জঙ্গিরা যেন ‘গুপি-বাঘা’! ‘হাততালি’ মেরে ঢুকে যাচ্ছে বাংলায়, কীভাবে দেখুন
Passport: পাসপোর্ট পেতে গেলে অনলাইনে বা অফলাইনে আবেদন করতে হয়। দিতে হয় প্রয়োজনীয় নথি। সেগুলি খতিয়ে দেখার পর ব্যাকগ্রাউন্ড ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা করা হয়। স্থানীয় থানা থেকে বাড়িতে খোঁজ নিতে যায় পুলিশ। কিন্তু এ যেন ম্যাজিকের মতো সবটা হয়ে যাচ্ছে!
টাকা দিলে নাকি সবই মেলে। এটা তাহলে নিছকই প্রবাদবাক্য নয়! আক্ষরিক অর্থেই পাওয়া যায় ‘সব’। যে পরিচয়পত্র দেখিয়ে বিদেশ যাত্রা করতে পারেন, যেটা তৈরি করতে আমাকে-আপনাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, সেই পাসপোর্টও পাওয়া যায় হাতে হাতে। এমনকী অন্য দেশের নাগরিক হয়েও ভারতের পাসপোর্ট হাতে নিয়ে দিব্যি ঘুরে আসা যায় আমেরিকা কিংবা ইউরোপ। খোঁজ নিলে দেখা যাবে পাড়ার অলি-গলিতে রয়েছেন এমন অনেক মানুষ। জাল পাসপোর্টের ‘জাল’ ছড়িয়েছে অনেক দূর। আপনার পাশের বাড়ির বাসিন্দার হাতে একটা ভারতীয় পাসপোর্ট আছে বলে, তাঁকে ভারতীয় ভেবে ভুলও করতে পারেন।
গভীর উদ্বেগে লালবাজার, কলকাতাতেও ছড়িয়েছে জাল?
জাল নথি দিয়ে পাসপোর্ট তৈরির একের পর এক ঘটনা সামনে আসছে। আর এই নিয়ে উদ্বিগ্ন লালবাজার। ভুয়ো নথি নিয়ে পাসপোর্ট তৈরি রুখতে তৎপর কলকাতা পুলিশ। লালবাজারেরর তরফে বিশেষ নির্দেশিকাও জারি করা হয়েছে।
ইতিমধ্যেই ওই নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছে শহরের প্রত্যেকটি থানায়। নতুন করে পাসপোর্ট তৈরির আবেদন জমা পড়লে, আবেদনকারীকে থানায় ডেকে নথি যাচাই করলেই চলবে না, দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদের সশরীরে আবেদনকারীর ঠিকানায় পৌঁছে সবকিছু যাচাই করতে হবে। এলাকায় খোঁজ খবর নিতে হবে। বর্তমান বাংলাদেশের অশান্ত পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে অনুপ্রবেশ আটকাতেই পুলিশের এই তৎপরতা বলে মনে করা হচ্ছে।
শ’য়ে শ’য়ে বাংলাদেশি পেয়েছেন পাসপোর্ট
ইতিমধ্যেই ভুয়ো পাসপোর্ট তৈরির চক্রের এক মাথা সহ কয়েকজনকে গ্রেফতার হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। সেই তদন্ত চালাচ্ছে কলকাতা পুলিশের সিকিউরিটি কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন। সূত্রের দাবি, টাকার বিনিময়ে এখনও পর্যন্ত জাল নথি ব্যবহার করে ২৫০টির বেশি ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করে বাংলাদেশি নাগরিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, পাসপোর্ট নিয়ে সেই সব বাংলাদেশিরা যায় কোথায়? জাল নথি দিয়ে পার্সপোর্ট তৈরি নেপথ্যে আর কারা?
কেন ভারতে এসেই পাসপোর্ট বানাতে হচ্ছে বাংলাদেশিদের?
আদতে পাশ্চাত্য়ের দেশগুলিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় সমস্যায় পড়তে হয় বাংলাদেশিদের। পড়াশোনা, চিকিৎসা বা অন্য যে কোনও কাজে বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় সমস্যায় পড়তে হয় তাঁদের। কিন্তু ভারতীয়দের যেতে তেমন কোনও সমস্যা নেই। তাই ভারতে ভায়া হয়ে যাওয়াটাই সহজ বলে মনে করেন ওই দেশের মানুষজন।
এই কারণেই ইউরোপীয় দেশগুলিতে যেতে হলে বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রথম পছন্দ ভারত। সূত্রের খবর, শেষ ৫ বছরে জাল নথি দিয়ে প্রায় ৩ হাজার ভারতীয় পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ভারতে এসে মোটা টাকার বিনিময়ে ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন তাঁরা, এমনটাই খবর গোয়েন্দা সূত্রে। সেই পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশে পাড়ি দেয় বাংলাদেশি নাগরিকরা। এই পাসপোর্ট চক্রের তদন্তে নজরে মূলত রাজ্যের তিনটি জেলা। সূত্রের খবর, দুই ২৪ পরগনা ও নদিয়ায় এই চক্রের রমরমা। তদন্তকারীদের নজরে এই জেলাগুলির ডাক বিভাগ, পাসপোর্ট সেবা কেন্দ্র এবং DIB অফিস।
পাসপোর্ট পাওয়ার ধাপগুলি কী কী?
পাসপোর্ট পেতে গেলে অনলাইনে বা অফলাইনে আবেদন করতে হয়। দিতে হয় প্রয়োজনীয় নথি। সেগুলি খতিয়ে দেখার পর ব্যাকগ্রাউন্ড ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা করা হয়। স্থানীয় থানা থেকে বাড়িতে খোঁজ নিতে যায় পুলিশ। কতদিন সেখানে আছেন, সেই সব তথ্য যাচাই করা হয়। এই ধাপগুলি পার করতে পারলে মেলে পাসপোর্ট।
ভিনদেশের নাগরিক ভারতে এসে কীভাবে পাসপোর্ট বানাতে পারেন?
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যাচ্ছে, অবৈধ হলেও সবটাই বৈধ হিসেবে প্রমাণ দিচ্ছেন আবেদনকারীরা। কীভাবে সম্ভব সেটা? কোনও বৈধ নথি ছাড়া প্রথমে ভারতে আসছেন বাংলাদেশিরা। এরপর তাঁদের দিয়ে প্রথমে স্থানীয় থানায় জেনারেল ডায়েরি করানো হচ্ছে। থানায় তাঁরা জানাচ্ছেন, তাঁদের রেশন কার্ড হারিয়ে গিয়েছে। জনপ্রতিনিধির শংসাপত্র ও সুপারিশ নিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।
এই চক্রে যুক্ত দালালরা মৃত ব্যক্তির রেশন কার্ড নম্বর (বা ব্যবহার না হওয়া রেশন কার্ডের নম্বর) আগাম জোগাড় করে রাখছে। তার মধ্যে থেকে নিষ্ক্রিয় যে কোনও একটি রেশন কার্ডের নম্বর দিয়ে নাম বদলে জিডি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে থানা কোনও কিছু যাচাই না করে জেনারেল ডায়েরি জমা নিচ্ছে। থানায় করা জিডি দেখিয়ে নতুন রেশন কার্ডের আবেদন করা হচ্ছে। কিছু যাচাই না করেই নতুন নামে নিষ্ক্রিয় রেশন কার্ডের নম্বরে নতুন কার্ড ইস্যু হয়ে যাচ্ছে।
হাতে নতুন কার্ড পেয়ে গেলেই কেল্লাফতে! দ্বিতীয় পর্যায়ে রেশন কার্ড পাওয়ার কিছুদিন পর তা দেখিয়ে ভোটার কার্ডের আবেদন করা হচ্ছে। ভোটার কার্ড হয়ে গেলেই কিছুদিন পর তৃতীয় পদক্ষেপ হিসেবে আধার কার্ডের আবেদন করা হচ্ছে। ভোটার ও আধার কার্ড তৈরি হয়ে গেলেই পাসপোর্ট তৈরির জন্য আবেদন করছে বাংলাদেশিরা। সেখানেও ভালভাবে যাচাই হচ্ছে না। এভাবেই তারা এদেশের নাগরিক না হয়েও সরকারি সব নথিতে ভারতীয় হয়ে উঠছে।
ঠিক কোন কোন তলায় ছড়িয়েছে জালিয়াতির শিকড়?
রেশন কার্ড থেকে পাসপোর্ট, সবকটি ধাপই বেনিয়মে পার করতে হচ্ছে। সেটা সহজেই অনুমানযোগ্য। গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি, ভারতের জনপ্রতিনিধি-আধিকারিকরাই রয়েছেন এর নেপথ্যে। কাজ করছে একটা বড় সিন্ডিকেট। সেই সিন্ডিকেটে পঞ্চায়েত বা পুরসভার জনপ্রতিনিধি, খাদ্য দফতরের নীচু স্তরের আধিকারিকরা রয়েছেন বলেই অনুমান। পুলিশের একাংশের যোগ রয়েছে বলেও অভিযোগ।
এই তো কয়েকদিন আগেই মাল পুরসভার এক কর্মী উধাও হয়ে গিয়েছেন। আসলে তিনি পুরসভার যে বিভাগে ছিলেন, সেখান থেকেই বের করতে হয় জন্ম শংসাপত্র (বার্থ সার্টিফিকেট) ও মৃত্যু শংসাপত্র (ডেথ সার্টিফিকেট)। আর ওই বিভাগ থেকেই ৬ আফগান ও তাঁদের একগুচ্ছি আত্মীয়ের বার্থ সার্টিফিকেট বের করা হয়েছে বলে অভিযোগ। সেই বার্থ সার্টিফিকেট অনুযায়ী ওই আফগানরা মাল পুর এলাকারই বাসিন্দা। অর্থাৎ খাদ্য দফতরের কর্মী, পুরসভার কর্মী থেকে শুরু করে পুলিশ, এমনকী পাসপোর্ট অফিসের কর্মীদের দিকেও আঙুল উঠতে শুরু করেছে। সত্য-অসত্য কি তাঁরা সত্যিই বুঝতে পারেন না?
বাংলাদেশিদের জন্য কতটা বিপদ হতে পারে ভারতের?
ভিতরে-বাইরে সর্বত্র ঝুঁকি বাড়ছে। ধরা যাক, আপনার পাড়ায়, আপনার ঠিক পাশের বাড়িতে যিনি থাকেন, তিনি ভারতীয় কি না আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন না। যদি তিনি সত্যিই ভুয়ো পরিচয়পত্র নিয়ে বসবাস করেন, তাহলে তাঁর উদ্দেশ্য কী, সেটাও বোঝা মুস্কিল। তিনি যদি কোনও অপরাধ ঘটিয়ে ফেলেন, তাহলে তাঁর আসল ঠিকানায় পৌঁছনো যায়, কার সাধ্যি! এ তো গেল ঘরের বিপদ।
ওই ব্যক্তিই যদি কৌশলে ভারতের পাসপোর্ট হাতিয়ে বিদেশের মাটিতে যান, তাহলে তো আন্তর্জাতিক সুরক্ষার প্রশ্ন উঠে যেতে পারে। সেই ব্যক্তি যদি দেশের বাইরে গিয়ে কোনও অপরাধ করেন, তাহলে ঠিকানা হিসেবে ভারতের নামই উঠে আসবে। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে পর্যন্ত প্রভাব পড়তে পারে।