বামেদের নির্বাচনী মিটিংয়ের প্রচারে ‘আমরা সবাই রাজা’ শোনা একটা নতুন অভিজ্ঞতা: সৃজন ভট্টাচার্য
অর্থনৈতিক অসাম্য যে সাধারণ জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বীজ সহজে বপন করে ফেলার অন্যতম প্রাকশর্ত, তা বিলক্ষণ জানতেন রবীন্দ্রনাথ। যখন ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড’ ঘোষণা করছে, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি তাকে ধিক্কার জানিয়ে বলছেন, এ হল আসল সমস্যা থেকে নজর ঘোরানোর ছল।
এই তো সেদিন। মফস্বলে ভোটের প্রচারে সভা করতে গিয়েছি। তখনও সভা শুরু হয়নি, মাইকে বাজছে বামেদের চিরাচরিত গানগুলি, ‘‘পথে এবার নামো সাথী’’ বা ‘‘কারা মোর ঘর ভেঙেছে স্মরণ আছে’’। এসএফআই-এর ছেলেমেয়েরা বায়না ধরল, ‘টুম্পা সোনা’ আর ‘লুঙ্গি ডান্স’-এর সুরে যে দু’টো প্যারোডি ব্যাপক হিট হয়েছে, সে দুটো চালাতে হবে। অতঃপর এসব ক্ষেত্রে যা হয়, নানা মুনির নানা মত, এবং কোনটা বেশি গ্রহণযোগ্য—তা নিয়ে তর্কবিতর্ক অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠা। আমি এক পাশে দাঁড়িয়ে চা খেতে-খেতে গল্প করছিলাম স্থানীয় পার্টিনেতার সাথে। বয়সে প্রৌঢ় ভদ্রলোক খানিক দেখলেন, তারপর মুচকি হেসে ছাত্রদের বললেন, ‘‘তোরা নতুন গান চাস, তাই তো? আমাদের পরিচিত ধাঁচের বাইরের কিছু, অথচ সাম্যের কথা, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথাগুলোই ফুটিয়ে তুলবে, এমন কিছু, তাই তো?’’ ছাত্ররা সমস্বরে বলল, ‘‘হ্যাঁ।’’ ভদ্রলোক বললেন, ‘‘ইউটিউবে সার্চ কর, ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে।’ দ্যাখ তো কেমন লাগে।’’
এসএফআই, ডিওয়াইএফআই-এর সভায় ‘বাঁধ ভেঙে দাও’ বা ‘আমরা নূতন যৌবনেরই দূত’ অবধি শুনেছি, বামেদের নির্বাচনী মিটিংয়ের প্রচারে ‘আমরা সবাই রাজা’ শোনা একটা নতুন অভিজ্ঞতা তো বটেই। সব্বার মনে ধরল বলাই বাহুল্য। রবীন্দ্রনাথ, সব প্রজন্মকে মেলালেন। আজও।
আমার ধারণা এখানেই তাঁর রবি থেকে ‘ঠাকুর’ হয়ে ওঠা। এই যে আমরা আজও বক্তৃতা করতে গিয়ে ‘শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ পরে, ওরা কাজ করে’ আওড়াই, অল্প মনখারাপেই ‘তাসের দেশ’ বা ‘রক্তকরবী’ খুলে খুঁজতে বসি মুক্তির পথ: এখানেই রবীন্দ্রনাথের অমরত্ব। ওয়ারশ-র কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে হিটলারের হাতে খুন হতে চলা শিশুদের নিয়ে ‘ডাকঘর’ মঞ্চস্থ করানো হয়েছিল, মনে আছে অনেকেরই। রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আছেন ‘জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ায়ে’… প্রতিদিন নতুন করে আবিষ্কার করা তাঁকে, তাঁর লেখায়-সুরে-ছবিতে এমন কিছু আছে যা চিরন্তন, মার্কসীয় কথায় ‘নেগেশন অফ নেগেশন’-এর শেষে নতুন পাওয়া ‘সিনথেসিস’-এর কোথাওই তাঁকে খাপ খাওয়াতে অসুবিধা হয় না। ফলতঃ, ‘‘রবীন্দ্রনাথ কি আজও প্রাসঙ্গিক’’ ধরনের প্রশ্ন অনেকটা ওই ‘‘সূর্য কি আজও ওঠে?’’ জাতীয় বালখিল্যতারই গোত্রভুক্ত হয়ে পড়ে। অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক, আজ, অদূর এবং সুদূর আগামীতেও… আমাদের প্রাত্যহিকতায়, মননে, জীবনবোধে।
তাঁর বহুধাবিভক্ত রচনাসম্ভার নিয়ে আলোচনার দুঃসাহস নেই। আমরা বরং আলোচনাকে খানিক সীমায়িত করে আনতে পারি বর্তমানের প্রেক্ষিতে। আজকের ভারতবর্ষে চোখ ফেললে একঝলকে যে সঙ্কটের চিত্র উঠে আসে, তা সম্বন্ধে বিশ্বকবির অভিমত কী হত, তা সহজেই অনুমেয়। ৯ই ফেব্রুয়ারি, ১৯২৬ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে তাঁর দেওয়া ভাষণ থেকে: ‘‘হিন্দু মুসলমানের আত্মীয়তায় এত বিরোধ কেন? শস্যের সমান ভাগ নিয়ে দর কষাকষি – অন্নের ভাগ কমে গেছে – তাই মারামারি। যে দিন হিন্দু মুসলমান উভয়ে সমান ভোগ করবে, তখন দরদ হবে, আনন্দ নিকেতনে তখন উভয়ের অমৃত উভয়ের পাতে পড়বে। যে দিন প্রাচুর্য হবে, সেদিন বিরোধ ঘুচে যাবে।… একত্র সৃষ্টি দ্বারা – দেশকে সৃষ্টি করতে হবে।’’ অর্থনৈতিক অসাম্য যে সাধারণ জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বীজ সহজে বপন করে ফেলার অন্যতম প্রাকশর্ত, তা বিলক্ষণ জানতেন রবীন্দ্রনাথ। যখন ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড’ ঘোষণা করছে, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি তাকে ধিক্কার জানিয়ে বলছেন, এ হল আসল সমস্যা থেকে নজর ঘোরানোর ছল। প্রায় ১০০ বছর পরের ভারতবর্ষে টেলিপ্রম্পটারে যারা রবীন্দ্রনাথ আওড়াচ্ছেন, নিজেদের চরম অপদার্থতা ঢাকার প্রাণান্তকর চেষ্টাই যে তাদের তাড়িত করছে দিল্লির ঠাণ্ডায় আন্দোলনরত কৃষকদের খালিস্তানি বা এনআরসি-আতঙ্কে রাতজাগা গরিব মুসলমানকে পাকিস্তানি বলে দাগিয়ে দেওয়ার, সে কথা তো অনেকেই বলেছেন ইতিপূর্বে। রবীন্দ্রনাথ চিনিয়েছিলেন বহুদিন আগেই, সে কারণেই রবিঠাকুর আরএসএস-এর চক্ষুশূল। কেবল সিলেবাস থেকে তাঁর লেখা বাদ দিতে চাওয়াই নয়, অসমে বিজেপি সরকার ২৫শে বৈশাখের ছুটি অবধি বাতিল করে দিয়েছে সম্প্রতি!
‘একত্র সৃষ্টি দ্বারা দেশকে সৃষ্টি করা’-র উদাহরণ কিছু ছিল কী রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে? খোঁজ করে দেখা যাক ‘রাশিয়ার চিঠি’র পাতায়। লেনিনের নেতৃত্বে বিপ্লবের পর সে দেশের বয়স তখন মাত্র ১২ বছর। রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, রাশিয়ায় না এলে তাঁর এ জন্মের মতো তীর্থদর্শন অসম্পূর্ণ থেকে যেত। একেবারে মূলে প্রভেদ। কেন? বিশ্বকবি লিখছেন, ‘‘এখানে এসে সব চেয়ে যেটা আমার চোখে ভালো লেগেছে সে হচ্ছে, এই ধন-গরিমার ইতরতার সম্পূর্ণ তিরোভাব। কেবলমাত্র এই কারণেই এ দেশে জনসাধারণের আত্মমর্যাদা এক মুহূর্তে অবারিত হয়েছে। চাষাভূষো সকলেই আজ অসম্মানের বোঝা ঝেড়ে ফেলে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে, এইটে দেখে আমি যেমন বিস্মিত তেমনি আনন্দিত হয়েছি। মানুষে মানুষে ব্যবহার কী আশ্চর্য সহজ হয়ে গেছে।’’
আরেকবার লিখি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তীর্থদর্শন হয়েছিল স্তালিনের রাশিয়ায় এসে। কমিউনিস্ট রাশিয়ায় এসে। আমরা, আজকের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কর্মীরা কী করব? দু’টো ভোটে হেরেছি বলে লালঝাণ্ডা ফেলে দেব হাত থেকে? রবীন্দ্রনাথ যাকে আলো দেখান, তার এল ডোরাডো লুকিয়ে আছে সমাজতন্ত্রেই – সমাজতন্ত্র, এমন দুনিয়া, ‘‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত…’’
শেষ বয়সের রচনা ‘সভ্যতার সঙ্কট’-এর শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।’’
শূন্য পেয়ে যে তরুণ বাম কর্মীর মনখারাপ, তার জন্য এর থেকে তীক্ষ্ণ জোরালো তীব্র মেসেজ, আর কী হতে পারে?
গ্র্যাফিক্স ও অলংকরণ: অভীক দেবনাথ