ভদ্রলোক যেন সমস্ত উত্তরগুলো তাঁর বিরাট জোব্বার পকেটে লুকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন: মির্চি অগ্নি

আজকের এই ধ্বস্ত সময়ে তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া ‘ফেম’-এর জগৎ ভেদ করে কীভাবে ফিরে-ফিরে আসেন রবীন্দ্রনাথ? লিখছেন আরজে মির্চি অগ্নি।

ভদ্রলোক যেন সমস্ত উত্তরগুলো তাঁর বিরাট জোব্বার পকেটে লুকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন: মির্চি অগ্নি
গ্রাফিক্স: অভিজিৎ বিশ্বাস
Follow Us:
| Updated on: May 09, 2021 | 12:20 PM

সোশ্যাল  মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার—প্রতি মূহূর্তে ‘লাইকস’, ‘কমেন্টস’, ‘শেয়ার’-এর মানদণ্ডে মাপা হয় যে ‘পাবলিক প্রপার্টি’-কে। এহেন এক তরুণ ‘পাবলিক প্রপার্টি’ যখন তাঁর একান্ত ‘প্রাইভেট স্পেস’-এ বিচরণ করেন, তখন তাঁর চিন্তা-চেতনায় কীভাবে ফিরে-ফিরে আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? লিখছেন রেডিও জকি তথা সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার মির্চি অগ্নি

‘‘আমার মনে হয় রবি ঠাকুরের বয়স কখনও ১৫০ হতেই পারে না। আমার রবি ঠাকুরের বয়স এখন ৩৫। …. রবি ঠাকুর এরকমই। যেখানে যখন যার যত বয়স, তাঁর রবি ঠাকুরের তখন তত বয়স।’’ – শ্রীজাত

সেই দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। আকাশ থমথমে। সঙ্গে আমাদের বাড়িও। দিদিমণি (মায়ের মা)-কে ভেন্টিলেশনে দেওয়ার কথা হচ্ছে। হয়তো আর রাখা যাবে না। সকালে দেখতে গিয়েছিলাম হাসপাতালে। দুপুরে কলেজ যাওযার সময় পথেই শুনলাম, সব শেষ। যখন কেওড়াতলা মহাশ্মশানে ঢুকছি, বারবার একটা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বছর পাঁচেক আগে স্ট্রোক হয়ে দিদিমণির কথা বন্ধ হয়ে যায়। আমি গেলেই খাতায় গোটা-গোটা হরফে লিখত, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’। অর্থাৎ গান শোনাতে হবে। শেষ অ্যাটাকটা হওয়ার তিন দিন আগে শুনিয়েছিলাম। ‘‘সঙ্কটে সম্পদে থাকো কল্যাণে, থাকো আনন্দে নিন্দা-অপমানে। সবারে ক্ষমা করি থাকো আনন্দে, চির-অমৃতনির্ঝরে শান্তিরসপানে॥’’ গান করতে-করতেই দেখেছিলাম, দিদিমণির চোখ বুজে এসেছে। টপটপ করে কয়েক ফোঁটা জল আমার হাতের ওপর পড়েছিল। চুপ করে বসেছিল। বলা হয়নি, ছোটবেলায় ‘দুই বিঘা জমি’ আর ‘পূজারিণী’ আবৃত্তি করে ঘুম পাড়াতো দিদিমণি।

সেই দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। স্কুলের ২৫শে বৈশাখের অনুষ্ঠানে পাঞ্জাবি-পাজামা পরে প্রথম স্টেজে উটেছিলাম। মাথা দুলিয়ে-দুলিয়ে গেয়েছিলাম: ‘‘রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান, মোদের খাটো ক’রে রাখেনি কেউ কোনো অসত্যে– নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?’’ তখন বুঝিনি। সহজ সুর বলে মনের আনন্দে গেয়েছিলাম। যতদিন যাচ্ছে, ধারণা পাল্টাচ্ছে। ভারতীয় গণতন্ত্রের মূল কথা বোধহয় এটাই…

Radio Jockey Mirchi Agni Shares His Memories About Tagore

নিজস্ব চিত্র

সেই দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। উচ্চ-মাধ্য়মিক পরীক্ষা আর গানের স্কুল (গীতবিতান)-এর অন্তিম বর্ষের পরীক্ষা প্রায় একই সঙ্গে পড়েছে। গীতবিতানের পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগের মুহূর্ত অব্দি মনে হয়েছে, কিছুই পড়া হয়নি। কী লিখব? তৈরি হওয়ার সুযোগই পাইনি। কিন্তু অবাক কাণ্ড! পরীক্ষাগৃহে ঢুকেই চোখ পড়ল দেওয়াল-জোড়া রবি ঠাকুরের ছবির দিকে। মনে পড়ে গেল, যখনই বিপদে পড়েছি, এই মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। ভাবটা এমন, দেখতে তো পাচ্ছো বুঝতে পারছি না। বলে দাও না! আর ওই ভদ্রলোক যেন সমস্ত উত্তরগুলো তাঁর বিরাট জোব্বার পকেটে লুকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন। পরীক্ষা দিলাম। ফল প্রকাশিত হল। দেখলাম লেটার মার্কস না-পেলেও সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছি।

আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথের কাছে মৃত্যু এবং জীবন যেন দিন এবং রাত্রির সংযোগস্থল: অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়

সেই দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। বড়মামার স্মরণসভা। খুব ন্য়াওটা ছিলাম বড়মামার। ইডেন গার্ডেন্সে আমার প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ দেখা তাঁর সঙ্গে। থাকতেন মাসকটে। স্মরণসভায় গাওয়ার জন্য় ‘গীতবিতান’ খুলেছিলাম। ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে’র কথাগুলোয় একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। সে দিন সন্ধেবেলা আমাদের ফ্ল্যাটের এক বাচ্চার অন্নপ্রাসন। মা বের করল ‘শিশু’। গিফ্ট কার্ডে লিখল, ‘জগৎ-পারাবারের তীরে/ছেলেরা করে মেলা…’

সেই দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। জয়েন্ট এন্ট্রান্স এগজ়্যামিনেশন। এগজ়্যাম হলের বাইরে দেখেছিলাম ভীত-সন্ত্রস্ত বন্ধুদের। উসকো-খুশকো, রাত জাগা চেহারা। তাদের পাশে চোখে-মুখে পাহাড়প্রমাণ প্রত্যাশা নিয়ে মা-বাবার দল। বহুদিন আগে এক দীর্ঘদেহী মানুষ খসখস করে লিখে চলেন, ‘‘আমাদের দেশে এখানে দূরে-দূরে গুটিকয়েক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে বন্ধ নিয়মে যান্ত্রিক প্রণালীতে ডিগ্রি বানাবার কারখানাঘর বসেছে… আমাদের দেশের বিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তকের পরিধির মধ্য়ে জ্ঞানচর্চার যে সংকীর্ণ সীমা নির্দিষ্ট আছে কেবলমাত্র তাই-ই নয়, সকল রকম কারুকার্য শিল্পকলা নৃত্যগীতবাদ্য নাট্যাভিনয় এবং পল্লীহিতসাধণের জন্য় যে-সকল শিক্ষা ও চর্চার প্রয়োজন সমস্তই এই সংস্কৃতির অন্তর্গত বলে স্বীকার করব।’’ (রবীন্দ্র রচনাবলী, প্রবন্ধ ‘বিশ্বভারতী’)

RJ Agni On Rabindranath Tagore

নিজস্ব চিত্র

সেই দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। এক বিখ্য়াত গায়ক-গীতিকার একটি পত্রিকায় ইন্টারভিউ দিলেন। বললেন, ‘এফএম স্টেশনগুলো আমার গান না-বাজালেও সেগুলো হিট হবে।’ এর ঠিক তিন মাস পর তিনি ফোন করে আমায় অনুরোধ করেছিলেন তাঁর নতুন অ্যালবামের গান যদি রেডিয়োয় বাজানো যায়। বহুদিন আগে এক দীর্ঘদেহী মানুষ খসখস করে লিখে চলেন, ‘‘আধুনিক কালের মানুষের ধারণা যে, বিজ্ঞাপনের দ্বারা সংকল্পের ঘোষণা করতে হয়। এতে ভয় পাই, এ দিকে লক্ষ্য হলে সত্য়ের চেয়ে খ্যাতিকে বড় করা হয়। সত্য স্বল্পকে অবজ্ঞা করে না, অবাস্তবকে ভয় করে, তাই-ই খ্যাতির কোলাহলকে আশ্রয় করতে সে কুণ্ঠিত। কিন্তু আধুনিক কালের ধারণা, ব্যাপ্তির দ্বারা কাজকে বিচার করা, গভীরতার দ্বারা নয়। তাঁর পরিণাম হয় গাছের ডালপালার পরিব্যাপ্তির  মতো, তাতে ফল কম হয়।’’ (রবীন্দ্র রচনাবলী, প্রবন্ধ ‘বিশ্বভারতী’)

সেই দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। ৯ই নভেম্বর, ২০১৯। রাম মন্দিরের রায় প্রকাশিত হল। রায় নিয়ে অনেকের অনেক মতামত, অনেক বক্তব্য়। অথচ বহুদিন আগে এক দীর্ঘদেহী মানুষ খসখস করে লিখে চলেন – ‘‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে। নাস্তিক সেও পায়ে বিধাতার বর, ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।’’

সেই দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। রাত তিনটে। ফোন বাজার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। আইসিইউ বেড চাই। অতি দ্রুত অক্সিজেন স্যাচুরেশন ড্রপ করছে। তৎক্ষণাৎ আমার ফেসবুক পেজে একটা পোস্ট দিলাম। মুহূর্তের মধ্য়ে অনেক কমেন্টস। একই সঙ্গে ফোন করলাম দু’-তিনটে দলকে। যে দলের ছেলেমেয়েদের গড় বয়স ১৮-২০। পনেরো মিনিটের মধ্যে ব্যবস্থা হয়ে গেল। হওয়ারই ছিল… বহুদিন আগে সেই মানুষটি যে লিখে গিয়েছেন- ‘‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা… তোরে হেথায় করবে সবাই মানা। হঠাৎ আলো দেখবে যখন ভাববে এ কী বিষম কাণ্ডখানা। সংঘাতে তোর উঠবে ওরা রেগে, শয়ন ছেড়ে আসবে ছুটে বেগে, সেই সুযোগে ঘুমের থেকে জেগে লাগবে লড়াই মিথ্যা এবং সাঁচায়। আয় প্রচণ্ড, আয় রে আমার কাঁচা।’’

Epidemic Criticality & The Relevance of Tagore

নিজস্ব চিত্র

সেই দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। সেই সমস্ত দিন যা আমার কাছে প্রতিদিন হয়ে রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যাচার, ট্রোলিং এবং ধর্মের নামে বিভাজন দেখে-দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তবু আমি বিশ্বাস করি, দেশের এই ‘অচলায়তন’ অবস্থা একদিন ঘুঁচবেই। অন্তর হবে বিকশিত, নির্মল, উজ্জ্বল, সুন্দর। ততদিন অব্দি– ‘‘তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর, এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।’’

গ্রাফিক্স: অভিজিৎ বিশ্বাস