EXPLAINED: ‘বাটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে’ স্লোগানে ‘বাংলা জয়’ করতে পারবেন শুভেন্দুরা?
Suvendu Adhikari: এক যুগ আগে রাজ্যে যে দল জমি শক্ত করার জন্য লড়ছিল, সেই বিজেপি একুশের নির্বাচনে সরকার গড়া নিয়ে আশাবাদী ছিল। রাজ্যে পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের আর বছর দেড়েকও বাকি নেই। সেই নির্বাচনে কীভাবে জয়লাভ করতে পারে বিজেপি? সেই অঙ্ক বাতলে দিলেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। শুভেন্দুর সেই 'অঙ্ক' নিয়ে কী বলছে বিরোধীরা? পড়ুন টিভি৯ বাংলার বিশেষ প্রতিবেদন...
কলকাতা: ১৯৮২ সাল। প্রথমবার বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনের ময়দানে নামে তারা। তারপর একের পর এক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কিন্তু, ভোট ময়দানে তেমন সাফল্য আসেনি। আর সেই বিজেপি এখন পশ্চিমবঙ্গে প্রধান বিরোধী দল। ২০২১ সালে রাজ্যে পালাবদলের স্বপ্ন দেখেছিল বঙ্গ বিজেপি। পালাবদল না হলেও বিজেপির আসন এক ধাক্কায় ৩ থেকে বেড়ে হয় ৭৭। ভোট পায় ৩৮ শতাংশ। আর বছর দেড়েকের মধ্যেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। সেই নির্বাচনের ঘুঁটি এখন থেকেই সাজাতে শুরু করেছে বিজেপি। কোন পথে আসবে কাঙ্খিত ফল? আর কত শতাংশ ভোট পেলেই হবে বাজিমাত? অঙ্ক মেলাতে কাদের জোটবদ্ধ হতে হবে? সব হিসেব দিলেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।
বাংলায় বিজেপির প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতা-
২০২৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির লক্ষ্যভেদের ‘অঙ্ক’ নিয়ে আলোচনার আগে এরাজ্যে বিজেপির নির্বাচনী পথচলা একবার ফিরে দেখা যাক। ১৯৮২ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে প্রথমবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল বিজেপি। ৫২টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। কোনও আসনই জিততে পারেনি। ভোট পেয়েছিল প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার।
এই খবরটিও পড়ুন
আর লোকসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাংলায় প্রথমবার বিজেপি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল ১৯৮৪ সালে। ৯টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। মোট ভোট পেয়েছিল ১ লক্ষের সামান্য বেশি। শতাংশের হিসেবে ০.৪।
কী বলছে একুশের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল-
এক যুগ আগে রাজ্যে যে দল জমি শক্ত করার জন্য লড়ছিল, তারাই একুশের নির্বাচনে সরকার গড়া নিয়ে আশাবাদী ছিল। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে পালাবদল হবে কি না, তা নিয়ে জোর জল্পনা চলেছিল। বিজেপি নেতারা ২০০-র বেশি আসন পাওয়ার কথা বলেছিলেন। আট দফায় নির্বাচন হয়। ভোট দেন ৬ কোটির বেশি ভোটার। ফলাফল বেরোতে দেখা যায়, প্রায় ২ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষ তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। সেখানে বিজেপিকে সমর্থন জানান ২ কোটি ২৯ লক্ষ ভোটার। ভোট শতাংশের হিসেবে তৃণমূল প্রদত্ত ভোটের ৪৮ শতাংশ পায়। আর বিজেপি পায় প্রায় ৩৮ শতাংশ ভোট। বিজেপি ৭৭টি আসনে জয়ী হয়। তৃণমূল পায় ২১৫টি আসন।
কী বলছে চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল-
একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে উনিশের লোকসভা নির্বাচনেই তৃণমূলকে জোর টক্কর দিয়েছিল বিজেপি। বাংলায় তারা ১৮টি আসন জিতেছিল। তবে পাঁচ বছর পর তা কমে হয় ১২। ২ কোটি ৩৩ লক্ষ ভোটার বিজেপিকে ভোট দেন। যা প্রদত্ত ভোটের ৩৮ শতাংশের সামান্য বেশি। সেখানে তৃণমূল পায় ৪৫ শতাংশের সামান্য বেশি ভোট। তৃণমূলকে ভোট দেন ২ কোটি ৭৫ লক্ষের বেশি ভোটার। রাজ্যের শাসকদল জেতে ২৯টি আসন।
ক্ষমতায় আসতে হিন্দুভোটে ভর শুভেন্দুর-
চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের ফল বলছে, তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির ৭ শতাংশ ভোটের ফারাক রয়েছে। আর সেই ফারাক দূর করতে হিন্দুভোটকেই হাতিয়ার করছেন শুভেন্দু অধিকারী। ২০২৬ সালে কোন পথে বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারে, সেই অঙ্ক পরিষ্কার তাঁর কাছে।
শুভেন্দু অধিকারী একাধিকবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন, মুসলিম ভোট নয়। হিন্দুদের এককাট্টা করতে হবে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে দলের কার্যকারিণী বৈঠকে তিনি বলেছিলেন, যাঁরা বিজেপিকে ভোট দেয় না, তিনি অন্তত নেই। বলেছিলেন, সবকা সাথ, সবকা বিকাশ নয়। যাঁরা আমাদের সঙ্গে, আমরা তাঁদের সঙ্গে। দলে সংখ্যালঘু মোর্চারও প্রয়োজনীয়তা নেই বলেও উল্লেখ করেছিলেন। যা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল।
কোনও অঙ্কের কথা বলছেন শুভেন্দু?
রাজ্যের মুসলিম ভোট নয়। হিন্দুভোটকে এককাট্টা করে কীভাবে ক্ষমতায় আসা যাবে, সেই অঙ্কের কথা জানিয়েছেন শুভেন্দু। মঙ্গলবার সন্দেশখালির জনসভা থেকে আরও একবার হিন্দুভোটকে এককাট্টা করার বার্তা দিয়েছেন তিনি। গত কয়েকদিনে বারবার তাঁর মুখে শোনা গিয়েছে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ। সেখানে হিন্দু-সহ সংখ্যালঘুদের উপর হামলার নিন্দায় সরব হয়েছেন। আক্রমণ করেছেন ইউনূস প্রশাসনকে। আর বাংলাদেশের প্রসঙ্গ টেনেই তিনি বলছেন, ছাব্বিশের নির্বাচন হিন্দুদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
তাঁর বক্তব্য, “হিন্দুরা এককাট্টা হয়েছে। আর একটু করা দরকার। হিন্দুরা এককাট্টা হয়েছেন বলেই আজ আমি বিধায়ক।” একুশের নির্বাচনে নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, “আমাকে হারাতে গিয়েছিলেন। আমি হারিয়ে পাঠিয়েছি।” আর সেটা হিন্দুভোট এক জায়গায় আসায় সম্ভব হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি যে মুসলিম ভোটে নজর দিচ্ছেন না, সেকথা স্পষ্ট করে দিয়ে সন্দেশখালিতে বলেন, “আমি পাঁচ হাজার শীত বস্ত্র দিলাম। ২৮টি শক্তিকেন্দ্র সন্দেশখালিতে। সেখানে এই শীতবস্ত্র দেওয়া হবে। আর ২৮টা শক্তিকেন্দ্র মানে হিন্দু প্রধান শক্তিকেন্দ্র। মুসলিম এলাকায় আমাদের ব্যাপার নেই কিছু। সোজা কথা সোজা বলা ভাল। তুমি আমার আমি তোমার। ভোট নেই, আমরাও নেই।”
হিন্দুভোটকে এককাট্টা করতে গীতা পড়ার অভ্যাস ফেরাতে চান তিনি। সন্দেশখালি থেকে তাঁর বার্তা, সন্দেশখালিতে তাঁর একটা ভাড়া বাড়ি রয়েছে। সেখানে গীতা বিতরণ সেন্টার করার কথা জানালেন। প্রতি মাসে একবার গীতা বিতরণ হবে। গীতা পড়ার অভ্যাস ফেরাতে হবে।
বামেদের হিন্দু ভোটে নজর শুভেন্দুর-
হিন্দুভোটকে এককাট্টা করতে বামেদের ভোটও যে বিজেপির প্রয়োজন, তা বুঝিয়ে দিলেন শুভেন্দু। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় কোনও আসন না জিতলেও সাড়ে ৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বামেরা। সেকথা উল্লেখ করেই শুভেন্দুর বক্তব্য, “বামেদের হিন্দু ভোটাররা তৃণমূলের সুবিধা করে দিচ্ছেন। আমি বাম হিন্দু ভোটারদের অনুরোধ করব, হিন্দুদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে বিজেপির সঙ্গে আসুন।”
শুভেন্দুর মুখে ‘এক হে তো সেফ হে’ আর ‘বাটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে’ স্লোগান-
মাস দুয়েক আগেই মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার নির্বাচনে বিপুল সাফল্য পেয়েছে বিজেপি। মহারাষ্ট্রে বিজেপির ‘এক হে তো সেফ হে’ স্লোগান নির্বাচনী বৈতরণী পেরোতে অনেকটাই সাহায্য করেছে বলে রাজনীতির কারবারিরা বলছেন। আবার উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ‘বাটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে’ স্লোগান ছড়িয়ে পড়েছিল।
শুভেন্দুর মুখেও সেই একই কথা প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তিনি বলছেন, ছাব্বিশের নির্বাচন হবে হিন্দুদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। তাঁর কথায়, “মহারাষ্ট্রের মতো আর ৫ শতাংশ হিন্দুকে আমাদের পক্ষে ভোট করাতে হবে। আমি তোমার, তুমি আমার। মুসলিমরা আমাদের ভোট দেয় না। সেখানে কেন আমাদের লোকেরা যাবে কর্মসূচি করতে?”
বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার ও শমীক ভট্টাচার্যের মতো নেতারা অবশ্য বলছেন, তাঁরা রাষ্ট্রবাদী মুসলিমদের সঙ্গে রয়েছেন। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সবকা সাথ, সবকা বিকাশের কথাও বলছেন তাঁরা।
বিজেপি ক্ষমতায় এলে কী করবে?
বিজেপি ক্ষমতায় এলে কী করা হবে সেকথাও জানিয়েছেন শুভেন্দু। কী বলছেন তিনি? বিধানসভার বিরোধী দলনেতা বলেন, “বিজেপি ক্ষমতায় এলে উত্তর প্রদেশ করব। সুশাসন, সুরক্ষা। গুজরাট করব। শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান।” একইসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, বিজেপি ক্ষমতায় এলে বাড়ি তৈরির জন্য ৩ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে।
গত কয়েকদিনে বাংলায় অনুপ্রবেশ নিয়েও সরব হয়েছেন তিনি। শুভেন্দু জানিয়ে দিলেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে ৬ মাসের মধ্যে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের পরিষ্কার করা হবে।
কী বলছে তৃণমূল?
শুভেন্দুর মন্তব্য নিয়ে রাজ্যের শাসকদলের স্পষ্ট বক্তব্য, এভাবে ক্ষমতায় আসা যাবে না বাংলায়। রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, “বিজেপির এই রাজনীতি নতুন নয়। শুভেন্দু নতুন কথা কিছু বলছেন না। বিজেপি সর্বদা হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে ভাগাভাগি করে রাজনীতির চেষ্টা করে। মানুষের মধ্যে বিভাজনের চেষ্টা করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই কাজ করেন না। তিনি সর্বধর্মের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চলেন। সেই কারণে দুর্গাপুজো, ইদ, খ্রিস্টমাস এবং শিখদের উৎসবে দেখা যায় তাঁকে। আর এভাবে বাংলায় ক্ষমতায় আসতে পারবে না বিজেপি।”
কী বলছে কংগ্রেস?
শুভেন্দুর হিন্দুভোট এককাট্টা করার পিছনে বিজেপি ও তৃণমূলের আঁতাত দেখছে কংগ্রেস। প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, “মেরুকরণের রাজনীতি করে বিজেপি। আর তার ফায়দা তোলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এভাবেই নরেন্দ্র মোদী ও মমতার মধ্যে ভোট ভাগাভাগির প্রক্রিয়া চলছে গত কয়েক বছর ধরে। এই বাংলায় বিজেপির কোনও অস্তিত্ব ছিল না। তাই, এই বাংলাকে সবার কাছে তুলে ধরতাম, সংস্কৃতির বাংলা, শিক্ষার বাংলা, সম্প্রীতির বাংলা হিসেবে। কিন্তু, মমতা বামেদের হটানোর জন্য প্রথম বাংলায় বিজেপিকে আনেন। তাদের সাংসদ করা হয়। তারা জানে, নির্বাচনে জেতার এটাই সহজ পদ্ধতি। সস্তায় পুষ্টিকর নির্বাচন করতে গেলে মেরুকরণ করো। তখন আর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরির কথা মাথায় আসবে না।”
রাজ্যে মুসলিম ভোট-
রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ মুসলিম। জেলাগুলির মধ্যে উত্তর দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ ও মালদায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই তিন জেলায় বিধানসভা আসনের সংখ্যা ৪৩। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে এই তিন জেলায় বেশিরভাগ আসন জিতেছে তৃণমূল। রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, রাজ্যে শতাধিক আসনে নির্ণায়ক ভূমিকা নেয় সংখ্যালঘু ভোট। ২০১১ সাল থেকে সংখ্যালঘু ভোটের বেশিরভাগই পেয়ে আসছে শাসকদল তৃণমূল। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে আইএসএফ তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসাতে পারবে কি না, তা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। কিন্তু, ভোটের ফল বলছে, তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে বিশেষ থাবা বসাতে পারেনি আইএসএফ। শুধু ভাঙড় আসনটি জিতেছে তারা। আবার চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে আইএসএফের প্রাপ্ত ভোটের হার বলছে, তৃণমূলের সংখ্যালঘু সমর্থন কমেনি।
রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, ছাব্বিশের বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে আচমকা ধস নামবে, সেরকম সম্ভাবনা এখনও নেই। ফলে শুভেন্দু বুঝতে পেরেছেন, তৃণমূলকে হারাতে হিন্দু ভোটকে এক জায়গায় আনতে হবে। ছাব্বিশের নির্বাচনের আগে সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছেন তিনি। বাংলায় শুভেন্দু কি পারবেন হিন্দু ভোট একজোট করতে? উত্তর জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরও প্রায় বছর দেড়েক।