AQI
Sign In

By signing in or creating an account, you agree with Associated Broadcasting Company's Terms & Conditions and Privacy Policy.

ঈশ্বরের কথা বলার অধিকার শুধুই ব্রাহ্মণদের রয়েছে? শাস্ত্র আর ইতিহাস কী বলছে?

ঈশ্বরের ভক্তি ও তাঁর গুণকীর্তন কি শুধুই জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া অধিকার? আর যদি কোনও অ-ব্রাহ্মণ ভগবানের কথা বলেন, তাহলে তাঁকে তাঁর শাস্তি পেতে হবে? চুল কেটে, মাথা মুড়িয়ে, গোমূত্র মাথায় ঢেলে অপমান করা হবে তাঁকে? এই একবিংশ শতাব্দীতেও এমনটা চলতে পারে?

ঈশ্বরের কথা বলার অধিকার শুধুই ব্রাহ্মণদের রয়েছে? শাস্ত্র আর ইতিহাস কী বলছে?
Image Credit: AI Image
| Edited By: | Updated on: Jul 01, 2025 | 8:11 PM
Share

হেমন্ত শর্মা

জাতপাতের ভেদাভেদ মানুষকে অমানুষ করে তোলে। আচ্ছা, ঈশ্বরের কথা বলার অধিকার শুধুই কি ব্রাহ্মণদের রয়েছে? সম্প্রতি এমনই এক বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যা শুধু হাস্যকরই নয়, অত্যন্ত নিম্নরুচিরও বটে।

ঈশ্বরের ভক্তি ও তাঁর গুণকীর্তন কি শুধুই জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া অধিকার? আর যদি কোনও অ-ব্রাহ্মণ ভগবানের কথা বলেন, তাহলে তাঁকে তাঁর শাস্তি পেতে হবে? চুল কেটে, মাথা মুড়িয়ে, গোমূত্র মাথায় ঢেলে অপমান করা হবে তাঁকে? এই একবিংশ শতাব্দীতেও এমনটা চলতে পারে?

যদিও ধর্মকে পেশা বানানো কিছু মানুষ এর পক্ষেই যুক্তি দিচ্ছেন। যার থেকে লজ্জাজনক বোধহয় আর কিছুই হতে পারে না। এই সব লোকেরা ঈশ্বরের ভক্তও হতে পারেন না। কারণ, ভক্তির জগৎ একেবারে আলাদা। এটি অঙ্ক, বিজ্ঞান বা যুক্তির জগৎ নয়। এটা প্রেম, প্রার্থনা ও পরমাত্মার জগৎ।

এই বিতর্কের উত্তর বারবার রয়েছে আমদের প্রাচীন সমৃদ্ধ ইতিহাসে। সমস্যা অন্য জায়গায়। তা হল আমাদের ধর্মান্ধতা। আমরা জাতপাতে ভাগে অন্ধ। দেখেও দেখি না। অথচ ভারতীয় ধর্ম ও সাধুসন্তদের ইতিহাসে নজর দিলেই বোঝা যায় এই বিভাজনের কোনও মানেই হয় না।

যাঁরা কেবলমাত্র জাতিগত যোগ্যতার ভিত্তিতে ঈশ্বরের কথা বলার পক্ষে যুক্তি দেন, তাঁরা হয়তো জানেন না যে আমাদের ধর্মীয় ইতিহাসের দুই প্রধান গ্রন্থ — রামায়ণ ও মহাভারত। এই দুই মহাকাব্যই অ-ব্রাহ্মণদের দ্বারা রচিত। রামায়ণ লিখেছেন বাল্মীকি, যিনি ছিলেন শূদ্র। মহাভারত লিখেছেন মহর্ষি বেদব্যাস, যিনি এক মৎস্যজীবিনী গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পুরাণের কথক সূতজী-ও ব্রাহ্মণ ছিলেন না, ছিলেন শূদ্র। অর্থাৎ ঈশ্বরের কথা বলার অধিকার জাতিতে নয়, জ্ঞানে, যোগ্যতায় এবং ভক্তিতে।

২১ জুন উত্তরপ্রদেশের ইটাওয়ার দাঁদরপুর গ্রামে যা ঘটে, তা কেবল লজ্জাজনকই নয়, আমাদের ধর্মীয় সমাজ কাঠামোকে ধ্বংস করার মতো ঘটনা। মুকুট মণি যাদব নামের এক অ-ব্রাহ্মণ কাহিনীকার এবং তাঁর দুই সহযোহীকে শুধু তাঁদের জাতের জন্য মারধর করা হয়, টিকি কেটে দেওয়া হয়। গোমূত্র ঢেলে ‘শুদ্ধিকরণ’ করা হয়। অথচ বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শনের প্রবর্তক রামানুজাচার্য এক হাজার বছর আগেই এই জাতপাতের বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন। তিনি মন্দিরের অধিকার অ-ব্রাহ্মণদের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন — “ব্রাহ্মণ্যত্ব জন্মে নয়, আচরণে নির্ধারিত হয়।”

রামানন্দ, কবীর, রৈদাস, সেন, ধন্না, দাদু দয়াল, রজ্জব, নামদেব, তুকারাম থেকে তুলসীদাস — এঁরা কেউই কিন্তু ব্রাহ্মণ ছিলেন না। বরং অনেক সাধুই ছিলেন নিম্নবর্ণের। একবার ভাবুন তো ভক্তি আন্দোলন যদি ব্রাহ্মণদের ভরসায় থাকত তাহলে কী হত? বৈষ্ণব শাস্ত্রে ৬৪ ধরনের অপরাধের উল্লেখ রয়েছে। যার মধ্যে একটি অপরাধ হল ‘ভক্তদের মধ্যে ভেদাভেদ করা।’ অর্থাৎ সকল ভক্তই সমান।

তুলসীদাস নিজেও জাতিগত আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “ধূর্ত বল, রজপুত বল, জোলাহা বল — আমি কেবল রামের দাস।”

মহাভারতে যুধিষ্ঠির নিজেও বলেছেন, “যদি কোনও শূদ্রের মধ্যে সত্য ও সদগুণ থাকে এবং কোনও ব্রাহ্মণের মধ্যে না থাকে, তবে সেই শূদ্র শূদ্র নয়, সেই ব্রাহ্মণও ব্রাহ্মণ নয়। যার মধ্যে এই গুণ আছে সেই ব্রাহ্মণ।” জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ যদি বেদ না জানেন, লোভী হন, কামুক হন, তবে তিনি ব্রাহ্মণ হতে পারেন না।

সত্যিকারের সাধু তাঁকেই বলা হয়, যার মন, বাক্য ও দেহে পরোপকারের ভাব থাকে।

জাতিভিত্তিক বিতর্কের সমাধান চাইলে ফিরে তাকাতে পারি রামানুজাচার্যের জীবনের দিকেও। ১২০০ শতাব্দীর প্রথম দিকে শ্রীরঙ্গম মন্দিরের প্রধান হন তিনি। তিনি মন্দির পরিচালনায় সমস্ত জাতির মানুষকে যুক্ত করেছিলেন। শূদ্রদের কাঁধ ধরে গিয়েছিলেন স্নানে — যাতে অহংকার ভেঙে যায়।

গোপনে পাওয়া গুরু মন্ত্র সকলের সামনে ঘোষণা করে বলেছিলেন — “আমার নরক যাওয়া মেনে নেব, যদি তাতে হাজারো মানুষের মুক্তি হয়।”

আজ এক হাজার বছর পরেও আমরা জাতির প্রমাণপত্র চাইছি — এটা আমাদের জড়তা, অজ্ঞানতা ও সংকীর্ণতার পরিচয়। অথচ রামানুজ বলেছিলেন — “ভোজন আলাদা হলেও, ভজন একসাথে হওয়া উচিত।”

সত্যিকারের ভক্তি যদি প্রেম, ভক্তি, সমর্পণ ও আন্তরিকতা থাকে, তবে কোনও জাতিগত, সামাজিক, ধর্মীয় প্রাচীর তা ঠেকাতে পারে না।