‘গিলেন ব্যারি সিন্ড্রোমে’ কাঁপছে মহারাষ্ট্র! কী এই রোগ? পৌঁছবে কলকাতাতেও!
Guillain–Barre syndrome: যে কোনও অজানা রোগের ক্ষেত্রে প্রথমেই প্রশ্ন আসে, তার উৎস কী? সেটা জানা থাকলেই তবেই তো রোগটা আটকানো সম্ভব। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, শরীরে কোনও সংক্রমণ না ইনফেকশন হলে, তার থেকেই সূত্রপাত হয় এই রোগের।
নয়া দিল্লি: করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার পর থেকেই নতুন রোগের নাম শুনলে কপালে ভাঁজ পড়ছে সাধারণ মানুষের। সম্প্রতি HMPV নামে এক ভাইরাসকে ঘিরে আতঙ্ক ছড়ায় দেশে। কলকাতাতেও কয়েকজনের আক্রান্ত হওয়ার খবর সামনে আসে। আর এবার ভয় ধরাচ্ছে জিবিএস (GBS)। পুরো নাম গিলেন ব্যারি সিনড্রোম (Guillain Barre Syndrome)। জ্বর-সর্দি-কাশি নয়, এই রোগে অবশ হয়ে যাচ্ছে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। পুনেতে আক্রান্তের সংখ্যা ১০০ ছাড়াতেই উদ্বেগ বেড়েছে। এমনকী এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে মহারাষ্ট্রে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে বলেও সূত্রের খবর।
১৯১৬ সালে জর্জ গিলেন ও জিন আলেকজান্ডার ব্যারে নামে দুই চিকিৎসক প্রথম এই রোগ শনাক্ত করেন। তাঁদের নামেই এই রোগের নামকরণ করা হয় ‘গিলেন-ব্যারি সিন্ড্রোম’। বাংলাতেও এর আগে এই সিন্ড্রোম দেখা গিয়েছে। তবে পুনেতে একসঙ্গে বহু মানুষ আক্রান্ত হওয়ায় বেড়েছে আতঙ্ক।
কারা আক্রান্ত হচ্ছে?
আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় সংশ্লিষ্ট রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর একটি রিপোর্ট তৈরি করেছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, কোন বয়সে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। ১০১ জন আক্রান্তের মধ্যে ১৯ জনের বয়স ৯ বছরের নীচে, ১৫ জনের বয়স ১০ থেকে ১৯-এর মধ্যে, ২০ জন আক্রান্তের বয়স ২০ থেকে ২৯-এর মধ্যে, ১৩ জনের বয়স ৩০ থেকে ৩৯-এর মধ্যে, ১২ জনের বয়স ৪০-৪৯ এর মধ্যে। ১৩ জনের বয়, ৫০ থেকে ৫৯-এর মধ্যে, ৮ জনের বয়স ৬০ থেকে ৬৯-এর মধ্যে। একজন আক্রান্তের বয়স ৭০-এর বেশি।
শরীরে কোথা থেকে হাজির হয় গিলেন ব্যারি?
যে কোনও অজানা রোগের ক্ষেত্রে প্রথমেই প্রশ্ন আসে, তার উৎস কী? সেটা জানা থাকলেই তবেই তো রোগটা আটকানো সম্ভব। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, শরীরে কোনও সংক্রমণ না ইনফেকশন হলে, তার থেকেই সূত্রপাত হয় এই রোগের।
চিকিৎসক সুপর্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, পেটের বা ফুসফুসের ইনফেকশন থেকে হতে পারে রোগের আগমন। ডায়েরিয়া বা ফুসফুসের ইনফেকশন হলে যে ব্যাকটেরিয়া শরীরে প্রবেশ করে, তার থেকেই পরবর্তীতে হতে পারে গিলেন ব্যারি। তথ্য বলছে, ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, ডায়েরিয়ার জীবাণুই ডেকে আনে এই সিন্ড্রোম। এছাড়াও ডেঙ্গি, জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে জিবিস-এর প্রবণতা বাড়ে শরীরে।
কীভাবে ছড়ায় এই রোগ? পুনে থেকে কি কলকাতাতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে?
জিবিএস প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় বলে জানাচ্ছেন বিশিষ্ট চিকিৎসক সুপর্ণ বন্দ্য়োপাধ্যায়। তবে যেহেতু ইনফেকশন থেকে এই রোগের সূত্রপাত হয়, তাই ইনফেকশন আটকানো জরুরি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, হাত ভালভাবে ধুয়ে খেতে হবে। রান্না করার আগে খাদ্যদ্রব্য ভালভাবে ধুতে হবে। পেটে ইনফেকশন হলে তাই দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত।
তবে এই রোগ সংক্রামক নয়। ফলে, করোনার মতো এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়া সম্ভব নয়।
জিবিএস হল অটোইমিউন ডিজিজ
প্রত্যেকের শরীরেই একটা নিজস্ব ইমিউনিটি সিস্টেম আছে। সেখানে অ্যান্টিবডি প্রস্তু হয়। তারাই রোগ প্রতিরোধ করে। কিন্তু যখন শরীর বুঝতে পারে না যে কোনটা সেল্ফ ও কোনটা নন-সেল্ফ, তখন নিজের কোষকেই বহিরাগত প্রোটিন ভেবে আক্রমণ করে ফেলে। তাকেই বলে অটোইমিউন ডিজিজ।
গিলেন ব্যারি সিন্ড্রোমে আক্রান্ত কি না, কীভাবে বুঝবেন?
পায়ে, হাতে বা শরীরের অন্যান্য অংশে ব্যাথা দিয়ে শুরু হয়। শুরু হয় অস্বস্তি। তারপর আস্তে আস্তে পায়ে-হাতে দুর্বলতা অনুভব করতে শুরু করেন আক্রান্ত ব্যক্তি। প্রায় ৪ সপ্তাহ ধরে চলে এই সব উপসর্গের প্রকোপ। ক্রমে সেই দুর্বলতা এতটাই বেড়ে যায় যে হাঁটাও দুষ্কর হয়ে পড়ে। এছাড়া শুরুতে পিঠে ব্যাথা হওয়াও খুব একটা বিরল বিষয় নয়।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ক্রানিয়াল নার্ভ নামে একটি নার্ভ সংক্রমিত হয়, যার ফলে মুখের পেশীগুলোতেও দুর্বলতা অনুভব করেন আক্রান্ত। রিপোর্ট বলছে, ২ দিন থেকে ৬ মাস পর্যন্ত এই সব উপসর্গের প্রভাব দেখা যেতে পারে।
তবে মনে রাখা জরুরি, যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পেট ও ফুসফুসের ইনফেকশনের পরেই এই গিলেন ব্যারে সিন্ড্রোম দেখা দেয়, তাই উপসর্গ দেখা দিলে ভেবে দেখতে হবে ৩ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্য়ে শরীরে কোনও ইনফেকশন হয়েছিল কি না।
শুধুই কি ব্যথা? নাকি আরও কোনও প্রাণঘাতী উপসর্গ দেখা দিতে পারে?
পা বা হাতের মাংসপেশীতে প্রভাব ফেললে, ততটা গুরুতর সমস্যা হয় না। তবে, বিপদ বাড়ে যখন ফুসফুসের পেশীতে প্রভাব পড়ে। ফুসফুসের পেশী দুর্বল হয়ে গেলে, শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়। শরীরে অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা ঠিকভাবে বজায় রাখা সম্ভব হয় না। ফলে গিলেন ব্যারির প্রভাবে হতে পারে নিউমোনিয়া, ফুসফুসে জমতে পারে রক্ত, ডাইজেস্টিভ ট্র্যাকে হতে পারে রক্তক্ষরণ।
পরিস্থিতি সঙ্কটজনক হলে বিকল হতে শুরু করে হৃদযন্ত্র। মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে যেতে পারে হার্টবিট। সে ক্ষেত্রে পেসমেকার পর্যন্ত বসাতে হতে পারে।
করোনা-ভ্যাকসিনের সাইড এফেক্ট ‘গিলেন ব্যারি’?
গিলেন ব্যারি সিন্ড্রোমে আগেও আক্রান্ত হয়েছেন অনেকে। তবে ২০২০-২১ সালের পর পরিস্থিতি যেভাবে বদলেছে, তার প্রভাব পড়েছে মানুষের স্বাস্থ্যেও। রিপোর্ট বলছে, করোনার ভ্যাকসিন নেওয়ার পর এই সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হয়েছেন, এমন উদাহরণ রয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন যাঁরা নিয়েছিলেন, তাঁদের কারও কারও শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে এই রোগের কথা বলেছেন কেউ কেউ। তবে পরবর্তীতে দেখা গিয়েছে, করোনার ভ্যাকসিনের সঙ্গে এই জিবিএস-এর কোনও যোগ নেই।
কীভাবে সারবে জিবিএস?
গিলেন ব্যারি সিন্ড্রোমের কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। সমস্যা খুব বেশি হলে, রক্তের প্লাজমা বদল করে চিকিৎসা করতে হয়। এছাড়া করা যেতে পারে ইমিউনোগ্লোবিন থেরাপিও করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে শিরার মধ্যে দিয়ে শরীরে প্রবেশ করানো হয় অ্যান্টিবডি।