Shlok Mukherjee: ‘25 বছর পরের ভারত’-এর ছবি এঁকে বিশ্বদরবারে চর্চিত কলকাতার 9 বছরের পড়ুয়া
ছোট্ট ছেলেটার এক আকাশ ভাবনা। 25 বছর পরে ভারতকে এই বিশ্ব কোন জায়গায় দেখবে, তা ফুটিয়ে তুলে গুগলের ডুডল আঁকো প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে কলকাতার নয় বছরের শ্লোক মুখোপাধ্যায়। ছোট্ট বয়সে কীভাবে এই বিরাট ভাবনা এল, বাড়ির ঘরানা, ভবিষ্যতে কী হতে চায় সে— এই সবকিছু নিয়ে TV9 বাংলার সঙ্গে আড্ডা দিল ছোট্ট শ্লোক। সঙ্গে ছিলেন তার অভিভাবকরাও।
সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়
Doodle For Google 2022 Champion: ‘ভাবো, ভাবা প্র্যাক্টিস করো’, বলে গিয়েছিলেন মিস্টার ঘটক। কাঁকুড়গাছির ছোট্ট ছেলেটা যা ভাবল, গুগল তার হোমপেজে সারাদিন তা-ই টাঙিয়ে রাখল। দিনটা 14 নভেম্বর, শিশু দিবস। সে দিন বিশ্ববাসী গুগল স্যরের কোচিং সেন্টারে গিয়ে যাই অনুসন্ধান করেছেন, নজরে এসেছে কলকাতার শ্লোক মুখোপাধ্যায়ের আঁকা ছবি। প্রতি বছর শিশু দিবসে ‘ডুডল ফর গুগল’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে সার্চ ইঞ্জিন জায়ান্ট গুগল। ভারতের প্রায় 100-রও বেশি শহর থেকে 1 লাখ 15 হাজার ছবি জমা হয়েছিল। সেই প্রতিযোগিতাতেই সেরার সেরা হয়েছে বাংলার শ্লোক। ছবির বিষয়বস্তু ছিল ‘বিশ্বমঞ্চে ভারত’ (India On The Center Stage)। সেখানে দেখা গিয়েছে, রোবটের হাত ধরে রয়েছে মানুষ। আর সেই ছবি যার আঁকা, যার মস্তিষ্কপ্রসূত, তার বয়স মাত্র নয় বছর। নিউটাউনের দিল্লি পাবলিক স্কুলের পড়ুয়া শ্লোক মুখোপাধ্যায়।
ছোট্ট বয়সে এই বিরাট ভাবনা, সত্যিই অভাবনীয়। শ্লোকের বাবা সুমন মুখোপাধ্যায় পেশায় ফটোগ্রাফার। TV9 বাংলাকে বললেন, “আমাদের বাড়ির ঘরানাটাই ওরকম। শ্লোকের এই ছবি যে গুগলের মাধ্যমে গোটা বিশ্ব দেখল, তার কৃতিত্বটা আমার ভাইয়ের।” শ্লোকের কাকা সায়ন মুখোপাধ্যায় পেশায় একজন ইলাস্ট্রেটর। স্বাভাবিকভাবেই ছোট্টবেলা থেকে তার চোখ তৈরি হয়েছে বাবার তোলা ছবি আর কাকার আঁকা ছবি দেখেই। “ওর আঁকার হাতটা তৈরি করেছে আমার ভাই। আসলে ভাই-ই প্রথম গুগলের এরকম একটা প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছিল। ছোট্ট থেকেই ও এমন সব ছবি আঁকত, এমন ভাবনা মেলে ধরত যে, আমরাও অবাক হয়ে যেতাম। আমার ভাই ওর ছবিগুলো নিয়মিত দেখে, আর শেখায়—ও যাতে ঠিক ট্র্যাকে যায়, সেই দিকটা নিশ্চিত করতেই এসব কিছু করে আমার ভাই সায়ন।”
ছোট্ট শ্লোকের মাথায় কীভাবে এল এই ভাবনা
“দুর্গাপুজোর চতুর্থী বা পঞ্চমীর দিন আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, এবার শিশু দিবসে ‘ডুডল ফর গুগল’-এর থিম ’25 বছর পরের ভারত’ (India After 25 Years)। শ্লোক সেটা জানার পর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিল শুধু এটা ভেবে, কী হয় দেখা যাক”, বললেন শ্লোকের বাবা। তারপর তিনি এবং তাঁর স্ত্রী দু’জনে মিলে শ্লোক-কে আইডিয়া ‘শর্টলিস্ট’ করতে সাহায্য করেন। সুমনের কথায়, “যে ছ’টা দিন ধরে ও ডুডলটা শেষ করে, তার বেশিরভাগ সময়টাই চিন্তাভাবনার জন্য অতিবাহিত করেছিল। তবে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জটা ছিল, যেটা ভাবল, সেটা হুবহু ফুটিয়ে তোলা অর্থাৎ আইডিয়ার এগজ়িকিউশন।” এ দিকে, ভাবনা নিয়ে ছোট্ট শ্লোকের বক্তব্য, “আমি একটা নোটবুক নিয়ে বসে যাই আয়ুর্বেদ, মহাকাশ ভ্রমণ এবং প্রকৃতি-সহ যে বিষয়গুলো আমি আঁকতে চেয়েছিলাম, তার একটা লিস্ট তৈরি করি। প্রত্যেকটা টপিকের জন্যই আমি আইডিয়াটা লিখেছিলাম। ভারতকে বিশ্বমঞ্চে দেখাতে চেয়েছিলাম আমি, যেখানে মানুষ দেশের প্রশংসা করবেন।”
ভাবনার বাস্তবায়ন প্রতিটা Google এর প্রতিটা অক্ষর ধরে-ধরে:
ইংরেজি শব্দ Google এর প্রতিটা অক্ষর শ্লোক তার ডুডলে অন্যভাবে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিল
সুখবরটা যখন এল
জমা দেওয়ার দিন কুড়ি পরে শ্লোক জানতে পারে যে, তার ডুডল সেরা 20-র মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। তাকে এবং তার পরিবারকে দিল্লিতে ডাকা হয়, যেখানে আরও ফাইনালিস্টরা গিয়েছিল। শ্লোকের বাবা সুমন যোগ করলেন, “আমাদের বলা হয়েছিল, 14 নভেম্বর ঠিক রাত 12টার সময় গুগলের হোমপেজটা একবার চেক করতে। সেখান থেকেই জানতে পারব, কে এই ডুডল প্রতিযোগিতায় জিতল। আমরা রাতে দেখিনি। সকালে যখন গুগলের হোমপেজ দেখি, তখন আমরা অবাক। এই এক লক্ষ পনেরো হাজার প্রতিভার মধ্যে থেকে গুগল যে শ্লোকের ছবিটাই বেছে নেবে, ধারণাও ছিল না আমাদের। আমি ভেবেছিলাম, সেরা কুড়ির মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে, এটাই অনেক। চূড়ান্ত ফলাফল দেখে সত্যিই হতবাক হয়ে যাই।”
ঢাকিদের নিয়ে কাঁকুড়গাছিতে গুগল
প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার জন্য গুগলের কাছ থেকে ছোট্ট শ্লোক পেয়ে গিয়েছে 5 লাখ টাকার কলেজ স্কলারশিপ, 2 লাখ টাকার টেকনোলজি প্যাকেজ (তার স্কুল বা নন-প্রফিট অর্গানাইজেশনের জন্য), একটি সার্টিফিকেট, এই সাফল্য অর্জনের জন্য একটা ট্রফি, গুগলের হার্ডওয়্যার ডিভাইস এবং কিছু মজাদার গুগল কালেক্টিবলস। গুগল যেভাবে তাকে পুরস্কৃত করেছে, তা সবথেকে বেশি আনন্দ দিয়েছে ছোট্ট শ্লোককে। তবে এসবের মধ্যে সেরা পুরস্কারটার কথা মনে করিয়ে শ্লোক বলল, “গুগলের লোকেরা একটা স্যুটকেস নিয়ে এসেছিল, যাতে 174টা রঙের একটা প্যাক ছিল।”
গিটারেও অনবদ্য সুর তোলে ছোট্ট শ্লোক
শ্লোকের মা পেশায় একজন জ্যোতিষী। মেডিটেশন করেন, আয়ুর্বেদশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়েও তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ। পারমিতা চট্টোপাধ্যায় বললেন, “ওর যা বয়স, সেই তুলনায় ও অনেকটাই পরিণতমনস্ক। স্কুলে ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড হতে না পারলেও রেজ়াল্ট বরাবরই ভাল করে। আমরা বেশি চাপ দিই না। কারণ, ওর আরও অনেক কিছুতে আগ্রহ রয়েছে। ওকে কোনওদিন ‘পড়তে বস’ বলতে হয়নি আমাকে।” শ্লোকের ছবিতে যে স্পিরিচুয়ালিটির একটা প্রভাব রয়েছে এবং তা যে মায়ের কাছ থেকেই এসেছে, সে কথাও হাবেভাবে বুঝিয়ে দিলেন পারমিতা।
খুশিতে আত্মহারা শ্লোকের স্কুলের প্রিন্সিপাল
শ্লোকের এহেন সাফল্যে খুব খুশি হয়েছেন দিল্লি পাবলিক স্কুল, নিউটাউনের প্রিন্সিপাল সোনালি সেন। বলছেন, “ছোট্ট বয়সে ওর ভাবনাটা যে অনেক বড়, তা আমরা আগেই বুঝেছিলাম। রোবটিক্স থেকে শুরু করে আয়ুর্বেদ— সব বিষয় নিয়ে ওর চিন্তাভাবনা অন্যরকম। শ্লোক খুব মিষ্টি একটা ছেলে। গিটার বাজায় খুব সুন্দর। ও আমাদের গোটা স্কুলকে খুবই গর্বিত করেছে। আমরা খুব খুশি। ওর এই প্রতিভাকে সামনের দিনে যত্ন সহকারে লালনপালন করার দায়িত্বটাও আমাদের।”
এরপর…
সে আঁকে খুব ভাল, যার স্বীকৃতি দিয়েছে খোদ গুগল। অতিপ্রাকৃতিক বিষয়ের প্রতি তার তীব্র ঝোঁক। তার চারপাশের মানুষজনের কাছে এই ধরনের ছবি কার্ড আকারে পৌঁছেও দিতে চায় সে। ভবিষ্যতে এমন আরও অনেক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে চায় ছোট্ট শ্লোক। তার স্বপ্ন, “আমি একজন বিজ্ঞানী, গিটার প্লেয়ার এবং শিল্পী হতে চাই।”