Bypolls in West Bengal: আরজি কর কাণ্ডের আবহে উপনির্বাচন কি ২৬-র জনমত সমীক্ষা?
Bypolls in West Bengal: ভোটগ্রহণের আগে জনমত সমীক্ষা। আবার ভোটগ্রহণের পর বুথফেরত সমীক্ষা। ফলাফল প্রকাশের আগে সেই বুথফেরত সমীক্ষায় একটা আভাস পাওয়া যায়। সেই আভাস কখনও মেলে। আবার কখনও মেলে না। রাজ্যে ছাব্বিশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে কি জনমত সমীক্ষা হয়ে দেখা দেবে উপনির্বাচনের ফল? ১৩ নভেম্বর রাজ্যের পাঁচ জেলার ছয় বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটাররা ভোট দেবেন। তাঁদের ভোটই কি ছাব্বিশের জনমত সমীক্ষা হয়ে দাঁড়াবে? পড়ুন টিভি৯ বাংলার বিশেষ প্রতিবেদন...
বাংলায় ফের ভোটের দামামা। উত্তর থেকে দক্ষিণ, রাজ্যের পাঁচ জেলার ৬ বিধানসভা আসনে উপনির্বাচন। এই ভোটের ফলে সরকার পড়বে না। শাসক-বিরোধীদের বিধায়ক সংখ্যাও কাছাকাছি আসবে না। আবার উপনির্বাচনে সাধারণত রাজ্যের শাসকদলের পাল্লা ভারী থাকে। তারপরও এই উপনির্বাচন ঘিরে বাড়তি আগ্রহ। চলছে কাটাছেঁড়া। কেন এই উপনির্বাচন ঘিরে এত আগ্রহ? আরজি কর কাণ্ডের আবহে কি এই উপনির্বাচন অ্যাসিড টেস্ট? ২০২৬-র বিধানসভা ভোটের আগে কি কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যাবে এই উপনির্বাচনে? কী বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা?
কোন কোন আসনে উপনির্বাচন-
পাঁচ জেলা। ছয় আসন। উত্তরে কোচবিহারের সিতাই ও আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাটি। পশ্চিম মেদিনীপুরের মেদিনীপুর। বাঁকুড়ার তালডাংরা। আর উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া ও নৈহাটি। এই আসনগুলির বিধায়করা চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে জিতে সাংসদ হয়েছেন। তারপর বিধায়ক পদ ছেড়েছেন। তাঁদের ছেড়ে যাওয়া আসনেই হচ্ছে উপনির্বাচন।
এই খবরটিও পড়ুন
এই ৬টি আসনে একুশের ফলাফল-
এই ৬টি আসনের মধ্যে একুশের বিধানসভা নির্বাচনে পাঁচটি জিতেছিল তৃণমূল। আর মাদারিহাট আসনটি জিতেছিল বিজেপি। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে মেদিনীপুর থেকে জিতেছিলেন তৃণমূলের জুন মালিয়া। হাড়োয়া থেকে জিতেছিলেন ঘাসফুল শিবিরের হাজি নুরুল ইসলাম। নৈহাটিতে জিতেছিলেন তৃণমূলের পার্থ ভৌমিক। সিতাইয়ে জিতেছিলেন শাসকদলের জগদীশচন্দ্র বর্মা বসুনিয়া। তালডাংরায় জিতেছিলেন তৃণমূলের অরূপ চক্রবর্তী। আর মাদারিহাটে জিতেছিলেন বিজেপির মনোজ টিগ্গা।
এই ৬টি আসনের মধ্যে হাড়োয়া আসনটি ২০১১ সাল থেকে তৃণমূলের দখলে। একুশের নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের ৫৭ শতাংশের বেশি পেয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী। উত্তর ২৪ পরগনার আর এক আসন নৈহাটি রাজ্যে পালাবদলের সময় থেকে ঘাসফুল শিবিরের দখলে। মেদিনীপুর আসনটিও ২০১১ সাল থেকে ঘাসফুল শিবিরের দখলে। ২০১৬ সাল থেকে তালডাংরা আসনটি তৃণমূলের দখলে।
উত্তরের কোচবিহারের সিতাই আসনে ২০২১ সালেই প্রথম জেতে তৃণমূল। তার আগে পরপর তিন বার সেখানে জিতেছিল কংগ্রেস। উত্তরের আর এক আসন মাদারিহাট ২০১৬ সাল থেকে বিজেপির দখলে। তার আগে প্রায় সাড়ে চার দশক আসনটি দখলে রেখেছিল আরএসপি। এই আসনে এখনও পর্যন্ত একবারও জেতেনি তৃণমূল।
উপনির্বাচনে চতু্র্মুখী লড়াই-
তৃণমূল আর বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করতে লোকসভা নির্বাচনে জোট বেঁধেছিল বাম-কংগ্রেস। সেইসময় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন অধীর চৌধুরী। লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না হওয়ার জন্য অধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, কংগ্রেসকে দুটি আসন ছাড়তে চেয়েছিলেন তাঁরা। মুর্শিদাবাদ ও মালদা দক্ষিণ। কিন্তু, কংগ্রেস আরও আসন চেয়েছিল। লোকসভায় কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের জোট হয়নি। লোকসভার ফল বলছে, ৪২টি আসনের মধ্যে শুধু মালদা দক্ষিণ আসনে জিতেছে কংগ্রেস। বামেরা একটি আসনও পায়নি।
কিছুদিন আগেই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বদল হয়েছে। অধীর চৌধুরীর জায়গায় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হয়েছেন শুভঙ্কর সরকার। তার পর থেকেই প্রশ্ন উঠছিল, এবার কি তৃণমূলের বিরুদ্ধে সুর নরম করবে প্রদেশ কংগ্রেস? উপনির্বাচনে দেখা গেল, বামেদের সঙ্গে আসন রফা নিয়ে একদম শেষ মুহূর্তে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। বামেরা তার আগেই শরিকদের মধ্যে আসন বণ্টন করে ফেলেছে। ফলে জোট হয়নি। আর তার নির্যাস, উপনির্বাচনে চতুর্মুখী লড়াই। তৃণমূল স্বাভাবিকভাবেই ৬টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিজেপিও ৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। বামেদের সঙ্গে জোট না হওয়ার পর কংগ্রেস ৬টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে। আর বামেরা পাঁচটি আসনে লড়বে। হাড়োয়ায় প্রার্থী দিয়েছে আইএসএফ। ফলে ৬টি আসনেই চতুর্মুখী লড়াই। রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, বাংলায় অনেকদিন পর চতুর্মুখী লড়াই হচ্ছে।
আরজি কর কাণ্ডের আবহে রাজ্যে উপনির্বাচন-
কয়েকমাস আগেই লোকসভা নির্বাচন হয়েছে। সেই নির্বাচনে উনিশের ভোটের থেকে ভাল ফল করেছে তৃণমূল। রাজ্যের ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে তারা পেয়েছে ২৯টি। সেখানে বিজেপি পেয়েছে ১২টি আসন। আর কংগ্রেসের ঝুলিতে গিয়েছে একটি আসন। লোকসভা নির্বাচনে ফলের ভিত্তিতে ছাব্বিশের বিধানসভা নির্বাচনে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল। কিন্তু, আরজি কর কাণ্ড ঘিরে জুনিয়র ডাক্তার ও সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের পর রাজনৈতিক মহলে নানা জল্পনা শুরু হয়েছে। আরজি কর কাণ্ডের নিন্দা করে রাস্তায় নেমেছেন সাধারণ মানুষ। রাত দখল করেছেন মহিলারা। এবং শাসকদলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ লক্ষ্য করা গিয়েছে। আর এখানেই উঠছে প্রশ্ন। এই ক্ষোভ কি ভোটবাক্স পর্যন্ত পৌঁছবে? আরজি কর কাণ্ডের প্রভাব কতটা পড়বে ভোটবাক্সে?
এই উপনির্বাচনের ফলাফলে আরজি কর ইস্যুতে আন্দোলনের প্রভাব বোঝা যাবে বলে মনে করেন বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। তিনি বলছেন, “আরজি কর ইস্যুতে সাধারণ মানুষ আন্দোলনের জন্য আন্দোলন করছেন, নাকি সরকার পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করেছেন, সেটাই প্রমাণিত হবে।”
কী বলছে রাজ্যের শাসকদল?
উপনির্বাচনে ৬টি আসনেই জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী রাজ্যের শাসকদল। ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার পরই তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, ৬টি আসনেই জিতবে তৃণমূল। একইসঙ্গে বামেদের খোঁচা দিয়ে তিনি বলেন, “যারা ইদানিং মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়াতে লাফাচ্ছে, সেই সিপিএম, লিখে রাখুন, ৬টাতেই আবার তৃতীয় বা চতুর্থ।”
লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রীতে ভর করেই যে তাঁরা ভোট বৈতরণী পার হতে চাইছেন, তা কিছুটা স্পষ্ট উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন গুহর কথায়। সিতাইয়ে এক প্রচার সভায় তিনি বলেন, “লক্ষীর ভাণ্ডার দেবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কন্যাশ্রীর টাকা দেবেন, রূপশ্রীর টাকা দেবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর ভোট দেবেন বিজেপিকে, এটা কি হয়? এটা বেইমানি।”
উপনির্বাচনের ফলের প্রভাব নিয়ে কী বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা?
উপনির্বাচনের ফলের প্রভাব কতটা পড়তে পারে ছাব্বিশের বিধানসভা নির্বাচনে? প্রশ্ন শুনে রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভময় মৈত্র বললেন, “উপনির্বাচনে মানুষ গণতান্ত্রিকভাবে সবসময় ভোট দিতে পারেন, তা তো নয়। তাছাড়া তৃণমূল কংগ্রেসের যে সাপোর্ট বেস-লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যসাথী, এইসব প্রকল্পের সুবিধা যে নিম্নবিত্ত মানুষ পেয়েছেন, তাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসায় কতটা ঘুরে যাবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আগের নির্বাচনগুলোতে এইসব প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছে তৃণমূল। ফলে একুশের নির্বাচনে এই ছয়টি আসনের ফলাফল বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুব একটা নেই।”
আরজি কর কাণ্ডের জেরের প্রভাব নিয়ে তিনি বলেন, “জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন এখনও পর্যন্ত অরাজনৈতিক। তাঁরা যদি এখন বলেন, এই উপনির্বাচনে এই দলকে ভোট দিন, তা হলে তার কী প্রভাব পড়ে, সেটা দেখার।” একইসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “কলকাতায় মধ্যবিত্ত বাঙালি রাস্তায় নেমেছেন। শাসকদলের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। কিন্তু, যে এলাকাগুলিতে উপনির্বাচন হচ্ছে, সেখানকার নিম্নবিত্ত মানুষ শুধু টিভিতে দেখে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট দেবেন কি না, তা দেখতে হবে।” উপনির্বাচনের ফলাফল পক্ষে গেলে শাসকদল তা প্রচারে কাজে লাগাবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক এই বিশ্লেষক। তিনি বলেন, “মানুষ যে তাদের সঙ্গে রয়েছেন, সেটা তুলে ধরে ছাব্বিশের আগে প্রচারে এই ফলাফলকে হাতিয়ার করতে পারে তৃণমূল।”
এগারোর পরিবর্তনের আগে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের ঘটনাকে ঘিরে জনমানসে তৎকালীন বাম সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জন্মেছিল। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তা টের পাওয়া যায়। দুটি জেলা পরিষদ দখল করেছিল তৃণমূল। পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা। এরপর ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে আসনসংখ্যায় সিপিএমকে পিছনে ফেলে দিয়েছিল তৃণমূল। ঘাসফুল শিবির পেয়েছিল ১৯টি আসন। আর বামফ্রন্ট পেয়েছিল ১৫টি। তারপর সরকার পরিবর্তনের দেওয়াল লিখন ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে।
২০২৬-র বিধানসভা ভোটের আগে এই উপনির্বাচনকে অনেকেই অ্যাসিড টেস্ট বলছেন। তার ফলাফল সত্যিই কি কোনও ইঙ্গিত দেবে? বিধানসভা কিংবা লোকসভা নির্বাচনে ভোটগ্রহণের আগে জনমত সমীক্ষা করা হয়। আর ভোটগ্রহণের পর বিভিন্ন বুথফেরত সমীক্ষা সামনে আসে। যেখানে সব ভোটারদের বক্তব্য নেওয়া হয় না। কিন্তু, সমীক্ষা এমনভাবে করা হয়, যাতে ভোটের ফলাফলের আভাস পাওয়া যায়। কখনও তা মেলে, কখনও মেলে না। এই ৬ আসনে ভোটের ফলাফল কি ছাব্বিশের বিধানসভা ভোটের জনমত সমীক্ষা হয়ে দেখা দেবে? উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও প্রায় দেড় বছর।