাক্স আসে প্রতিবেশী এক ঘরোয়া গৃহবধূর থেকে। তারপর প্রথম ফোন আসে সিপিআইএম নেতা ও আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্যের থেকে। অর্থাৎ সমাজের উঁচু এবং সাধারণ- দুই স্তর থেকেই অভ্যর্থনা পেয়েছেন অনিন্দিতা। তাঁর কথায়, “সমাজ তো আমাদের থেকে আলাদা নয়। আমরাই তো সমাজের মানসিকতা গড়ে তুলব।” এরপর সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার দু-ঘণ্টার মধ্যেই ছেলের জন্ম সার্টিফিকেট পান তিনি। তাঁর ছেলের জন্ম সার্টিফিকেটই কলকাতা পুরসভায় প্রথম বাবার নাম ছাড়া হয়েছে।
এরপর অবশ্য রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী সাধন পাণ্ডের মেয়ে শ্রেয়া পাণ্ডে-সহ কলকাতার অনেকেই আইভিএফ পদ্ধতিতে সারোগেসির মাধ্যমে সিঙ্গল মাদার হয়েছেন। আবার বলি তারকাদের মতো কলকাতার অনেক দম্পতিও সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান লাভ করেন। অন্যের গর্ভ ভাড়া করলে অবশ্য খরচটা খানিক বেশি হয়।
নদিয়া জেলার কল্যাণীর এক দম্পতি সুমনা-সুজয় (নাম পরিবর্তিত) বিয়ের ১৪ বছর পর তাঁরা কলকাতার এক আইভিএফ সেন্টারের মাধ্যমে সারোগেসি মায়ের সাহায্যেই সন্তানের মুখ দেখেছেন। তাঁরা জানান, সারোগেসি মায়ের হদিশ পাওয়া, গর্ভ ভাড়া থেকে সন্তান প্রসব পর্যন্ত তাঁর যাবতীয় চিকিৎসা, থাকা-খাওয়ার খরচ- পুরোটাই আইভিএফ সেন্টারের মাধ্যমে করা যায় এবং এর জন্য বিশেষ প্যাকেজ থাকে। সারোগেসি পদ্ধতিতে একটি সন্তানের জন্য ১৫ লক্ষ টাকা থেকে ৩০ লক্ষ টাকার প্যাকেজ রয়েছে। সারোগেসি পদ্ধতির প্রকার অনুযায়ী প্যাকেজের কম-বেশি হয়। অর্থাৎ কেবল গর্ভ ভাড়া দিলে একরকম প্যাকেজ, সারোগেসি মায়ের কেবল ডিম্বাণু নিলে একরকম প্যাকেজ, ডিম্বাণু ও গর্ভ- দুটোই নিলে প্যাকেজ বাড়বে, আর শুক্রাণু, ডিম্বাণু, গর্ভ নিলে প্যাকেজের দাম সবচেয়ে বেশি। কলকাতায় গর্ভ ভাড়া দেওয়ার বার্ষিক বাজার এখন কোটি টাকার উপরে বলে জানালেন এক আইভিএফ সেন্টারের প্রবীণ বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসক। সবমিলিয়ে বলা যায়, বর্তমানের ব্যস্ত জীবনযাত্রায় দিনে-দিনে চাহিদা বাড়ছে সারোগেসি মায়ের। তবে এখনও যে এই বিষয়ে অনেক ভুল ধারণা, সামাজিক ছুঁৎমার্গ রয়েছে, তা বলা বাহুল্য।
কিন্তু কথাতেই আছে, ‘যা মহাভারতে নেই, তা ভারতে নেই।’ হিন্দু মহাকাব্য, মহাভারতে গান্ধারীর শতপুত্রের জন্ম পদ্ধতির মাধ্যমে সারোগেসি ধারণার উল্লেখ রয়েছে। বেশ কয়েকবার গর্ভপাতের পর ঋষি ব্যাসদেবের শতপুত্রের জননী হওয়ার আশীর্বাদ দেন গান্ধারীকে। এক কন্যাসন্তানেরও বর আদায় করে নেন গান্ধারী। ব্যাসদেবের আশীর্বাদ পেয়ে ফের ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে গর্ভবতী হন গান্ধারী। কিন্তু, সেবারও তাঁর গর্ভপাত হয়। তবে ব্যাসদেবের বর বিফলে যেতে পারে না। গর্ভপাতের পর গান্ধারীর গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা মাংসপিণ্ড থেকে ১০১টি ভ্রুণ আলাদা করে ১০১টি ঘিয়ের কলসীতে রাখেন ব্যসদেব। তারপর নির্দিষ্ট সময়ের পর প্রথম কলসী থেকে জন্ম নেন দুর্যোধন। তার একমাস পর বাকি ১০০টি কলসী থেকে জন্ম নেন ৯৯ পুত্র ও ১ কন্যাশিশু। দুর্যোধন-সহ এঁরা সকলেই ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর সন্তান হিসাবে পরিগণিত হন। ১০০ ভাইয়ের একমাত্র বোনের নাম দুঃশলা। – এটা বর্তমান যুগের সারোগেসি ছাড়া আর কী-ই বলা যায়! আমাদের প্রাচীন মহাকাব্যে যখন এই পদ্ধতির উল্লেখ রয়েছে, তাহলে বাস্তবিক জীবনে এটা প্রয়োগে অসুবিধা কোথায়? সারোগেসি পদ্ধতির মাধ্যমে যদি নিঃসন্তান দম্পতি মা হওয়ার আস্বাদ পায়, তাহলে সমস্যা কোথায়? সামাজিক ছুঁৎমার্গ, মা-ঠাকুমাদের ভ্রু কোঁচকানোর জবাবে উঠে আসে এই প্রশ্নই।
কলকাতার এক আইভিএফ সেন্টারের আধিকারিক জানান, কলকাতায় সারোগেসি পদ্ধতি চালু হয়েছিল ২০০৬ সালে। তবে ২০১২ সালের পর থেকে এই পদ্ধতির চাহিদা বেড়েছে। সমীক্ষা ঘেঁটে জানা গিয়েছে, কলকাতার যে সব প্রতিষ্ঠানে ২০১১-১২ সালে বছরে মাত্র ৫-৭টি নিঃসন্তান দম্পতি সারোগেট মাদারের মাধ্যমে সন্তান পেত, ২০১৫ -১৬ সালে সেই সব প্রতিষ্ঠানেই সারোগেসি সন্তানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০টি। তারপর গত ৮ বছরে এই সংখ্যা প্রায় ৫০ হয়েছে। অর্থাৎ গর্ভ ভাড়া নেওয়ার নিরিখে মুম্বই, চেন্নাইয়ের থেকে খুব একটা পিছিয়ে নেই কলকাতা। এই শহরে সারোগেসি পদ্ধতিতে সন্তানলাভের সাফল্যের হারও তাৎপর্যপূর্ণ, প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ বলে দাবি কলকাতার এক আইভিএফ সেন্টার কর্তৃপক্ষের। এই বিষয়টি নিয়ে ছুঁৎমার্গও অনেকটা কমেছে বলে তাঁর দাবি। তবে বাণিজ্যিকভাবে সারোগেসি মা-কে যাতে ব্যবহার না হয়, তার জন্য ভারত সরকার কঠোর আইন করেছে।
সারোগেসি নিয়ে ভারত সরকারের আইন
সারোগেসি পদ্ধতির প্রসার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে বহু মহিলা অভাবের তাড়নায় গর্ভ ভাড়া দেওয়া শুরু করেন। অনেক সময় দেখা যায়, একজন মহিলা বহুবার, এমনকি দু-বছরে পরপর দু-বার গর্ভ ভাড়া দিয়ে মোটা টাকা উপার্জন করেছেন। অর্থাৎ পুরো বিষয়টি বাণিজ্যিক আকার নিতে শুরু করে। এতে গর্ভদাত্রী মহিলার স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এমনকি গর্ভস্থ সন্তানও দুর্বল হতে পারে। এই ঘটনা আটকাতেই বিশেষ আইন জারি করে ভারত সরকার।
১) ভারত সরকারের আইনে ‘বাণিজ্যিক সারোগেসি’ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে যে কেউ যে কারও সন্তানের জন্য গর্ভ ভাড়া দিতে পারবে না বলে আইন জারি করেছে ভারত সরকার। আইনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, সন্তানের পিতা-মাতার কাছের কোনও আত্মীয় ছাড়া অন্য কেউ গর্ভ ভাড়া দিতে পারবেন না। যদিও বিভিন্ন দেশে ‘বাণিজ্যিক সারোগেসি’ প্রচলিত রয়েছে।
২) সন্তানের বাবা-মা সারোগেট মায়ের কেবল চিকিৎসার খরচ বহন করতে পারেন। তাছাড়া আর কোনও টাকা দেবেন না।
৩) একবারের বেশি সারোগেট সন্তান ধারণ করা যাবে না। একবারের বেশি সন্তান ধারণ করলে ১০ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।
৪) যদি কেউ বাণিজ্যিক সারোগেসি করেন অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে গর্ভ ভাড়া দেন, তাহলে ওই সারোগেট মা-সহ যে দম্পতি সাহায্য নিচ্ছে, তাদেরও ৫ বছর পর্যন্ত জেল এবং ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
যদিও এই আইনের চোখে ধুলো দিয়ে দেশজুড়ে সারোগেসি ব্যবসা চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অর্থাৎ কেবল শারীরিক অক্ষমতার কারণ নয়, গর্ভ ধারণের ঝক্কি এড়াতেও অনেকে সারোগেসির সাহায্য নিচ্ছেন। আর তার ব্যবস্থা করে দেয় আইভিএফ সেন্টারই। সাধারণত, স্পার্ম ডোনারের মতো সারোগেসি মায়ের পরিচয়ও গোপন রাখা হয়। বন্ধ্যাত্ব রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. গৌতম খাস্তগীর এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, “সন্তান চাইছেন অথচ ১০ মাস গর্ভে ধারণ করতে পারবেন না, এরকম অনেক দম্পতি আমাদের কাছে এসে সরাসরি বলছেন, সারোগেসি চাই।” আবার অনেক দম্পতি দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা করানোয় ধৈর্য ও আস্থা রাখতে না পেরে সারোগেসির সাহায্য নিচ্ছেন, এমন নজিরও রয়েছে। তবে বয়স থেকে স্বাস্থ্যের বিভিন্ন দিক বিবেচনা করেই সারোগেট মা নির্বাচন করা হয়।
সারোগেট মা হওয়ার যোগ্যতা
কেউ চাইলেই সারোগেট মা হতে বা গর্ভ ভাড়া দিতে পারেন না। এর জন্য বিশেষ যোগ্যতার প্রয়োজন। যেমন, সারোগেট মায়ের বয়স হতে হবে ২৫ থেকে ৩৫-এর মধ্যে। হেপাটাইটিস, থ্যালাসেমিয়া বা বিশেষ কোনও জিনগত অসুখ থাকলে গর্ভ ভাড়া দেওয়া যাবে না। ধূমপান, মদ্যপান বা কোনও ড্রাগের নেশা থাকলে চলবে না। একজন একবারের বেশি সারোগেসি হতে পারবেন না বলেও আইন জারি করেছে ভারত সরকার।
এছাড়া যে কারও ভ্রুণ যে কেউ বহন করতে পারে না। দম্পতির শুক্রাণু ও ডিম্বাণু থেকে কৃত্রিম উপায়ে ভ্রুণ নিষিক্ত করার পর সেটি নির্দিষ্ট করা সারোগেসি মায়ের শরীরে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব কি না, সে বিষয়ে উভয় পক্ষেরই অনেক শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। সবকিছু মিললেই কৃত্রিমভাবে ওই ভ্রুণ বা শুক্রাণু সারোগেসি মায়ের জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়।
সারোগেসি মায়েদের যত্নে বিশেষ হস্টেল
আইভিএফ সেন্টারের পাশাপাশি নিঃসন্তান দম্পতির সরাসরি সারোগেসি মায়ের সাহায্য নেওয়ার ঘটনাও রয়েছে। আবার সারোগেসি মায়েদের ৯-১০ মাস থাকা ও দেখাশোনার জন্য অনেক হস্টেলও গড়ে উঠেছে শহরে। বিভিন্ন সংস্থা এরকম হস্টেল ভাড়া দেয়। তারা কেবল সারোগেসি মায়েদের থাকতে দেয় না, টাকার বিনিময়ে তাঁদের চিকিৎসা করানো থেকে যত্ন-আত্তিরও ব্যবস্থা করে। দক্ষিণ কলকাতায় এরকম হস্টেল রয়েছে। আবার অনেক ব্যবসায়ী, সেলিব্রিটি তাঁদের সন্তানের সারোগেসি মা-কে ভিন রাজ্য বা বিদেশে প্রতিপালন করেন, এদেশের আইনের বেড়াজাল এড়াতে অনেকে বিদেশে সারোগেসি ভাড়া করে সন্তানসুখ নেন, এমন নজিরও রয়েছে।
সবমিলিয়ে বলা যায়, বদলাচ্ছে যুগ, বদলাচ্ছে মানসিকতা। সমস্ত ছুঁৎমার্গের ঊর্ধ্বে থাকুক সন্তান।