Loan: লোন নিয়ে বেসামাল! পাওনাদারের চাপ সামলাবেন কীভাবে? সমাধানের উপায় বাতলে দিলেন বিশেষজ্ঞরা
Loan: পরিজনদের দাবি তো তেমনই। বীরভূমের লাভপুরের বাবনা গ্রামের বাসিন্দা লক্ষ্মণ মুখোপাধ্যায়। নির্দিষ্ট কিছু কাজ ছিল না তাঁর। দিন কয়েক হল, লাভপুরে একটি মিষ্টির দোকানে কাজ শুরু করেছিলেন। সবসময় তাঁর টানাটানির সংসার। এরই মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন।

কলকাতা: ট্যাংরার দে পরিবার- গত এক মাসে গোটা বাংলার মানুষকে যা ভাবাতে বাধ্য করেছিল, তারপর থেকে পর্ণশ্রী, হালতু কিংবা কলকাতা লাগোয়া মধ্যমগ্রামের ঘটনা। ধরন অনুযায়ী তিন রকমের আত্মহত্যা। মাস খানেক ধরে এই ঘটনাপ্রবাহ বাড়িয়েছে উদ্বেগ। চিকিৎসক পরিভাষায় এই ধরনের ঘটনাকে বলা হয় ‘অ্যানোমিক সুইসাইড’!
এই শব্দবন্ধ প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ফরাসি সমাজকর্মী এমলি ডুরখেইম। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ‘সুইসাইড প্যাটার্ন’ খতিয়ে দেখে ইনস্টিটিউট অব বিহেভিয়ারাল সায়েন্সের মনোবিদরা তেমনই মনে করছেন। এই ধরনের প্রবণতায় মানুষের আত্মবিশ্বাস, সামাজিক মূল্যবোধ একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। তখন মানুষ নিজের সন্তানকেও শেষ করে দিতে পারেন, একবারও হাত কাঁপে না!
কিন্তু শহরের বুকে ঘটে যাওয়া পরপর আত্মহত্যার ঘটনায় একটা বিষয় কমন। বাজারে মোটা টাকার ঋণ! চারদিকে শিউরে-ওঠার মতো মৃত্যুর ঘটনা, যার একটা বড় অংশ জুড়ে সুইসাইড। খাস কলকাতার ট্যাংরা, বেহালার পর্ণশ্রী হোক বা হালতু, কিংবা কলকাতা লাগোয়া মধ্যমগ্রাম। কোথাও বাড়ির দুই সদস্যকে খুন করে, ছেলেকে গাড়িতে তুলে আত্মহত্যা করতে বেরিয়ে পড়েছেন দুই ভাই! কোথাও আবার অটিস্টিকে আক্রান্ত তরুণী মেয়ের সঙ্গে একই দড়িতে ঝুলে পড়েছেন অবসাদগ্রস্ত বাবা। কোথাও পাঁচ বছরের দুধের শিশুকে খুন করে নিজে বিষ খেয়েছেন মা। কোনও জায়গায়, সন্তানকে মেরে সুইসাইড করছেন মা, বাবা!
প্রশ্ন তাই উঠেছে। তবে কি ধারে ডুবেই মরণ ছক?
ট্যাংরার পরিবারটি কোটি কোটি টাকার দেনায় ডুবে ছিল! বেহালার চিমনি ব্যবসায়ী মেয়ের চিকিৎসার জন্য কোথায় কোথায় না ছুটেছিলেন। এর জন্য ঘটি-বাটি বিক্রির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
হালতুর সোমনাথ রায়! তিনি তো সন্তানের চিকিৎসার খরচ সামলাতে পারছিলেন না। ধার করতে করতে সব রাস্তাই বন্ধ হয়ে যায়! অনেকেই বলছেন, মানুষ কতটা অসহায় হলে এভাবে ধার-দেনার দিকে ঝোঁকেন। সোমনাথের ঘাড়ে ছিল লাখ লাখ টাকার দেনা! যখন তখন তাঁর বাড়িতে দলবল নিয়ে তাগাদার খোঁজে যেতেন পাওনাদাররা। এই পাওনদার কারা? মানে যাঁরা চাপ দেন? এঁরা হলেন লোন রিকভারি এজেন্ট।
পরিজনদের দাবি তো তেমনই। বীরভূমের লাভপুরের বাবনা গ্রামের বাসিন্দা লক্ষ্মণ মুখোপাধ্যায়। নির্দিষ্ট কিছু কাজ ছিল না তাঁর। দিন কয়েক হল, লাভপুরে একটি মিষ্টির দোকানে কাজ শুরু করেছিলেন। সবসময় তাঁর টানাটানির সংসার। এরই মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। পরিবার সূত্রে জানা গেছে, এসবের জন্য বাজারে ধারও হয়ে যায় প্রচুর। সেই দেনা মেটাতে ৫টি বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন লক্ষ্মণ। যার পরিমাণ ছিল তিন থেকে চার লক্ষ টাকা। অভিযোগ টাকা চেয়ে রিকভারি এজেন্টরা বুধবার তাঁর বাড়িতে শাসাতে থাকেন। বাড়িতে তালা মেরে দেওয়ার হুমকি দেন। এরপরই স্ত্রীকে নিয়ে নদীর পাড়ে চলে যান লক্ষ্মণ। কীটনাশক ট্যাবলেট খেয়ে আত্মঘাতী হন স্বামী-স্ত্রী।
মৃতের পরিজন ও প্রতিবেশীদের দাবি, নিয়মিত পাওনাদারদের চক্করে পড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন দম্পতি। এমনকি যেখানে কাজ করতেন লক্ষ্মণ সেখানেও তাঁকে রীতিমতো শাসানো হয়!
ঘাড়ের উপর লাখ লাখ টাকা লোনের চাপ। উঠতে বসতে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ। আর তা সইতে না পেরে শেষ হয়ে গেল একটা পরিবার! জীবন যেন জুয়ার মতো!
এখন এমনও একজনকে দেখা যাবে না, যাঁর ঘাড়ে লোনের বোঝা নেই। সরকারি-বেসরকারি ব্যাঙ্ক থেকে সরাসরি লোন না মিললেও, এখন বাজারে এরকম বহু এজেন্ট ঘুরে বেড়াচ্ছেন, যাঁরা খুব সহজেই আপনাকে লোন পাইয়ে দেবে। কিন্তু সেই লোনই একসময়ে কাল হয়ে দাঁড়াবে! বাড়তে বাড়তে ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়ালে, মানুষ আত্মহত্যার মতো পথও বেছে নিতে পারেন?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, “আপনি কর্মক্ষেত্রে থাকুন কিংবা বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে, লোন রিকভারি এজেন্টরা বারবার আপনাকে ফোন করছে, দরজায় কড়া নাড়াচ্ছে, আপনার মানসিক উচাটন তৈরি হচ্ছে তাতে। ফিনান্সিয়াল রিকভারি এজেন্টরা আসলে প্রেশার ট্যাকটিকস ফলো করেন। যে মানুষটা দেনার দায়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁর ওপর ভীষণভাবে চাপ সৃষ্টি হয়।”
কীভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয়?
এক লোন রিকভারি এজেন্ট বললেন, “পার্সোনাল লোনের ক্ষেত্রে কাস্টমারের ওপর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ১৩৮ জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা হয়। চেক বাউন্স হলে ক্রিমিন্যাল অফেন্স হয়। লোন রিকল নোটিস পাঠানো হয়। ”
ধরা যাক আপনি ব্যাঙ্ক থেকে পার্সোনাল লোন নিয়ে, নানা কারণে শোধ করতে পারছেন না। আর তাগাদা দিতে আসছেন কারা? লোন রিকভারি এজেন্ট। তাঁরা কিন্তু সরাসরি ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত নন। সাধারণত থার্ড পার্টি, মানে অন্য কোনও সংস্থার মাধ্যমে তাঁদের নিয়োগ। তাঁরাই এসে চোটপাট করে বলে অভিযোগ। তাঁদের এক্তিয়ার কত দূর?
প্রাক্তন পুলিশ কর্তা সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “কোনও রিকভারি এজেন্ট এমনভাবে কোনও প্রেশার ক্রিয়েট করতে পারে না, যেটা ক্রিমিন্যাল ফোর্স ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ এটার মানে শুধু মারধর নয়, কেউ থ্রেট দিতে পারবেন না, কিংবা টানা চাপ দেওয়ার মতো নির্দিষ্ট কোনও নিয়ম নেই। কোনও রিকভারি এজেন্ট এই ধরনের চাপ দিতে পারেন না। তাই এরকম করলে দ্রুত থানায় জানান বিষয়টি।”
কয়েক বছর আগে, লোন আদায়ে জুলুমের অভিযোগ নিয়ে আদালত স্পষ্ট করে দিয়েছিল, কোনওভাবেই অমানবিক মানসিক চাপ দেওয়া যাবে না। কিন্তু তারপরও সেটা হচ্ছে না বলে অভিযোগ। বিভিন্ন ব্যাঙ্ক বা আর্থিক সংস্থার নিজেরা একাজ না করে অন্য সংস্থার থেকে লোক নিয়ে লোন রিকভারের চেষ্টা করে। আর সেখান থেকে ঋণ গ্রহীতার ওপর এমন মানসিক চাপ তৈরি করা হয়, যে তিনি চরম পথ বেছে নিতে বাধ্য হন।
এটা আটকানোর পথ কী? এই নিয়ে আমরা কথা বলেছিলাম প্রাক্তন পুলিশকর্তাদের সঙ্গে। কী তাঁদের পরামর্শ?
যাঁরা বাজার বিশেষজ্ঞ, চাহিদা-জোগান, লাভ-ক্ষতির হিসেব করেন তাঁরাও বারবার বলছেন, পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে এবং সেই মানিয়ে নেওয়া বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। এখন যা অনিশ্চয়তার বাজার, তাতে কখন যে বিপদে মানুষ পড়তে পারে, তা বলা শক্ত। অতএব সবটাই বুঝে-সুঝে। বিশিষ্ট মনোবিদরা বলছেন, যদি আয়ের রাস্তা সংকীর্ণ হতে শুরু করে, কিন্তু লাইফস্টাইল মেইনটেইন করতেই হবে, সেটা করলেই সমস্যা। অর্থাৎ রাশ টানতে হবে নিজেকেই।





