সম্পর্কে যেতে বাধা কেন, কমিটমেন্ট ফোবিয়ার কারণ কি ব্যক্তি-‘স্বাধীনতা’ হারানোর ভয়?

‘মানুষ বড় একলা’। তাঁদের কোনও সঙ্গী নেই। এমন অনেকেই আছেন যাঁরা সম্পর্কে জড়াতে ভীত। অন্য কোনও মানুষকে ‘কমিট’ করতে পিছপা। কেন এই ভয়? কেন এই শঙ্কা? ‘কমিটমেন্ট ফোবিয়া’ নাকি অন্য কোনও কারণ লুকিয়ে আছে নেপথ্যে।

সম্পর্কে যেতে বাধা কেন, কমিটমেন্ট ফোবিয়ার কারণ কি ব্যক্তি-‘স্বাধীনতা’ হারানোর ভয়?
Follow Us:
| Updated on: Aug 20, 2021 | 1:06 PM

‘মানুষ বড় একলা’। তাঁদের কোনও সঙ্গী নেই। এমন অনেকেই আছেন যাঁরা সম্পর্কে জড়াতে ভীত। অন্য কোনও মানুষকে ‘কমিট’ করতে পিছপা। কেন এই ভয়? কেন এই শঙ্কা? ‘কমিটমেন্ট ফোবিয়া’ নাকি অন্য কোনও কারণ লুকিয়ে আছে নেপথ্যে। অনেকেই মনে করেন, সম্পর্কে প্রবেশ করলে কিংবা বিয়ে করলে আমিত্বের ‘স্বাধীনতা’ হারিয়ে যেতে পারে। হারিয়ে যেতে পারে নিজেকে নিয়ে মেতে থাকার আনন্দ। স্বাধীনতা দিবসে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করল TV9 বাংলা। কথা বলল মনোবিদ, জনস্বার্থ বিশেষজ্ঞ, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে।

ডঃ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোবিদ

মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় আমি এই বিষয়টিকে অন্যভাবে প্রত্যক্ষ করেছি। আমরা যখন দেখি কোনও মানুষ বলছেন, তিনি বিবাহে যেতে চাইছেন না, তাঁকে আমি ‘কমিটমেন্ট ফোবিক’ বলে দাগিয়ে দেওয়ায় বিশ্বাস করি না। ‘কমিটমেন্ট ফোবিক’ শব্দটিকে আমরা অনেকসময় লঘুভাবে প্রয়োগ করি। একজন ব্যক্তির মানসিক পরিস্থিতি, জীবনের ইতিহাস, অভিরুচি তাঁর সম্পর্কের সিদ্ধান্তকে নির্ধারণ করে। কেন একজন মানুষ সম্পর্কে আবদ্ধ হতে চাইছেন না, তিনি আসলে কীসে আবদ্ধ হতে চাইছেন না, তাঁর কোথায় বাধা, এটা আমাদের আগে বুঝতে হবে। তাঁর অনীহা সম্পর্কে নাকি সম্পর্কের প্রাতিষ্ঠানিক চুক্তিতে, দেখতে হবে। অনেকসময় দেখা যায়, কোনও ব্যক্তির বিবাহ প্রতিষ্ঠানটির প্রতি অনীহা আছে। কিন্তু তাঁর যৌথতায় বা সহবাসে আপত্তি নাই-ই থাকতে পারে। আবার এ-ও হতে পারে কেউ হয়তো নতুন করে কোনও সম্পর্কের দায়িত্ব নিতে চাইছেন না, কারণ তার উপর ইতিমধ্যেই অনেকের দায়িত্ব আছে। একটা সম্পর্কে থাকাকালীন অন্য কারও প্রতি আকৃষ্ট হলে কী হবে—শুধুমাত্র এই চিন্তায় কেউ সম্পর্কের কমিটমেন্টে ঢোকেন না, এমনটা না-ও হতে পারে। আমরা এখন ওপেন রিলেশনশিপ, পলিঅ্যামোরাস সম্পর্কে এক্সপোজ়ড। সুতরাং কারও যদি মনে হয় একজনের সঙ্গে সম্পর্কে থাকার সময় অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্কে যাবেন, সেটা নিয়ে পার্টনারের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতে পারেন। আমাদের শহরে এমন অনেক কাপল আছেন, যাঁরা ওপেন রিলেশনশিপে আছেন। কমিটমেন্টকে তাঁরা অন্যভাবে সজ্ঞায়িত করেছেন। কমিটমেন্টের সংজ্ঞা কার কাছে কী, সেই মানুষটি কতখানি ঘনিষ্ঠতায়, কতটা অন্তরঙ্গতায়, কতটা যৌথতায় যাবেন—এই বিষয়গুলি নির্ভর করে তাঁর চাওয়া না-চাওয়ার উপর। তাঁর সঙ্গে যিনি সম্পর্কে যাবেন, তিনি বুঝে নেবেন অন্য মানুষটির কমিটমেন্টের সংজ্ঞায় তিনি স্বচ্ছন্দ কি না। যদি কোনও মানুষের মনে হয় ‘আমি একা থাকতে ভালবাসি’, তাঁকে ‘কমিটমেন্ট ফোবিক’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। তাঁর জীবনেও অন্য সম্পর্কের কমিটমেন্ট থাকতে পারে। সব কমিটমেন্টকেই শুধু রোম্যান্স বা যৌনতা দিয়েই দেখতে হবে কেন?

ডঃ সুর্বণ গোস্বামী, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

এটা সম্পূর্ণ মনের ব্যাপার। অনেকগুলো বিষয় থেকে এমনটা হতে পারে। সাইকোলজিতে ‘অ্যাটাচমেন্ট থিওরি’ বলে একটি বিষয় আছে। একদম ছোটতে কেয়ারগিভারদের (মা, বাবা কিংবা তাঁদের সমবয়সীরা) সঙ্গে তাঁর কেমন সম্পর্ক ছিল, বড় বয়সে প্রভাব ফেলে ভীষণ রকম। সেই সম্পর্কের উপরই নির্ভর করে পরবর্তীকালে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তাঁর সম্পর্ক কীরকম হবে। যে সন্তান বাবা-মাকে খুব একটা পায়নি কিংবা বাবা-মা দু’জনেই কাজে ব্যস্ত থেকেছেন, তাদের ছটফটানি অনেকখানি বেশি হয়। বারবার মনে হয়, কারও সঙ্গে সম্পর্কে বেশি জড়িয়ে পড়লে কষ্ট পেতে হবে। অন্য কারও ক্ষেত্রে পূর্ব সম্পর্কের তিক্ত অভিজ্ঞতাও একটা বিষয় হয়ে উঠতে পারে। কারও ক্ষেত্রে হয় ট্রমা কিংবা আতঙ্ক। ছোটবেলার যৌন হেনস্থা। সেই ট্রমা থেকেও অনেকে সম্পর্কে জড়াতে চান না। ভয় পান। আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েন। সুতরাং, এক-একজনের ক্ষেত্রে বিষয়টা এক-একরকম হতে পারে। ব্যক্তির আমিত্বের বিষয়টা এখন খুবই কমন জায়গা নিয়ে নিয়েছে। সম্পর্কে গেলে ব্যক্তির স্বাধীনতা চলে যাবে, অনেকের মনেই এই বিষয়টি জায়গা পেতে শুরু করেছে। এখনকার সমাজে পরিবারতন্ত্রের সংজ্ঞা পালটাচ্ছে। স্বাধীনতা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকখানি এক্সপোজ়ার বেড়েছে। তবে ছেলেরা না মেয়েরা, কারা কমিটমেন্টে কুণ্ঠাবোধ করেন বেশি, এর কোনও পরিসংখ্যান নেই। তবে এই ফোবিয়া থেকে বেরনোর উপায় আছে। কাউন্সেলিং করা যেতে পারে। ছোট-ছোট কমিটমেন্ট দিয়ে বিষয়টা শুরু করা যেতে পারে।

ঐন্দ্রিলা সেন, অভিনেত্রী

এটুকু বলতে পারি সম্পর্কে যাওয়ার পর আমার স্বাধীনতা অনেকখানি বেড়ে গিয়েছে। কাউকে ছোট করে কিছু বলতে চাই না, আমার মনে হয় ‘কমিটমেন্ট ফোবিয়া’ বিষয়টি ব্যক্তি বিশেষে অভিজ্ঞতা থেকে আসে। কারও হয়তো সম্পর্কে তিক্ততা ছিল। পার্টনার হয়তো অত্যন্ত অত্যাচারী ছিল কিংবা অসৎ ছিল। সেই জন্যই হয়তো তাঁদের স্বাধীনতার প্রয়োজন হয়েছে। কিন্তু যাঁরা সম্পর্কে ভাল আছেন, তাঁদের সম্পর্কে থাকতেই বেশি ভাল লাগে। ব্যক্তিবিশেষে নির্ভর করে কার কীরকম অভিজ্ঞতা। আমার যদি অভিজ্ঞতা ভাল না হত, আমিও হয়তো বলতাম একাই ভাল আছি। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সেটা একেবারেই হয়নি। আমি আর অঙ্কুশ ছোটবেলায় খুব ভাল বন্ধু ছিলাম। আমাদের প্রেম হয়েছে অনেক পড়ে। কিন্তু কখনওই আমাকে কোনও কিছুতে ও বাধা দেয়নি। সবসময় খুব সাপোর্ট করেছে। তাই স্বাধীনতা চলে গেছে সেটা আমি বলতে পারব না।

মৈনাক বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিনেতা

অনেকের মতো আমার জীবনেও প্রেম এসেছিল। সেই প্রেম ভেঙেও যায়। একটা পর্যায় গিয়ে মনে হয়েছিল আমি ভীষণ স্বাধীন মানুষ। মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়াতে পারব। আর একটা পর্যায় আমার মনে হয়েছিল কথা বলার কোনও মানুষ নেই। কথা বলার মানুষের খুব প্রয়োজন। এই দু’টি অনুভূতিই ভীষণভাবে আমাকে চেপে ধরেছিল। কিছুটা মাত্রায় কমিটমেন্ট ফোবিয়া আমার মধ্যেও আছে, কিন্তু আমি নিজেকে ‘কমিটমেন্ট ফোবিক’ বলতে চাই না। কার সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক তৈরি হবে, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। সব মানুষ সমান নয়। কার সঙ্গে কোন সম্পর্কে কী অভিজ্ঞতা হবে, সেটা আগে থেকে ভেবে সম্পর্ক থেকে পিছপা হওয়ার কোনও মানে হয় না।

প্রত্যুষা পাল, অভিনেত্রী

আমার সঙ্গে একজনের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। আপনারা সকলেই তাঁকে চেনেন। তিনি অভিনেতা ফারহান ইমরোজ। ২০১৮ সালে সে আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আমি আজও ওর চলে যাওয়ার কারণটা জানি না। হঠাৎই ও চলে যায়। আমি কিন্তু খুব মন দিয়ে ভালবেসেছিলাম। মনের মধ্যে কোনও জড়তা বা ফোবিয়া কাজ করেনি আমার। বুকের মধ্যে ইংরেজিতে বড়বড় করে ফারহানের নামের ট্যাটু করিয়েছিলাম। ছাড়াছাড়ি হওয়ার পরও তিন বছর সেই ট্যাটু আমার বুকে ছিল। ২৮ জুলাই আমার জন্মদিনের দু’দিন আগে ট্যাটুটা মুছে দিয়েছি। সেটাই আমার নিজেকে দেওয়া রিটার্ন গিফ্ট। কোনও ‘কমিটমেন্ট ফোবিয়া’ ছিল না বলেই সম্পর্কে নিজেকে উজাড় করে দিতে পেরেছিলাম। কিন্তু যেভাবে সেটা শেষ হল আমার মনে হয় না আর কোনও সম্পর্কে এখনই যেতে পারব। আমার আর কাউকে বিশ্বাসই হবে না।

গ্রাফিক্স: অভীক দেবনাথ