Puri Ratna Bhandar Mystery: গুপ্তধনের সন্ধানে…
Puri Jagannath Temple Ratna Bhandar: পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির নিয়ে রহস্যের অন্ত নেই। ৮০০ বছরের পুরানো এই জগন্নাথ মন্দিরে আজও এমন অনেক ঘটনা ঘটে চলেছে, যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এরকমই অপার বিস্ময় ও রহস্যে মোড়া হল জগন্নাথ মন্দিরের রত্ন ভান্ডার। যদিও প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর অবশেষে খুলেছে রত্ন ভান্ডারের দরজা। তবে তার ভিতর থেকে যা বেরিয়েছে, তা নিয়ে উঠছে নতুন প্রশ্ন। সাপের বদলে ঝাঁক-ঝাঁক বাদুড়ের বেরিয়ে আসাও কি অলৌকিকতা? এটা শুভ নাকি অশুভ লক্ষণ, তা নিয়েও শুরু হয়েছে জল্পনা।
খুল যা সিম-সিম! দীর্ঘ অপেক্ষা-জল্পনার অবসান। প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর অবশেষে খুলল গুপ্তধন ভান্ডারের দরজা। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, কোনও সাধারণ গুপ্তধন ভান্ডারের কথা বলছি না। পুরীর রহস্যময় জগন্নাথ মন্দিরের গুপ্তধন ভান্ডার থুরি, রত্ন ভান্ডারের কথা-ই বলছি।
পুরীর জগন্নাথ মন্দির নিয়ে রহস্যের অন্ত নেই। ৮০০ বছরের পুরানো এই জগন্নাথ মন্দিরে আজও এমন অনেক ঘটনা ঘটে চলেছে, যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যেমন, ৪৫ তলা বাড়ির সমান উঁচু পুরীর মন্দিরের চূড়ার ধ্বজাটি ওড়ে হাওয়ার বিপরীতে। আবার প্রায় ৪ লক্ষ বর্গফুট এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এবং ২১৪ ফুট উঁচু মন্দিরের চূড়ার ছায়া দেখা যায় না। যা সাধারণ বিজ্ঞানের সঙ্গে মেলে না। আবার মহাপ্রসাদ তৈরির পদ্ধতি থেকে মন্দিরের চূড়ার উপর অধিষ্ঠিত চক্রের রহস্যের কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মেলে না। এরকমই মন্দিরের রত্ন ভান্ডার নিয়েও রহস্য-জল্পনার অন্ত নেই।
জগন্নাথ মন্দিরের রত্ন ভান্ডার আদতে ১১.৮ মিটার উঁচু একটি মন্দির। একে রত্নবাড়িও বলা হয়। শোনা যায়, পুরী মন্দিরের রত্ন ভাণ্ডারে যে পরিমাণ সম্পত্তি রয়েছে, তা নাকি দেশের কোনও মন্দিরে নেই। তিরুপতি, বালাজি থেকে দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য প্রখ্যাত মন্দিরগুলিও নাকি হার মানবে জগন্নাথদেবের সম্পত্তির কাছে। জগন্নাথদেবের রত্ন ভান্ডার দুটি কুঠুরিতে বিভক্ত- বহির্ভান্ডার ও অন্তর্ভান্ডার। দুটি ভান্ডার মিলিয়ে মোট ৭টি ঘর রয়েছে। বহির্ভান্ডারে রয়েছে জগন্নাথদেব, বলরামদেব এবং সুভদ্রাদেবীর পোশাক ও তাঁদের ব্যবহৃত গয়না। আর অন্তর্ভান্ডারে রয়েছে মণি-মাণিক্য-সহ বিপুল পরিমাণ গয়না।
জগন্নাথদেবের রত্ন ভান্ডারে রত্নের পরিমাণ
পুরীর এই মন্দির ৮০০ বছরের পুরানো এবং রত্ন ভান্ডার প্রায় সমসাময়িক হলেও সেখানকার রত্নের খতিয়ান প্রথম প্রকাশ করা হয় ২১৯ বছর আগে, ১৮০৫ সালে। সেবার পুরীর তৎকালীন কলেক্টর চার্লস গ্রোম দাবি করেছিলেন, রত্ন ভাণ্ডারে ময়ূরপঙ্খীর আকারের মুকুট থেকে শুরু করে সুন্দর কারুকার্য করা সোনা ও রুপোর প্রচুর গয়না এবং শতাধিক মোহর আছে। তারপর রাজা গজপতি রামচন্দ্রের ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া তালিকা অনুসারে, জগন্নাথ মন্দিরের রত্ন ভান্ডারে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার সোনার মুকুট-সহ ১৫০টি সোনার অলঙ্কার সহ ৮৩৭টি জিনিস রয়েছে। মোট সোনার ওজন ১৫ কেজির বেশি। এরপর ১৯৫০ সালে শ্রী জগন্নাথ টেম্পল অ্যাডিনিস্ট্রেটিভ অ্যাক্ট কার্যকর করা হয় এই রত্ন ভান্ডারেও। এর মধ্যে মন্দিরের সম্পদের পরিমাণ অনেকটাই বাড়ে। ১৯৭৮ সালের জুলাইয়ে শেষবার রত্ন ভান্ডারের সম্পদের খতিয়ান নেওয়া হয়। রেকর্ড অব রাইটস-র ভিত্তিতে সেই খতিয়ান অনুযায়ী, জগন্নাথদেবের রত্ন ভাণ্ডারে মোট ৪৫৪টি সোনার গয়না, যার ওজন আনুমানিক ১২,৮৩৮ ভরি এবং ২৯৩টি রুপোর গয়না রয়েছে, যার ওজন ২২১৫৩ ভরি। এছাড়া রত্ন ভাণ্ডারের বহির্ভান্ডারে রাখা আছে মণি-মুক্তো জড়ানো জগন্নাথদেবের সাজসজ্জা। মোট ৭৯টি সোনার গয়না এবং ৩৯টি রুপোর গয়না। এছাড়া রয়েছে নিত্য ব্যবহারের আরও সোনাদানা। ব্রক্ষ্মজ্যোতি হিরে, বলরামের নীলা, সুভদ্রার মণিমুক্তোও রয়েছে। অন্তর্ভান্ডারের গয়নার সঠিক পরিসংখ্যান ‘৭৮-এর খতিয়ানে নেই। তবে ৩৫০ -এর বেশি সোনার গয়না ও ২৩০টির বেশি রুপোর গয়না। রত্নভাণ্ডারের বিপুল রত্নের মাত্র ১০ শতাংশ জগন্নাথদেবকে পরানো হয় বলে জানা গিয়েছে। ১৯৮২ ও ১৯৮৫ সালে দু’বার গর্ভগৃহের দরজা ও বলভদ্রের মুকুট সারাতে ব্যবহার করা হয়েছিল রত্ন ভান্ডারের কিছু সম্পত্তি। এরপরই নাকি রত্ন ভান্ডারের চাবি হারিয়ে যায়। তারপর থেকেই বন্ধ ছিল জগন্নাথদেবের রত্ন ভান্ডার। আর বন্ধ ঘরেই তো জন্ম নেয় রহস্য!
অলৌকিকতা নাকি বাস্তব!
এবারে রত্ন ভান্ডার খোলার আগে পর্যন্ত কেবল বহির্ভান্ডারে সেবায়তদের প্রবেশের অনুমতি ছিল। অন্তর্ভান্ডারে প্রবেশের অনুমতি ছিল না। সেখানে কেউ প্রবেশ করলে বা জগন্নাথদেবের সম্পত্তির দিকে তাকালে অন্ধ হয়ে যাবে- এমন রটনাও ছিল। তাই রত্ন ভান্ডারের কুঠুরি ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেখানে বিদ্যুৎ পর্যন্ত নেই। বিপুল রত্ন ভাণ্ডারের বহির্ভান্ডার ঢুকতে হলেও শরীরের সমস্ত অলঙ্কার, পোশাক খুলে কেবল গামছা পরে পরিদর্শকদের ঢুকতে হয়, এমনও রটনা ছিল।
আবার এমনও শোনা গিয়েছিল, জগন্নাথ দেবের সম্পত্তির পাহারায় রয়েছেন নাগরাজ। বিষধর সাপ কিলবিল করে রত্ন ভাণ্ডারে। কেউ মণি-মুক্তোয় হাত দিলেই ছোবল দেয় তারা। শুনতে গল্পের মতো লাগলেও ২০১৮ সালে শেষবার যখন রত্ন ভাণ্ডার খুলতে গিয়েছিলেন সরকারি প্রতিনিধি ও মন্দিরের সেবায়তরা, তখন তাঁরা নাকি চাক্ষুষ করেছিলেন সেই ঘটনা। তাই তাঁদের সঙ্গে ছিলেন সাপের ওঝাও। এই রত্ন ভাণ্ডারে যে বিপুল পরিমাণ রত্নসামগ্রী ছিল, তা গত কয়েকবারের খতিয়ান থেকেই স্পষ্ট।
যদিও এই সমস্ত জল্পনা-রটনার অবসান ঘটে চলতি বছরের ১৪ জুলাই। সেদিন সুপ্রিম-নির্দেশে প্রশাসন এবং মন্দির কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি ও সেবায়ত নিয়ে গঠিত ১১ সদস্যের বিশেষ কমিটির প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে রত্ন ভান্ডারের দুটি কুঠুরিই খোলা হয়েছে। কিন্তু, নাগরাজ দূরস্ত, একটি সাপেরও দেখা মেলেনি। কেবল বেরিয়ে এসেছে কালো-কালো একাধিক বাদুড়। আর দেখা মিলেছিল কয়েকটি ইঁদুরের। যদিও রত্ন ভান্ডারে ঢোকার সময় সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে ছিলেন সর্প বিশারদও। তাহলে কি সর্প বিশারদ থাকায় সমস্ত সাপ বদলে গিয়েছে বাদুড়ে? এও কি অলৌকিকতা? এমন প্রশ্নও অনেকের মনে উঁকি দিয়েছে।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর দিক থেকে এই ধরনের প্রশ্নের কোনও বাস্তবতা নেই। কিন্তু, ২০১৮ সালে, শেষবার যখন রত্ন ভাণ্ডার খোলার সময় যে সরকারি প্রতিনিধি ও মন্দিরের সেবায়তরা ছিলেন, তাঁরা নাকি চাক্ষুষ করেছিলেন সেই কালসর্প। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন সাপের ওঝাও। তাহলে গত ৬ বছরে কী এমন ঘটল? তাঁরা কি ভুল দেখেছিলেন বা ভুল বলেছিলেন? নাকি অলৌকিকতার ভাবনাই সঠিক- সাপ বদলে গিয়েছে বাদুড়ে? এর জবাব এখনও অধরা। আদৌ কোনদিন জানা যাবে নাকি মন্দিরের অন্যান্য রহস্যের মতো এটাও রহস্য হয়ে থাকবে, তা এখনও কেউ জানে না।
তবে সাপের বাদুড়ে রূপান্তরিত হওয়ার ধারণাটি মেনে নিলেও অন্ধ হয়ে যাওয়ার জল্পনাটি সত্য হয়নি। রত্ন ভান্ডারে যাঁরা প্রবেশ করেছিলেন, তাঁরা সকলেই দু-চোখ ভরে দেখেছেন জগন্নাথদেবের রত্ন ভান্ডারের বিপুল রত্নসামগ্রী। শুধু দেখা নয়, সেগুলি বিশেষ ট্রাঙ্কে ভরে অস্থায়ী স্ট্রং রুমে স্থানান্তরিতও করা হয়েছে। কিন্তু, এখনও পর্যন্ত কারও মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা আসেনি। বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপটে রত্ন ভান্ডার নিয়ে নানা জল্পনা বাস্তবে কেবল জল্পনা হলেও এই ভাণ্ডার যে বিপুর রত্নসামগ্রীর আকড়, সে কথা মিথ্যা নয়। কেবল রত্ন নয়, এমন অনেক কিছু প্রকাশ্যে এসেছে, যা জগন্নাথ মন্দিরের ওই রত্ন ভাণ্ডারে থাকবে, তা কল্পনাতীত ছিল। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে অবশ্য এগুলি থাকা মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
রত্ন ভাণ্ডার থেকে কী উদ্ধার হয়েছে?
রত্ন ভাণ্ডারের ভিতর থেকে বেরিয়েছে জগন্নাথদেব, বলরামদেব ও সুভদ্র দেবীর সোনা-রুপোর বিপুল গয়না। গয়না ছাড়াও অনেক প্রাচীন মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। এগুলি বহুমূল্য ধাতু দিয়ে তৈরি। তবে সম্পূর্ণ কালো হয়ে গিয়েছে। বিগত চার দশক ধরে রত্ন ভাণ্ডারের দরজা বন্ধ থাকায় এগুলি সিন্দুকের ভিতর একপ্রকার পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। সেজন্যই এগুলি কালো হয়ে গিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এগুলির কথা বিগত সমীক্ষাতেও ছিল না। এছাড়া রত্ন ভাণ্ডারের অন্তর্ভান্ডার থেকে বেরিয়েছে শতাব্দী প্রাচীন বেশ কিছু তলোয়ার, বর্শা এবং বল্লম। এগুলি প্রাচীনকালে যুদ্ধে ব্যবহার করা হত। ১১ সদস্যের যে কমিটি মন্দিরের রত্ন ভাণ্ডারের ভিতর প্রবেশ করেন, তাঁদেরই এক সদস্য বলেন, “গত ১৪ জুলাই আমরা প্রাচীন কয়েকটি মূর্তি পেয়েছিলাম। এবার আমরা কিছু তলোয়ার ও বর্শা-বল্লম পেয়েছি। বিশালাকার একটি কাঠের সিন্দুকের পাশে এগুলি রাখা ছিল।” এই অস্ত্রগুলি অত্য়ন্ত ভারী। এত বছর ধরে পড়ে থাকায় এগুলিও কালো হয়ে গিয়েছে।
জগন্নাথদেবের রত্ন ভান্ডারে অস্ত্র কেন?
রত্ন ভান্ডারে যে সোনা-হীরে-জহরৎ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, প্রাচীন মূর্তি মন্দিরে স্থাপন না করে রত্ন ভান্ডারে, অস্ত্রশস্ত্রও রত্ন ভান্ডারে কেন ও কীভাবে এল, তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ক্ষেত্রে এটা খুব একটা অস্বাভাবিক ঘটনা নয়।
১১৯০ -এর দশকে রাজা অনন্তবর্মন দেব পুরীর জগন্নাথ মন্দির তৈরি করেছিলেন। ১০.৭ একর জমির উপরে নির্মিত এই মন্দিরে মহা সাড়ম্বরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জগন্নাথদেব, বলরামদেব এবং সুভদ্রাদেবী। এরপর ধীরে-ধীরে স্থানীয়দের মনে বিশ্বাস জন্মায়, এই মন্দিরে কিছু প্রার্থনা করলে সেটা পূর্ণ হয়। তাই মনস্কামনা পূর্ণ হলে অনেকেই এই মন্দিরে প্রণামী হিসাবে সোনা-রুপোর গয়না দান করেন। এছাড়া দেব বংশ থেকে আশপাশের রাজ্যের অনেক রাজাও এই মন্দিরে সোনা-দানা দান করেন। শোনা যায়, ১৪৬০ সালে রাজা কপিলেন্দ্র দেব নাকি যুদ্ধ জয়ের পর ১৬টি হাতির পিঠে চাপিয়ে বিপুল সোনা এনে এই জগন্নাথ মন্দিরের রত্ন ভাণ্ডারে রাখেন। ওড়িশা ম্যাগাজিন অনুসারে, রাজা অনঙ্গভীম দেব জগন্নাথদেবের গয়না তৈরির জন্য বিপুল পরিমাণ সোনা এই মন্দিরে দান করেছিলেন। এছাড়া মহারাজা রঞ্জিত সিং বিপুল পরিমাণ সোনা দান করেন জগন্নাথ মন্দিরে। তাঁর উইলে জগন্নাথ মন্দিরে কোহিনূর হীরে দান করা হবে বলেও উল্লেখ ছিল। যদিও সেটা দান করা হয়েছিল কি না, তা জানা যায়নি।
স্বাভাবিকভাবেই, রত্নের আকড় হয়ে ওঠে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রত্ন ভান্ডার। ফলে বহুবার বিদেশি ও মুসলিম শাসকদের হামলার মুখে পড়ে এই মন্দির। ইতিহাসের পরিসংখ্যান অনুসারে, কমপক্ষে ১৮ বার পুরী মন্দিরে হামলা ও লুটপাট হয়। পরবর্তীতে মন্দিরের সম্পদ রক্ষা করতেই রত্ন ভান্ডার বিশেষভাবে সুরক্ষিত করা হয় বলে মনে করা হয়। আর হামলাকারীদের ঠেকাতেই স্থানীয় রাজারা রত্ন ভান্ডারের ভিতরে ওই অস্ত্রশস্ত্র রেখেছিলেন বলে দাবি মন্দিরের সেবায়তদের।
রত্ন ভান্ডার থেকে প্রাচীন অস্ত্র ও প্রাচীন মূর্তি উদ্ধারের কথা উল্লেখ করা হলেও কী পরিমাণ রত্নসামগ্রী পাওয়া গিয়েছে, তা সত্যিই দেশের অন্যান্য মন্দিরের তুলনায় বেশি কি না, তা এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। হয়তো আগামী দিনে আসবে। তবে রত্ন ভান্ডারের চাবি না হারালে, জগন্নাথদেবের গর্ভগৃহে ইঁদুর বাসা না করলে হয়তো এসব কিছুই জানা যেত না।
জগন্নাথদেবের গর্ভগৃহে একেবারে বিগ্রহদের বেদিতে ইঁদুর বাসা করেছে এবং বেদি থেকে গর্ভগৃহের মেঝের নীচে ঝাঁঝড়া করে দিয়েছে বলে বছর কয়েক আগে খবর প্রকাশ্যে আসে। এরপরই দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা রত্ন ভান্ডারের পরিকাঠামোর হদিশ নিতে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-কে নির্দেশ দেয় ওড়িশা হাইকোর্ট। সেটা ছিল ২০১৮ সাল। আদালতের নির্দেশে রত্নভাণ্ডারের মেঝে, ছাদ, দেওয়ালের অবস্থা কেমন আছে জানতে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র সদস্যরা মন্দিরে আসেন। কিন্তু, রত্ন ভান্ডারের দরজা খুলতে এলেই চাবি হারিয়ে যাওয়ার খবরটি প্রকাশ্যে আসে। তারপরই গোটা বিষয়টি নিয়ে শুরু হয় প্রশাসনিক থেকে রাজনৈতিক টানাপোড়েন।
রত্ন ভান্ডারের সঙ্গে রাজনীতি
জগন্নাথদেবের রত্ন ভান্ডারের চাবি একজনের কাছে থাকে না। রত্ন ভান্ডার খোলার জন্য মোট ৩টি চাবি লাগে। ১টি চাবি থাকে গজপতি রাজার কাছে, ১টি চাবি থাকে মন্দিরের সেবায়ত ভাণ্ডার মেকাপ-এর দায়িত্বে। আরেকটি চাবি থাকে পুরীর কালেক্টর দায়িত্বে। এই তৃতীয় চাবিটি অমিল। এই চাবির খোঁজ পেতে ২০১৮ সালেই তদন্তের নির্দেশ দেন ওড়িশার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক। হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঘুবীর দাসের নেতৃত্বে তদন্ত কমিশনও গঠন করেন। ওই বছরের শেষেই তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয় কমিশন। কিন্তু, তার ৫ বছর পরেও সেই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসেনি। যার প্রেক্ষিতে এই ঘটনাকে ইস্যু করে রাজনৈতিক ময়দানে নামে পট্টনায়েক-বিরোধীরা। জগন্নাথদেবের রত্ন ভান্ডারের চাবি ইস্যু তুলে ধরেই ২০২৪-এর লোকসভা ও ওড়িশা বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে নামে বিজেপি। এমনকি রাজ্যের ক্ষমতায় এলে রত্ন ভান্ডার-রহস্য প্রকাশ্যে আনার প্রতিশ্রুতিও দেয় বিজেপি। এই প্রতিশ্রুতি নিছক ছিল না। তাই ২৪ বছর পর পট্টনায়েক সরকারের পতন ঘটিয়ে বিজেপি ওড়িশায় ক্ষমতায় আসার পরই জগন্নাথদেবের রত্ন ভান্ডার খোলার তোড়জোড় শুরু হয়। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাঝির তৎপরতায় অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ৪৬ বছর পর, গত ১৪ জুলাই, ২০২৪ তারিখে খুলল রত্ন ভান্ডারের দ্বার। একেবারে পঞ্জিকা দেখে, তিথি-দিনক্ষণ মেনে দুপুর দেড়টা নাগাদ খোলা হয় রত্ন ভান্ডারের দরজা। সেদিন কেবল মূল গেট খোলা হয়েছিল। এর কয়েকদিন পর, গত ১৮ জুলাই, ২০২৪ তারিখে খোলে রত্ন ভান্ডারের অন্তর্ভান্ডার। রত্ন ভান্ডার নিয়ে নানান জল্পনার অবসান হয়। তারপর যত দিন যায়, ততই প্রকাশ্যে আসে রত্ন ভান্ডারের অজানা তথ্য।
রত্ন ভান্ডারে সুড়ঙ্গ
অপার রহস্য ও কৌতূহলের সঙ্গে জগন্নাথ মন্দিরের রত্ন ভান্ডার দ্বার খোলা হলেও আশানুরূপ কিছুই মেলেনি। সাপের তো দেখা মেলেনি। এমনকি, যে পরিমাণ রত্ন গচ্ছিত থাকার কথা শোনা গিয়েছিল, তারও যথাযথ হদিশ মেলেনি। অনেকেই মনে করেছিলেন, রত্ন ভান্ডারে একটি রুপোর সিংহাসন থাকতে পারে। কিন্তু, তা পাওয়া যায়নি। যার প্রেক্ষিতে পূর্বতন সরকার ও প্রশাসনিক আধিকারিকদের দিকে উঠছে তির্যক আঙুল। তবে এই অভিযোগ-জল্পনার মধ্যেই উঠে এসেছে রত্ন ভান্ডারের সুড়ঙ্গের তথ্য।
বেশ কয়েকজন সেবায়েত দাবি করছেন, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রত্ন ভান্ডারের ভিতরের কক্ষে একটি গোপন সুড়ঙ্গ আছে। সেখানেই নাকি জগন্নাথ মন্দিরের আসল ধন-সম্পদ লুকোনো আছে। যদিও একোনও সূড়ঙ্গের ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই বলে জানিয়েছেন সুপারভাইজারি প্যানেলের চেয়ারম্যান, বিচারপতি বিশ্বনাথ রথ। তিনি জানিয়েছেন, সব ধন-সম্পদ সরিয়ে ভিতরের কক্ষের দেওয়ালগুলি পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। কিন্তু, কোথাও কোনও সূড়ঙ্গের হদিশ মেলেনি। কিন্তু,পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রহস্যে মোড়া রত্ন ভান্ডার বলে কথা! এটা তো আর হালকাভাবে নেওয়া যায় না। তাই এবার রত্ন ভান্ডারের সুড়ঙ্গের হদিশ পেতে আসরে নামবে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া। পুরীর রাজ পরিবারের সদস্য তথা জগন্নাথ মন্দিরের পরিচালন পর্ষদের চেয়ারম্যান দিব্যসিংহ দেব জানিয়েছেন, রত্নভান্ডারের ভিতরের কক্ষে গোপন সুড়ঙ্গ থাকা নিয়ে জল্পনা দূর করতে উন্নতমানের যন্ত্রপাতি দিয়ে লেজার স্ক্যানিং করবে এএসআই। এই রত্ন ভান্ডার থেকে আর কী-কী হদিশ মেলে, সেদিকেই নজর সকলের।