বিশ্লেষণ: করোনা কাঁটায় নির্বাচন না হলে প্রশ্নের মুখে মমতার মুখ্যমন্ত্রিত্ব! কী বলছে আইন?

উপনির্বাচন না হলে মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়(Mamata Banerjee)-র কাছে। একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী তিরথ সিং রাওয়াত(Tirath Singh Rawat)-র ক্ষেত্রেও।

বিশ্লেষণ: করোনা কাঁটায় নির্বাচন না হলে প্রশ্নের মুখে মমতার মুখ্যমন্ত্রিত্ব! কী বলছে আইন?
অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস।
Follow Us:
| Updated on: Jun 26, 2021 | 1:42 PM

নয়া দিল্লি: নন্দীগ্রামে প্রতিপক্ষ শুভেন্দু অধিকারীর কাছে হেরে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। তবুও তিনি মুখ্যমন্ত্রী। ছয় মাসের মধ্যে তাঁকে জিতে আসতে হবে। তবেই তিনি এই পদে বহাল থাকবেন। কিন্তু বাধ সেধেছে করোনা। প্রশ্ন উঠছে, তৃতীয় ঢেউ যদি আছড়ে পড়ে, তাহলে কি উপনির্বাচন করা সম্ভব হবে? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রশ্ন তুলে দ্রুত নির্বাচন করার দাবি তোলেন বুধবার সাংবাদিক বৈঠকে। এমনকি এই নির্বাচন দেরি হওয়ার আশঙ্কা করে সরাসরি অভিযোগ শানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী(Narendra Modi)-কেই। তাঁর অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রীর ইশারায় নির্বাচন কমিশন চলে। তাই এ দিন প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করে তিনি বলেন, “এই নির্বাচনটা ক্লিয়ার করে দিন।” অর্থাৎ উপনির্বাচন না হলে মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী তিরথ সিং রাওয়াত(Tirath Singh Rawat)-র ক্ষেত্রেও। পূর্ব মুখ্যমন্ত্রী তিবেন্দ্র সিং রাওয়াতকে নিয়ে নেতা-মন্ত্রীদের মধ্যে নানা সমস্যা দেখা দেওয়ায় গত ১০ মার্চ উত্তরাখণ্ডের নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন তিরথ সিং রাওয়াত।

আইন কী বলে?

সংবিধানের ১৬৪(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ছয় মাসের মধ্যে বিধানসভার সদস্যপদ অর্জন না করতে পারলে মন্ত্রিত্ব পদ ছাড়তে হবে। উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রে আগামী ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জিতে আসতে হবে।

লোকসভার ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, তিরথ সিং রাওয়াত ২০১৯ সালে গারওয়াল কেন্দ্র থেকে জয়লাভ করেন এবং তিনি এখনও লোকসভার সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দেননি। অথচ মুখ্যমন্ত্রীর পদে টিকে থাকার জন্য তাঁকে বিধানসভার উপ নির্বাচনে জয়লাভ করতেই হবে।  এই পরিস্থিতিতে বিজেপির শীর্ষনেতৃত্ব আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেই এই সমস্যার সুরাহা খোঁজার চেষ্টা করছেন বলেই জানা গিয়েছে।

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস।

দেশে যে সময়ে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছিল, সেই সময়ই পাঁচ রাজ্যে নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনের জন্য কেন্দ্র সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। সেই বিষয়টিকে মাথায় রেখেই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হওয়া অবধি নির্বাচন হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।

উপ-নির্বাচনবিধিতে ছাড়ও রয়েছে সংবিধানে-

বিধায়ক পদে জয়লাভ করে মুখ্যমন্ত্রী পদ টিকিয়ে রাখার নিয়ম থাকলেও দুটি ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে এই নিয়মে। পিপলস অ্যাক্ট ১৯৫১-র মাধ্যমে আইনি বিধিতে ফাঁক খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। ১৫১এ ধারা অনুযায়ী, সংবিধানের উপ-নির্বাচনের নিয়ম থেকে রেহাই পাওয়া যায় দুটি শর্তে। ১. যদি মুখ্যমন্ত্রী পদের মেয়াদ এক বছরের কম সময় হয়। ২. যদি নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেয় যে ওই নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে উপ-নির্বাচন করানো সম্ভব নয়।

উত্তরাখণ্ডের ক্ষেত্রে, ২০১৭ সালে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ায় তিরথ সিং রাওয়াতের মুখ্যমন্ত্রী পদের মেয়াদ এক বছরের কম সময়েই শেষ হয়ে যাবে। অর্থাৎ উপ-নির্বাচন হোক কিংবা না, মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরতেই হবে। তবে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে যেহেতু গত মে মাসেই মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেক্ষেত্রে তাঁকে নির্বাচন কমিশন ও কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের উপরই নির্ভর করতে হবে।

তবে মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রে আরও একটি পথ খোলা রয়েছে, সেটি হল ছয় মাসের মেয়াদকাল শেষ হওয়ার আগে পদত্যাগ করে ফের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে তিনি আরও ছয় মাসের বাড়তি সময় পাবেন। এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পঞ্জাবের কংগ্রেস নেতা তেজ প্রতাপ সিং মন্ত্রী পদে বসেছিলেন বিধায়ক না হওয়া সত্ত্বেও। ১৯৯৬ সালের মার্চে তাঁর ছয় মাসের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তিনি ইস্তফা দেন এবং ফের সেই মন্ত্রী পদেই পুনর্বহাল হন।

Mamata GFX

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস।

গত বছর এপ্রিল মাসে মহারাষ্ট্রেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে প্রথমে বিধান পরিষদের মাধ্যমে নিজের নাম মনোনীত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজ্যপাল ভগৎ সিং কোশিয়ারি তা আটকে দেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বিধান পরিষদের মাধ্যমেই মুখ্যমন্ত্রী পদে বহাল থাকেন।

নির্বাচন কমিশন কি আগে কখনও এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে?

জম্মু-কাশ্মীর সহ একাধিক জায়গায় বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে উপ-নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয় বলে নির্বাচন কমিশন জানালেও মুখ্যমন্ত্রীর পদের ক্ষেত্রে তারা বরাবরই উপ-নির্বাচনের নিয়মের উপরই জোর দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, কোভিড পরিস্থিতিতে এখনও অবধি উত্তরাখণ্ড বা পশ্চিমবঙ্গের উপ-নির্বাচন নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। যদি কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনায় উপনির্বাচন করানোর সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন, তবে ভবানীপুর আসন থেকেই নির্বাচনে লড়বেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

উপ-নির্বাচন নিয়ে কী মত বিরোধী নেতাদের?

কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী এই বিষয়ে বলেন, “নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই নির্বাচন করাতে হবে। এটি কমিশনের বিষয়। তবে এই বিষয়টিও মাথায় রাখা উচিত যে এ রাজ্যে ১১২ টি পুরসভার নির্বাচন বাকি। কোনও কোনও পুরসভায় একবছর, দুই বছর বা তিন বছর ধরে নির্বাচন হয়নি। রাজ্য় সরকারকে সেই নির্বাচনগুলি করানোর বিষয়েও উদ্যোগী হতে হবে।”

অন্যদিকে, TV9 বাংলার তরফে বিজেপি নেতা রাহুল সিনহার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এটি রাজনৈতিক বিষয় নয়, সাংবিধানিক বিষয়। সুতরাং এই বিষয়ে আগ বাড়িয়ে কিছু বলব না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেন, ” যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উপ-নির্বাচন না হয়, তবে মুখ্যমন্ত্রী মেয়াদ শেষের দিনই পদত্যাগ করে ফের নতুন করে তিনি শপথ নিতে পারবেন, এক্ষেত্রে সংবিধানে কোনও বাধা নেই। ২০১৬ সালেও নির্বাচনের পর উপ-নির্বাচন নভেম্বর মাসে হয়েছিল। এক্ষেত্রেও নভেম্বর মাসেই উপ-নির্বাচন হতে পারে। তাছাড়া উপ-নির্বাচন করানোর দায় নির্বাচন কমিশনের, রাজ্যের নয়। সংবিধান এই দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের উপরই দিয়েছে।”

আরও পড়ুন: ‘একজন পড়ুয়ার মৃত্যু হলেও দায়ী থাকবে রাজ্যই’, দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা নিয়ে ‘সুপ্রিম’ হুঁশিয়ারি