Jamtara of Bengal: হাত পাকিয়ে সাইবার জালিয়াতিতে সাবালক! বাংলার বুকে এক টুকরো জামতাড়া চোপড়া?
Jamtara of Bengal: সাইবার জালিয়াতিতে বাঁংলা কাঁপাচ্ছে উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া। ট্যাবের টাকা জালিয়াতিকাণ্ডে লালবাজারের তদন্তে নাম উঠে এসেছে বিহার ও বাংলাদেশ লাগোয়া চোপড়ার প্রত্যন্ত এলাকার নাম। গ্রেফতারির সংখ্যাতেও এগিয়ে এই চোপড়া। ঠিক কী চলছে সেখানে?
রূপক সরকার ও প্রসেনজিৎ চৌধুরী
কখনও এটিএমের পিন জেনে টাকা হাতানো, কখনও সেক্সটরশন, কখনও হাতিয়ার সোশ্যাল মিডিয়া। বিগত কয়েক বছরে কার্যত গোটা দেশের বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে একটাই নাম, ‘জামতাড়া’। ঝাড়খণ্ডের এই ছোট্ট এলাকার ছেলেপুলেদের দাপটে কার্যত নাভিশ্বাস উঠেছে গোটা দেশের। অন্তর্জালের জাল ছড়িয়ে প্রযুক্তির অগ্রগতিকে ‘আশীর্বাদরূপে’ গ্রহণ করেছে ‘জামতাড়া গ্যাং’। আর তাঁদের অভিশাপেই সর্বস্ব খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছে হাজার হাজার মানুষ। আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। চোর-পুলিশের খেলাও চলেছে। কিন্তু, তাতে কী! কালো টাকায় পকেট দিনে দিনে আরও ফুলেছে জামতাড়ার ছেলে-ছোকরাদের। এবার যেন বাংলার বুকেই এবার মিনি ‘জামতাড়া গ্যাং’। অনেকেই বলছেন, বাংলার মিনি জামতাড়া চোপড়াই। ট্যাব জালিয়াতিতে বিগত কয়েকদিনে যেভাবে চোপড়ার নাম জড়িয়েছে তা দেখে এ কথা বলছেন অনেকেই। ট্যাবের টাকা জালিয়াতি কাণ্ডে লালবাজারের তদন্তে বারবার উঠে এসেছে বিহার ও বাংলাদেশ লাগোয়া চোপড়ার নাম।
কেন ‘কুখ্যাত’ চোপড়া?
এই খবরটিও পড়ুন
সংখ্যালঘু স্কলারশিপের টাকা জালিয়াতিতেও নাম উঠেছিল চোপড়ার। চোপড়ার নাম জড়িয়েছিল আধার কার্ড জালিয়াতিতেও। সংখ্যালঘু স্কলারশিপের টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রেও নাম ছিল সেই চোপড়ার। চোপড়ায় হাই স্পিড ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের তালিকা তৈরি করছে পুলিশ। কারা ব্রডব্যান্ড কানেকশন ব্যবহার করছেন, কত ইন্টারনেট ক্যাফে বা সিএসপি রয়েছে সেসব খতিয়ে দেখছে ইসলামপুর জেলা পুলিশ। চোপড়া থেকে যে সাদিক হোসেনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ, চার বছর আগে সেই সাদিকের দাদাকেই সাইবার জালিয়াতিতে গ্রেফতার করেছিল তামিলনাড়ু পুলিশ। পুলিশ বলছে শুধু বাংলা নয়, দেশজুড়েই এখন বিস্তৃত চোপড়ার পেশাদার মিনি জামতাড়া গ্যাংয়ের নেটওয়ার্ক। মিনি জামতাড়ার কাজকর্মে রাতের ঘুম উড়েছে রাজ্য পুলিশেরও।
পুলিশ বর্তমানে রাজ্যের ১৫ জেলায় ছড়িয়েছে ট্যাব কেলেঙ্কারির জাল। এ নিয়ে একদিন আগেই সাংবাদিক সম্মেলন করেন এডিজি দক্ষিণবঙ্গ সুপ্রতিম সরকার। পুলিশ সূত্রে খবর, ট্যাব কেলেঙ্কারিতে এখনও পর্যন্ত গ্রেফতারির সংখ্যা ১১। ৯৩টি মামলা রুজু হয়েছে। ১৯১১ জন পড়ুয়া প্রতারিত হয়েছে। যদিও সরকার-পুলিশ বলছে চিন্তার কোনও কারণ নেই। যাঁদের টাকা গায়েব হয়েছে তারা প্রত্যেকেই টাকা পাবে। কিন্তু, সরকারি পোর্টাল হ্যাক করে কী করে চলল এই জালিয়াতি? সরকারই বা কী করছিল? কীভাবেই বা নির্দিষ্ট কিছু পড়ুয়ার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ডিটেলস পেল হ্যাকাররা? প্রশ্ন রয়েছে গুচ্ছ গুচ্ছ।
চোপড়ার নাম প্রথম উঠে এল কবে?
২০২৩ সালে প্রথম চোপড়ায় সাইবার জালিয়াতি চক্রের হদিশ মেলে। আধার (AEPS) প্রতারণা চক্রের হাব ছিল চোপড়া। ধৃতদের থেকে থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট জাল করার জন্য বিশেষ আঠা জাতীয় কেমিক্যাল, বায়োমেট্রিক স্ক্যানিং মেশিন, জাল আধার সহ অনেক আধার সংক্রান্ত নথি উদ্ধার হয়। শুধু চোপড়া থেকেই গ্রেফতার করা হয়েছিল তিনজনকে। যাদের মধ্যে ১ জন নাবালক থাকায় ২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ হয়। চলতি বছর ধৃতদের জেল ও জরিমানা হয়।
এবারও কার্যত একই ছবি। দেখায় ১৫ জেলা থেকে প্রতারিত অ্যাকাউন্ট থেকে সিংহভাগ টাকা পৌঁছে গিয়েছে চোপড়ায়। ভাড়া খেটেছে বহু অ্যাকাউন্ট। ১০ হাজার টাকা রাখলে ব্যক্তি বিশেষে দেওয়া হয়েছে তিনশো থেকে পাঁত হাজার টাকা। সে কারণেই লালাবাজারের গোয়েন্দাদের শুরু থেকেই বিশেষ নজর ছিল এই চোপড়ার উপরেই। এখনও পর্যন্ত এই চক্রে উত্তর দিনাজপুর থেকে গ্রেফতারের সংখ্যা ৭। ধৃতদের মধ্যে ২ জন ইসলামপুর থানা ও বাকিরা চোপড়া থানার বাসিন্দা। তবে এখনও পর্যন্ত মূল পান্ডা বা চক্রের মাস্টার মাইন্ডের খোঁজ না মিললেও সাইবার জালিয়াতি যে চোপড়ায় কার্যত কুটিরশিল্পে পরিণত হয়েছে তা মানছেন অনেকেই।
কোন পথে চলেছে ট্যাব জায়িলাতি?
একটি সূত্রে খবর, ফিঙ্গারপ্রিন্ট জাল করার মতোই সরকারি পোর্টালে ঢুকে অ্যাকাউন্ট নম্বর জাল করতো প্রতারকেরা। এদিকে ট্যাবের জন্য আবেদন করতে হয় বাংলার শিক্ষা পোর্টালে। এই পোর্টালকে হাতিয়ার করেই জালিয়াতি চলেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে। এদিকে বাংলার শিক্ষা পোর্টালের অ্যাকসেস থাকে শিক্ষক, স্কুল, কিংবা কোনও প্রশাসকের (অ্যাডমিনিস্ট্রেটর) হাতে। অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সেকশনে গেলে লগ ইন করার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ইউজার নামের ক্ষেত্রে স্পেশ্যাল ক্যারেক্টার দিয়ে ‘ইউজার নেম’ দেওয়া যাচ্ছে। কিন্তু একই পোর্টালেরই আর একটা অংশে লগ ইনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে কোনও স্পেশ্যাল ক্যারেক্টার দেওয়া যাচ্ছে না। সাইবার বিশেষজ্ঞ সাম্যজিৎ মুখোপাধ্যায় বলছেন, “এই ধরনের সাইটে অ্যাডমিন লগ ইন প্যানেলে স্পেশ্যাল ক্যারেক্টার অফ করে রাখা একটা প্রাইমারি কাজ। সিকিউরিটির জন্য এটা করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা দেখা যাচ্ছে। তাঁদের আশঙ্কা, এই ফাঁককে কাজে লাগিয়ে চলতে পারে হ্যাকিং।”
উত্তর দিনাজপুরের কোথায় কোথায় গ্রেফতারি?
ট্যাব কাণ্ডে অন্যান্য জেলার পাশাপাশি উত্তর দিনাজপুরের নানা প্রান্তেও লাগাতার হানা দিয়েছে পুলিশ। জেলা পুলিশের সঙ্গে যৌথ অভিযান চালিয়েছেন গোয়েন্দারা। তাতেই অনেকাংশে মিলেছে সাফল্য। প্রথম দফায় গ্রেফতার করা হয় মোট ৩ জনকে। এর মধ্যে দু’জন চোপড়ার। তালিকায় আশারুল হোসেন (ইসলামপুর থানার রামগঞ্জ এলাকা), সাদ্দিক হোসেন (চোপড়া), মোবারক হোসেন (চোপড়া)। দ্বিতীয় দফায় গ্রেফতার দুই। তালিকায় কৃষ্ণপদ বর্মন (চোপড়া), সরিফুল ইসলাম (চোপড়া)। তৃতীয় দফায় গ্রেফতার ১। তালিকায় নুর আলম (চোপড়া)। চতুর্থ দফায় গ্রেফতার ১। গ্রেফতার করা হয় ইসলামপুরের মহঃ আলম মুস্তাকিনকে। তদন্ত চলছে পুরোদমে। এখন দেখার শেষ পর্যন্ত আরও কোন রহস্য উদঘাটন হয়।