EXPLAINED: খারিজিতে কি সত্যি জঙ্গি ‘চাষ’ হয়? জানুন বাংলার মাদ্রাসার মানচিত্র
Khariji Madrasa: হরিহরপাড়া থেকে আব্বাস আলি গ্রেফতার হওয়ার পর খারিজি মাদ্রাসা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। খারিজি মাদ্রাসাগুলির সরকারি অনুমোদন নেই। সরকারি অনুদানও নেই। অনুমোদন পেতে কী অনাগ্রহী খারিজি মাদ্রাসাগুলি? পড়ুন টিভি৯ বাংলার বিশেষ প্রতিবেদন।
প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক চাপানউতোর বেড়েছে। যুক্তি-পাল্টা যুক্তি। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ। জঙ্গি কার্যকলাপে যুক্ত থাকার অভিযোগে মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া থেকে আব্বাস আলি গ্রেফতার হওয়ার পর খারিজি মাদ্রাসা (খারিজির অর্থ বাহির। খারিজি মাদ্রাসাগুলির সরকারি অনুমোদন নেই। সরকার অনুদানও দেয় না।) ঘিরে নানা প্রশ্ন। মাদ্রাসা নিয়ে বাংলাদেশের লেখিকা তসলিমা নাসরিনের মন্তব্যে বিতর্ক বেড়েছে। জবাব দিয়েছেন এ রাজ্যের তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীর। তবে তাঁরও বক্তব্য, খারিজি মাদ্রাসাগুলিতে নিয়োগের আগে খোঁজখবর নেওয়া দরকার। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, মাদ্রাসাগুলিতে কীভাবে পড়াশোনা হয়? খারিজি মাদ্রাসাগুলিতে কী পড়ানো হয়? খারিজি মাদ্রাসাগুলি সরকারি অনুমোদনের জন্য আবেদনে কি অনাগ্রহী?
খারিজি মাদ্রাসা চালাতেন মুর্শিদাবাদ থেকে ধৃত আব্বাস আলি-
গত ১৮ ডিসেম্বর মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া থেকে আব্বাস আলিকে গ্রেফতার করে অসম পুলিশ। মিনারুল শেখ নামে আরও একজনকে গ্রেফতার করা হয়। বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লা বাংলা টিমের সঙ্গে তাঁদের যোগ রয়েছে। আব্বাস আলিকে গ্রেফতারের পরই খারিজি মাদ্রাসা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে।
এই খবরটিও পড়ুন
জানা যায়, হরিহরপাড়ায় আব্বাসের নিজের একটি খারিজি মাদ্রাসা রয়েছে। ২০২৪ সালের শুরুতে বাড়িভাড়া নিয়ে মাদ্রাসাটি খুলেছিলেন তিনি। জনাকুড়ি ছাত্র নিয়ে শুরু করেন মাদ্রাসা। সরকারি অনুমোদন যেমন ছিল না। মাদ্রাসার বোর্ডও ছিল না সেখানে।
এর আগে ২০২৩ সালে একটি বেসরকারি মাদ্রাসাতেও কয়েকমাস পড়িয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, ঠিকমতো পড়াতে না পারায় পড়ুয়ারা অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তারপরই সেই মাদ্রাসা ছেড়ে নিজের বাড়ির সামনেই একটি মাদ্রাসা খুলে বসেন আব্বাস। প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, মাদ্রাসা চালানোর অর্থ কোথা থেকে পেতেন আব্বাস? খারিজি মাদ্রাসার আড়ালে জঙ্গি কার্যকলাপ চালানো কি সহজ?
মাদ্রাসা নিয়ে কী বলছে মাদ্রাসা শিক্ষা দফতর-
কত ধরনের মাদ্রাসা রয়েছে বাংলায়? ব্যাখ্যা করলেন মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের এক আধিকারিক। তিনি বলেন, “রাজ্যে পুরোপুরি সরকারি পরিচালিত মাদ্রাসার সংখ্যা ১৪। এর মধ্যে ১২টিতে পুরোদমে পড়াশোনা হয়। প্রত্যেকটি স্কুলেই ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো হয়। আর হাওড়ায় এমন একটি স্কুল ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে চালু হচ্ছে। দক্ষিণ দিনাজপুরেও এমন একটি স্কুল তৈরি করা হচ্ছে।” তিনি জানান, মাধ্যমিক বোর্ডে যা সিলেবাস, এখানেও সেই একই সিলেবাস। এর সঙ্গে আরবি ভাষা অতিরিক্ত রয়েছে।
এর পাশাপাশি রয়েছে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত মাদ্রাসা। এই ধরনের মাদ্রাসাগুলি সরকারি সাহায্য পায়। কিন্তু, চালায় ম্যানেজিং কমিটি। শিক্ষকদের বেতন-সহ সবকিছু সরকার দেয়। মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের ওই আধিকারিক জানান, এরকম মাদ্রাসার সংখ্যা ৬১৪।
এছাড়াও এমএসকে ও এসএসকে রয়েছে। এগুলো ক্লাস এইট পর্যন্ত। মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের অধীনে এমন স্কুল ৪৯৭টি রয়েছে। এখানে সরকার সাহায্য করে। তবে শিক্ষকদের বেতন অনেকটাই কম বলে তিনি জানান।
মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের ওই আধিকারিক জানান, সরকারি সাহায্য ছাড়াও অনেক মাদ্রাসা চলে। এগুলিকে শুধুমাত্র সরকার অনুমোদন দেয়। কিন্তু, কোনও আর্থিক সাহায্য করে না। কোনও সোসাইটি মাদ্রাসা তৈরি করে তার খরচ বহন করে। ২৩৫টি এমন মাদ্রাসা এই মুহূর্তে রয়েছে। এই ধরনের মাদ্রাসাগুলিতে বোর্ডের নিয়ম মেনেই পড়ানো হয়। সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত মাদ্রাসাগুলিতে অমুসলিম পড়ুয়া ও অমুসলিম শিক্ষক রয়েছে বলেও তিনি জানান।
খারিজি মাদ্রাসা কী?
সরকার পরিচালিত, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত এবং সরকার অনুমোদিত মাদ্রাসা ছাড়াও বাংলায় অনুমোদনহীন বহু মাদ্রাসা রয়েছে। সেগুলিই খারিজি মাদ্রাসা। কোনও এলাকায় কোনও কমিউনিটি এই ধরনের মাদ্রাসা খোলে। আব্বাসের মতো অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও এই মাদ্রাসাগুলি খোলেন।
বাংলায় খারিজি মাদ্রাসার সংখ্যা কত?
পশ্চিমবঙ্গে খারিজি মাদ্রাসার সংখ্যা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও তথ্য জানাতে পারল না মাদ্রাসা শিক্ষা দফতর। ওই আধিকারিকের বক্তব্য, রাজ্যে ৪-৫ হাজার খারিজি মাদ্রাসা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু, ভরতপুরের বিধায়ক হুমায়ুন কবীর বলছেন, বাম আমলেই রাজ্যে ১০ হাজার খারিজি মাদ্রাসা ছিল। সেই সংখ্যা আরও বেড়েছে। বছর দেড়েক আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, রাজ্যের খারিজি মাদ্রাসা কতগুলি রয়েছে, তা সমীক্ষা করে দেখা হবে। কিন্তু, সেই সমীক্ষা যে এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, তা স্পষ্ট।
কী পড়ানো হয় খারিজি মাদ্রাসাগুলিতে?
সরকার পরিচালিত, সরকার সাহায্যপ্রাপ্ত এবং সরকার অনুমোদিত মাদ্রাসাগুলিতে মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের বই পড়ানো হয়। কিন্তু, খারিজি মাদ্রাসাগুলি সেই নিয়মের মধ্যে পড়ে না। মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের ওই আধিকারিক জানান, খারিজি মাদ্রাসার সঙ্গে সরকারের কোনও সম্পর্ক নেই। সেখানে মূলত ধর্মীয় পড়াশোনা হয়। খারিজি মাদ্রাসাগুলিতে যে পড়ুয়ারা পড়াশোনা করে, তারা সরকারি শংসাপত্র পায় না। তাদের ডিগ্রি স্বীকৃত নয়।
সরকারি অনুমোদন পেতে কি অনাগ্রহী খারিজি মাদ্রাসাগুলি?
খারিজি মাদ্রাসাগুলিকে সরকারি খাতায় নথিভুক্তের জন্য বছর ১২ আগে আহ্বান জানিয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিক্ষা দফতরের ওই আধিকারিক বলেন, “২০১২ সালে খারিজি মাদ্রাসাগুলিকে নথিভুক্তকরণের আহ্বান জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকার তাদের অনুমোদন দেওয়ার কথা জানিয়েছিল। তবে কোনও সরকারি অনুদান দেওয়া হবে না বলে জানানো হয়। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩-১৪ সালে ২৩৫টি খারিজি মাদ্রাসা অনুমোদন পায়।” আরও ৬৮০টি খারিজি মাদ্রাসাকে অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলছে বলে তিনি জানান।
তাহলেও আরও কয়েক হাজার খারিজি মাদ্রাসা রয়ে যাচ্ছে। তারা কেন সরকারি অনুমোদন পেতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না? মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের ওই আধিকারিক জানিয়েছেন, সরকারি অনুমোদন পেলে সেইসব মাদ্রাসাগুলিতে মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের নিয়মাবলী মেনে চলতে হবে। সেখানে মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের নির্ধারিত বই পড়াতে হবে। প্রশ্ন উঠছে, এটাই কি অনুমোদন পেতে অনাগ্রহের কারণ? অনেকে আবার বলছেন, সরকার অনুমোদন দিলেও কোনও সরকারি অনুদান পাওয়া যাবে না। সেটাও অনাগ্রহের কারণ হতে পারে। তারপরও প্রশ্ন উঠছে, যেখানে পড়াশোনা করলে সরকারি শংসাপত্র পাওয়া যায় না, তারপরও কেন অনুমোদনে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বেশিরভাগ খারিজি মাদ্রাসা?
খারিজি মাদ্রাসা নিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মন্তব্যে বিতর্ক-
মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এক মন্তব্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। বামপন্থীদের পত্রপত্রিকাতে উল্লেখ করা হয়েছিল, অনুমোদনহীন মাদ্রাসাগুলিকে দেশবিরোধী কার্যকলাপের আঁতুড়ঘর বলে মন্তব্য করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। যা নিয়ে তীব্র বিতর্ক হয়েছিল। পরে নিজের বক্তব্য নিয়ে পিছু হটেন তিনি।
তসলিমা নাসরিনের মন্তব্যের বিরোধিতা হুমায়ুন কবীরের-
বাংলাদেশের বর্তমান অশান্ত পরিস্থিতির জন্য চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন লেখিকা তসলিমা নাসরিন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে মাদ্রাসা নিয়ে তিনি বলেন, “মাদ্রাসাগুলিতে জঙ্গি মহড়া হচ্ছে।” তাঁর এই মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেন তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীর। বলেন, “তসলিমা নাসরিনের কথার কোনও গুরুত্ব নেই। উনি শিক্ষিত শয়তান। তাঁর বই পড়ে দেখেছি। অনেক বাজে কথা লেখেন।”
মাদ্রাসায় ‘জঙ্গি’ হয় না-
মাদ্রাসার কার্যকলাপ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই নিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের ওই আধিকারিক বলেন, “অপরাধ সব জায়গায় হয়। কিন্তু, কোনও একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির অপরাধের জন্য প্রতিষ্ঠানকে দাগিয়ে দেওয়া যায় না। সরকার অনুমোদিত, সাহায্যপ্রাপ্ত মাদ্রাসাগুলি থেকে অনেক পড়ুয়া পড়াশোনা করে বড় বড় প্রতিষ্ঠানে জায়গা করে নিয়েছেন।” ভরতপুরের তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীরেরও বক্তব্য, “মাদ্রাসায় জঙ্গি হয় না। চালে যেমন কাঁকর থাকে, তেমনই কেউ হয়তো অসৎ উদ্দেশ্য ঢুকে পড়তে পারে। এক কোটির মধ্যে হয়তো একজন। তাদের জন্য আইন আছে।”