পঁচিশে বৈশাখ আজও আমাকে ডাক দেয়
পঁচিশে বৈশাখ উপলক্ষে অনেক কবিতা পত্রিকা প্রকাশ হত

অমর মিত্র: দিল ডাক, পঁচিশে বৈশাখ। পঁচিশে বৈশাখ আজও আমাকে ডাক দেয়। রবীন্দ্র শতবর্ষে আমি বসিরহাটের লাগোয়া দণ্ডীরহাট গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। ওই গ্রামের স্কুলে পড়তাম। আমাদের স্কুলে খুব বড় করে রবীন্দ্র শতবর্ষের অনুষ্ঠান হয়েছিল। আমি তখন ক্লাস সিক্স। রবীন্দ্রনাথের ওপর একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সেটা পাঠ করেছিলাম। শিক্ষকরা প্রশংসা করেছিলেন। ‘ছাত্রর পরীক্ষা’ প্রহসনে আমি ছাত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম। আমার সহপাঠী নির্মল মাস্টারমশাইয়ের রোল করেছিল। বেত উঁচিয়ে তার কী অভিনয়! গোঁফ লাগিয়ে বালক হয়েছিল শিক্ষক। সেই নির্মল কোথায় এখন, জানি না। নির্মল শৈশবই হারিয়ে গেছে।
আমাদের ছেলেবেলায় পাড়ায় পাড়ায় রবীন্দ্র জন্মোৎসব পালন করা হত প্রায় এক মাস ধরে। কিশোর কিশোরীরা মঞ্চ বেঁধে বাড়ির ছাদে, পাড়ার রাস্তার ধারে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করত। হত রবীন্দ্রনাথের গান। গানের সঙ্গে নাচ। নাটক বা নাট্যাংশ অভিনয় করা হত। পাড়ার দাদারা ছিলেন নাটকের নির্দেশক। রবীন্দ্রনাথের ‘বলাই’ গল্পটি এক দাদার নির্দেশে আমি নাট্যরূপ দিয়েছিলাম।
১৯৬৭ সালের কথা মনে আছে। তখন কলকাতার স্কুলে। স্কুলে বড় করে রবীন্দ্র জয়ন্তী হয়েছিল। দেওয়াল পত্রিকা বের করেছিলাম আমরা। সেখানে আমি রবি ঠাকুরকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলাম। ‘মুকুট’নাটকে আমি ধুরন্ধরের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম। একবার ‘বিনি পয়সার ভোজ’একক অভিনয়ের প্রহসনটিকে আমি চরিত্র ভাগ করে মঞ্চস্থ করেছিলাম। তখন আমি ক্লাস নাইন। নিজে করেছিলাম অক্ষয়বাবুর চরিত্রে অভিনয়। সাড়া পেয়েছিলাম। বহু মানুষ দেখতে এসেছিল। সেই রবীন্দ্র জন্মোৎসবে পাড়ার গোপালদা গেয়েছিলেন গান– চলে যায় মরি হায় বসন্তের দিন চলে যায়। আমার এখন মনে হয় গোপালদার হয়তো প্রেমে ব্যর্থতা ছিল। তাই তিনি সেদিন গেয়েছিলেন হৃদয় উজাড় করা গান। এই হল আমার শৈশব কৈশোরের রবীন্দ্রনাথ।
এরপর যখন একটু বড় হলাম তখন তখনকার রবীন্দ্র জয়ন্তী আলাদা। রবীন্দ্র সদনে প্রাতঃকালে হত কবি প্রণাম অনুষ্ঠান। বাংলার শ্রেষ্ঠ গায়কেরা গান গাইতেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে নবীন গায়কেরা আসতেন। ভোরবেলায় আমি শুনেছি দেবব্রত বিশ্বাস, শান্তিদেব ঘোষের গান। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, সুমিত্রা সেন সকলে রবীন্দ্র সদনে এসে কবি প্রণামে এসে গাইতেন।
কবিপ্রণাম জোড়াসাঁকোতেও হত। জোড়াসাঁকোয় খুব যাওয়া হত না। কিন্তু গিয়েওছি। তবে রবীন্দ্র সদনের আকর্ষণ ছিল আলাদা। পঁচিশে বৈশাখ উপলক্ষে অনেক কবিতা পত্রিকা প্রকাশ হত। সম্পাদকেরা এসে বিক্রি করতেন। বিলিও করতেন। তাঁদের পাওয়াও ছিল বড় পাওয়া। কবিরা অনেকে আসতেন। দেখলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে। তারাপদ রায়কে। আসতেন অনেক তরুণ কবি। যোগব্রত চক্রবর্তী, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, নিশীথ ভড়দের কথা মনে পড়ে। আমি তখন কলেজে পড়ি, সবে লিখব লিখব করছি। আমার চোখে তখন সকলি নবীন, আমার চোখে তখন সকলি সবুজ। পরম বিস্ময়।
একবার পঁচিশে বৈশাখের ভোরবেলা সপরিবারে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে গিয়েছিলাম। সবাই ঘুরে ঘুরে দেখেছিল রবীন্দ্রনাথের বাড়ি। সেই নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। এখনও আমি এইসব পঁচিশে বৈশাখের ডাক পাই। এখনও পঁচিশে বৈশাখের ভোরে মনে হয় যাই ছুটে রবীন্দ্র সদনে। এক সময় ২ নম্বর বাসের দোতলায় চেপে বন্ধুরা যেতাম রবীন্দ্র সদন। তখন সবে আলো ফুটছে, আমরা রবীন্দ্র সদনে এসে নামতাম। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে প্রথম দিকের আসনে বসে পড়তাম। সেই ভোর হারিয়ে গেছে অনেক দিন, অনেক বছর। কয়েক বছর ধরে অপরাহ্নবেলায় পঁচিশে বৈশাখ পালন হয় রবীন্দ্র সদনে। এখন কোভিড পরিস্থিতিতে আর কিছুই সম্ভব নয়। তবে ভোরের পঁচিশে বৈশাখ ফিরে আসা দরকার। ভোরের স্নিগ্ধতায় রবি প্রণামের সুরই ছিল আলাদা।
হ্যাঁ, চিৎপুরে জোড়াসাঁকোর আগে, রবীন্দ্র কাননে এক মাস ধরে রবীন্দ্রমেলা হত। গান, আবৃত্তি, নাটক, নৃত্যনাট্য নিয়ে সেই আয়োজন ছিল অসামান্য। আমি সেই মেলাতেই দেখেছি ডাকঘর, রাজা, মুক্তধারা নাটক, শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য। সন্ধ্যা ছটা থেকে রাত সাড়ে দশটা অবধি হত সেই রবীন্দ্রমেলা। কবে বন্ধ হল জানি না। পাড়ায় রবি প্রণাম, প্রভাত ফেরিও বন্ধ হল কবে মনে নেই।





