AQI
Sign In

By signing in or creating an account, you agree with Associated Broadcasting Company's Terms & Conditions and Privacy Policy.

মাটিতে পড়ে ছেলের দেহ, মা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে! করোনা শেখাচ্ছে সহায়হীন পরিবারগুলো কতটা একা

করোনাকালে (COVID-19) দেখা গেল, এটা সমাজের নির্দিষ্ট কোনও শ্রেণির ব্যাধি নয়, শহুরে কংক্রিটের আকাশচুম্বী আবাসন থেকে নোনা ধরা দেওয়ালের কোনও ছোট্ট সংসার—বয়স বাড়লে বড় বেশি মালুম হয় একাকিত্ব।

মাটিতে পড়ে ছেলের দেহ, মা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে! করোনা শেখাচ্ছে সহায়হীন পরিবারগুলো কতটা একা
নিজস্ব চিত্র।
| Updated on: Jun 03, 2021 | 5:57 PM
Share

কলকাতা: ভয়ঙ্কর এই অতিমারি (COVID-19) প্রতি নিয়ত শেখাচ্ছে, শিখিয়েই যাচ্ছে! আত্মযোগ্যতা থেকে সহিষ্ণুতা কিংবা মানবিকতা, কতটুকু ধারণ ক্ষমতা আমাদের সে পাঠই পড়াচ্ছে অবিরত। আজকাল খবরের কাগজ কিংবা খবরের সাইটগুলি খুললেই ভেসে ওঠে মানুষের অসহায়তার বিমূর্ত সব খণ্ডচিত্র। কোনওটায় গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে কান্না, কোনওটা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আক্ষরিক অর্থে আমরা কতটা অসহায়।

সম্প্রতি বাগুইআটি কেষ্টপুরের একটি ঘটনা বেশ আলোচনায় উঠে এসেছে। ৭২ বছর বয়সী অসহায় এক মা ও তাঁর ৪০ বছর বয়সী আইনজীবী ছেলের মর্মন্তুদ পরিণতি! মেঝের উপর পড়ে রয়েছে ছেলের সারহীন দেহ। ঘরের বিছানায় বসে ফ্যালফ্যাল করে মরা ছেলেকে দেখছেন মা। এর বেশি কিছু করার মত তাঁর চলচ্ছত্তি নেই। দরজার কড়া নেড়েছে পড়শিরা। মা যে উঠে গিয়ে দরজা খুলবেন সে ক্ষমতাও তাঁর নেই। পরে পুলিশ এসে দরজা ভেঙে দেহ উদ্ধার করে।

পুলিশ জানতে পারে, বছর খানেক আগে স্বামীকে হারান ওই মহিলা। তিনজনের সংসারে, একজন বাদ। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই ওই মহিলা আবার শয্যাশায়ী। তবু ভরসা ছিল জোয়ান ছেলে। মায়ে-ছেলেতে মিলে অতিমারির দিনগুলি কেটে যাচ্ছিল একরকম। কিন্তু আচমকা মৃত্যু হয় ছেলের। এরপরই আরও একবার সামনে আসে সমাজের অসহায়, একাকিত্বের ঘুন ধরা চেহারা। কোনও পরিবার যদি অসহায় হয়, তাদের দেখাশোনার যদি কেউ না থাকে তা হলে কী করুণ পরিণতি হতে পারে দেখাল এই পরিবার।

তবে এরকম ঘটনা প্রথমবার হল এমনটা নয়। কিছুদিন আগেই উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায় এমনই এক অসহায়তার ছবি দেখা গিয়েছিল। ছেলে মানসিক ভারসাম্যহীন, বৃদ্ধা মা ভিক্ষা করে কোনও ভাবে সংসার ঠেলেন। প্রতিবেশীরা এলাকায় মানুষ পচার গন্ধ পান। এরপর পুলিশ এসে দেখে বৃদ্ধা মা ঘরে পড়ে রয়েছে। আর তা আগলে বসে আছে ছেলে। এই ঘটনার পর ওই ছেলে জানিয়েছিলেন, মা মারা গিয়েছে তা তিনি প্রতিবেশীদের বলেছেন। কিন্তু পড়শিদের সাহায্য না পেয়ে বাধ্য হয়ে মাকে ঘরে রাখতে হয়। ছেলে যেহেতু মানসিক ভারসাম্যহীন তাই এই দাবি নিয়ে খুব বেশি নাড়াচাড়া হয়নি। ধামাচাপাই পড়ে গিয়েছে।

কিন্তু এও তো এক কঠিন সত্যি! হতেও তো পারে, শুধুমাত্র ছেলেটা মানসিক ভারসাম্যহীন বলে তাঁর কথাকে আমল দেননি পাড়ার লোকেরা। পরে দুর্গন্ধে টিকটে না পেরে পুলিশকে জানান। সমাজ যে এই ধরনের মানুষকে খুব একটা আমল দেয় না, তাও আমরা দেখি।

আরও পড়ুন: ইয়াসে ক্ষতি হয়েছে বললেই ক্ষতিপূরণ নয়, ত্রিস্তরীয় পরীক্ষার পরই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা

আবার গত মাসেই হাওড়ার ওলাবিবিতলায় এক বৃদ্ধার স্বামী ও বোনের মৃত্যু হয়। দু’খানা মৃতদেহ আগলে বছর সত্তরের এক বৃদ্ধাকে দুয়ার এঁটে বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল সেদিন। পরে পাড়ার লোকজন ও পুলিশের উদ্যোগে দেহ সৎকারের ব্যবস্থা হয়। পরে জানা যায়, এ পরিবারের এক ছাইচাপা যন্ত্রণার কথা। বৃদ্ধার এক ছেলে মানসিক ভাবে অসুস্থ। মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি সে। ওখানেই থাকে। বুড়ো বাবা-মা সে যন্ত্রণা বইতে বইতে নিজেরাও কেমন একটা হয়ে গিয়েছেন। এই দম্পতির সঙ্গেই থাকতেন বৃদ্ধার বোন।

এ ধরনের ঘটনায় হিসাব মেলাতে গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা মেলে না। ফাঁকফোকর গলে বহু প্রশ্ন মাথা তুলে দাঁড়ায়। কিন্তু সে সব খানিক দূরে ঠেলে, মগজ নয়, শুধুই যদি মন দিয়ে ভাবা যায়, দেখা যাবে সব ক্ষেত্রেই ‘কমন সিনড্রম’— একাকিত্ব, সহায়-সম্বলহীনতা। এতদিন আমরা জানতাম, এ শহরে অনেক ফ্ল্যাটবাড়ির অন্দরে একাকিত্ব দাপিয়ে বেড়ায়। সে সবের সঙ্গে সহবাস করেন কোনও অশীতিপর কিংবা নবতিপর ‘তরুণী’, বয়সের ভারে ন্যুব্জ কোনও ‘ওল্ড ম্যান’।

করোনাকালে দেখা গেল, এটা সমাজের নির্দিষ্ট কোনও শ্রেণির ব্যাধি নয়, শহুরে কংক্রিটের আকাশচুম্বী আবাসন থেকে নোনা ধরা দেওয়ালে গণ্ডীবদ্ধ কোনও ছোট্ট সংসার—বয়স বাড়লে বড় বেশি মালুম হয় একাকিত্ব। আর অসুস্থতা শরীরে বাসা বাধলে তখন উদভ্রান্তের মত মাথাচাড়া দিতে থাকে সে। এ সময় সহায় দরকার। তা না হলে কেষ্টপুর থেকে চাপড়া কিংবা ওলাবিবিতলা, পরিণতি একই।