Sign In

By signing in or creating an account, you agree with Associated Broadcasting Company's Terms & Conditions and Privacy Policy.

পৃথিবীর নাম হোক পঁচিশে বৈশাখ

আমি জাপানে যাইনি। শুনেছি সেখানে রবীন্দ্র রচনাবলী নিয়মিত মুদ্রিত হয় এবং সেটা বেস্ট সেলার। চিনেও শুনেছি তাই। তাইওয়ানে আমি গিয়ে দেখেছি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বিরাট চর্চা হচ্ছে।

পৃথিবীর নাম হোক পঁচিশে বৈশাখ
Follow Us:
| Updated on: May 09, 2021 | 10:41 AM

সুবোধ সরকার: ২০০৭ সালে আমি গ্রিসে গিয়েছিলাম কবিতা পড়তে। রাজধানী এথেন্স খুব বড় জায়গা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখেছিলাম। আজ থেকে ৫০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে, তাঁর লেখা নিয়ে যে উচ্ছ্বাস সারা পৃথিবীতে দেখা গিয়েছে, সেটা এখন কিছুটা কমের দিকে। তবু একটা গল্প বলি। ২০০৭-এ গ্রিসে গেলাম। এথেন্স থেকে জলযানে ভূমধ্যসাগরের ওপর সাড়ে তিন ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে ওপারে গেলাম। ওপারটা সুদূর দ্বীপপুঞ্জ। ছোট ছোট পাহাড়, তাঁর মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলে গিয়েছে। বাইজেন্টাইন সভ্যতার পথ ধরে এগিয়ে গিয়েছে। সেখানে সব চেয়ে বড় একটা দ্বীপ প্যারোস। সেখানে আমরা ১৪টা দেশের লেখক একসঙ্গে ছিলাম।

একদিন সকালবেলায় দুই লেখকবন্ধুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। ছোট ছোট পাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে গলির ভেতর দিয়ে একটা ছোট্ট গ্রামে পৌঁছলাম। সেখানে খুব সুন্দর একটা বাড়ি দেখাতে পেলাম। বাড়ির বাগানে রয়েছে একটা রেস্তোরাঁ। সেখানে বসে সবাই ব্রেকফাস্ট করছে। দেখে আমার খুব ভাল লেগে গেল। ভেতরে ঢুকলাম দুই বন্ধুকে নিয়ে। ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিলাম।

দোকানি ভদ্রমহিলা ভাঙা ইংরেজি জানেন। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। আমাকে জিগ্যেস করলেন– তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ? আমি বললাম ভারত থেকে। সে শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল– ‘তাগোর, তাগোর’। তাঁর গ্রিক উচ্চারণ শুনে অবাক হয়ে গেলাম। এ কী শুনি! ভূমধ্যসাগর ছাড়িয়ে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে একটা গ্রামে এলাম, বাড়ির মালকিন রেস্টুরেন্ট চালান, সে রবীন্দ্রনাথের নাম জানে! এ ঘটনায় আমি বিস্মিত হয়েছিলাম।

subodh sarkar

তার মানে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, ২০০৭ সালে গ্রিসে খুব বেশি রবীন্দ্রচর্চা হচ্ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের যে আন্তর্জাতিক জনপ্রিয়তা, ছোট ছোট নানা জায়গায় তার রেশ রয়ে গিয়েছে। আমি জাপানে যাইনি। শুনেছি সেখানে রবীন্দ্র রচনাবলী নিয়মিত মুদ্রিত হয় এবং সেটা বেস্ট সেলার। চিনেও শুনেছি তাই। তাইওয়ানে আমি গিয়ে দেখেছি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বিরাট চর্চা হচ্ছে। এটা অবশ্য অনেক আগে, ১৯৯২ সালের কথা বলছি।

এবার যে জায়গাটির কথা বলব সেটা হল আইওয়া। ২০১৬ সালে ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে আমি আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য পড়াতে গিয়েছিলাম। এছাড়া আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় সেখানকার ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামে। সেখানে মার্কিন কবি ক্রিস্টোফার মেরিল, যিনি এই মুহূর্তে লেখক শিবিরের অধিকর্তা। এক পার্টিতে কথা বলতে বলতে তিনি বললেন– রবীন্দ্রনাথ আইওয়ায় একবার এসেছিলেন কথাটা ভুল। তিনি এখানে দু’বার এসেছিলেন। প্রথম এসেছিলেন ১৯১১ সালে, নোবেল প্রাইজ পাওয়ার আগে। দ্বিতীয় বার এসেছিলেন নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পরে। দু’বারের সমস্ত রেকর্ড রয়েছে আইওয়া ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে। আমি সেই রেকর্ড কিছুটা দেখেছিলাম। আমি তখন ক্রিস্টোফার মেরিলকে জিগ্যেস করেছিলাম উনি এখানে এলেন কীভাবে?

কল্পনা করা যায় না আইওয়া জায়গাটা এমন! কাছাকাছি সব চেয়ে বড় শহর শিকাগো। সেখান থেকে দ্রুতগামী গাড়িতে এলেও আইওয়া আসতে প্রায় চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা সময় লাগে। অথবা শিকাগো থেকে ছোট প্লেন ধরে আইওয়ায় আসতে হয়। এগুলো তো কিছুই ছিল না ১৯১১ সালে! চারপাশে শুধু ভুট্টাখেত। ভুট্টাখেত এখনও আছে। আইওয়া ভুট্টার জন্য বিখ্যাত। এবং সারা পৃথিবীতে লেখক শিবিরের জন্য বিখ্যাত। আমি শুনে অবাক হয়েছিলাম যে, রবীন্দ্রনাথ এখানে একবার নয়, দু-দু’বার এসেছিলেন! এখানে তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন। ধর্ম বিষয়ে বলেছেন। আন্তর্জাতিকতাবাদ বিষয়ে বলেছেন। সবই বিস্ময়কর ঘটনা।

এসব থেকেই বোঝা যায় নোবেল পাওয়ার আগেই রবীন্দ্রনাথ কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। নোবেল পাওয়ার পরে তাঁর বিশ্বজোড়া খ্যাতি শীর্ষ স্পর্শ করেছিল। তবে আমি যখন আইওয়ায় গিয়েছি সেখানে দিনে তিনবার সালমান রুশদির নাম শুনেছি। কিন্তু চারমাসে আমি কাউকে রবীন্দ্রনাথের নাম বলতে শুনিনি। সব কিছুই জোয়ার ভাটা থাকে। এখন যেন আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথের জল নেমে গিয়েছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, আবার জোয়ার আসবে। রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া এই পৃথিবী অচল। এই পৃথিবীকে বাঁচতে হলে রবীন্দ্রনাথকে দরকার। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের মুক্তচিন্তা ও আন্তর্জাতিকতাবাদ– সেটাই একমাত্র পৃথিবীকে বাঁচাতে পারে, ভারতবর্ষকে পারে। আমি গতকাল যে কবিতাটা লিখেছি তার শেষ লাইন এমন– পৃথিবীর নাম হোক পঁচিশে বৈশাখ।