Roman & Parthian Food Recipe Part II: খানা খানদানি-পর্ব ০৪, পার্থিয়া থেকে রোমান দুনিয়া ঘুরে কোন মশলা ঝাঁঝ ছড়িয়েছিল কলকাতাতেও?

Roman & Parthian Food Recipe––ফেরুলা বংশের বিভিন্ন প্রজাতির গুল্মের জীবন্ত শিকড় কাটলে যে আঠা বেরোয়, তা শুকিয়ে নিলেই হয়ে যায় হিং। নানা রোগের খুব ভাল ওষুধ। আর রান্নার মশলা। পার্থিয়া সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি যুদ্ধের ভয়াবহ হুঙ্কার আর রক্তপাত স্তিমিত হওয়ার পর রোমান দুনিয়ায় পৌঁছতেই রোমান আপিকিয়ুসেরা বা তাঁদের মেজাজ শান্ত রাখার দায়িত্বে থাকা মহাপাচকেরা লুফে নিয়েছিলেন এই কটুগন্ধের মশলা।

Roman & Parthian Food Recipe Part II: খানা খানদানি-পর্ব ০৪, পার্থিয়া থেকে রোমান দুনিয়া ঘুরে কোন মশলা ঝাঁঝ ছড়িয়েছিল কলকাতাতেও?
আপিকিয়ুসের এই বিশেষ খানার সঙ্গে যে পারস্যের বিরাট অঞ্চল জুড়ে গড়ে ওঠা পার্থিয়া সাম্রাজ্যের যাকে বলে মশালেদার যোগাযোগ রয়েছে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Oct 04, 2021 | 1:01 PM

নীলাঞ্জন হাজরা: পর্ব ৪

রোমান সম্রাট ট্রেজান স্বয়ং চলেছেন পার্থিয়া। আজকের সিরিয়া অঞ্চল থেকে রণপোতের ব্যূহ নিয়ে ইউফ্রেটিস নদী বেয়ে। তারপর হনহনিয়ে বিপুল বাহিনী নিয়ে টাইগ্রিস উপত্যকা হয়ে আজকের বাগদাদ পার করে সোজা টেসিফোন—ইরান বা পারস্য, বা রোমানদের লব্জে আরিয়ানা, বা পার্থিয়া সাম্রাজ্যের রাজধানী, বাগদাদ থেকে খান তিরিশ মাইল দূরের শহর।

গ্রীক মহাবাগ্মী আথেনিউস লিখে গিয়েছেন, যুদ্ধের অভিজানের এই ভীষণ দিনকালে সম্রাটের আহারের জন্য সুদূর রোম থেকে আপিকিয়ুস পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাজা ঝিনুক। সে ঝিনুক তাজা রাখা হয়েছিল আপিকিয়ুসের নিজস্ব পদ্ধতিতে! মজার কথা হল, এ আপিকিয়ুস কিছুতেই আমরা এই সিরিজেরই প্রথম লেখায় যে মার্কুস গাভিয়ুস আপিকিয়ুসের কথা শুনেছিলাম তিনি হতেই পারেন না। কারণ এর আগে আথেনিয়ুস নিজেই জানিয়েছিলেন মার্কুস আপিকিউসের সময়কাল সম্রাট টাইবেরিয়ুস-এর রাজত্বকালে। সেটা ১৪ থেকে ৩৭ সাধারণাব্দ। আর সম্রাট ট্রেজানের জীবৎকাল ৫৩ থেকে ১১৭ সাধারণাব্দ। আসলে আপিকিয়ুস ছিল ‘মহাভোজনরসিক’ উপাধি। রোম সাম্রাজ্যে এমন তিন আপিকিয়ুসের সন্ধান মেলে। আর তাই থেকেই রোমান খানদানি খানার এই দুরন্ত কেতাব আপিকিয়ুস।

আপিকিয়ুসের এই বিশেষ খানার সঙ্গে যে পারস্যের বিরাট অঞ্চল জুড়ে গড়ে ওঠা পার্থিয়া সাম্রাজ্যের যাকে বলে মশালেদার যোগাযোগ রয়েছে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আর সেই মশলাটির নাম হিং! পার্থিয়ার সিংহভাগ জুড়ে থাকা অঞ্চল আজকের ইরান। সেই ইরান থেকে মেসোপটেমিয়া তারপর ভূমধ্যসাগর টপকে পৌছে যেত রোম।

আজ আর বড় একটা দেখা যায় না। কিন্তু রবি ঠাকুরের সেই হৃদয়-মোচড়ানো ‘কাবুলিয়ালা’ গল্পের দিনকাল থেকে এমনকী আমাদের ছোটবেলাতে হাজার বছরের পুরনো শহর আমার নিজভূম বিষ্ণুপুরে দরজায়-দরজায় হাজির হয়ে যেতেন হাঁটু অবধি ঝুলের ঢলঢলে ধূসর ‘পেরাহন’ আর ‘তুনবান’ ঝোলা পায়জামা, মাথায় ‘লুঙ্গি’ পাগড়ি, হ্যাঁ কাবুলিদের পরম্পরাগত পোশাকের অঙ্গ এই পাগড়িকে ‘লুঙ্গি’-ই বলে, আর পিঠে বিশাল ঝোলা নিয়ে। সেই ঝোলায় থাকত হরেক কিসিমের সুখা ফল, পেস্তা-বাদাম, কিশমিশ। আর থাকত হিং।

কী এই হিং? ফেরুলা বংশের বিভিন্ন প্রজাতির গুল্মের জীবন্ত শিকড় কাটলে যে আঠা বেরোয়, তা শুকিয়ে নিলেই হয়ে যায় হিং। নানা রোগের খুব ভাল ওষুধ। আর রান্নার মশলা। এ মশলার জাদু এই যে, এমনিতে এর তীব্র দুর্গন্ধ, রান্নায় দিলেই এক আশ্চর্য প্রশান্ত, খানিকটা পেঁয়াজের মতো কিন্তু অনেক হাল্কা, গন্ধে বদলে যায়। পার্থিয়া সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি যুদ্ধের ভয়াবহ হুঙ্কার আর রক্তপাত স্তিমিত হওয়ার পর রোমান দুনিয়ায় পৌঁছতেই রোমান আপিকিয়ুসেরা বা তাঁদের মেজাজ শান্ত রাখার দায়িত্বে থাকা মহাপাচকেরা লুফে নিয়েছিলেন এই কটুগন্ধের মশলা। ডাকসাইটে ব্যাঙ্কোয়েটের পাতে পড়ছিল নানা পারসিক গন্ধময় খানা। ঠিক যেমন আমরা বাঙালিরা তৈরি করে ফেলেছিলাম এক সুবাসিত কচুরি, যা এই সে দিন পর্যন্ত ‘হিংয়ের কচুরি’ বলে পরিচিত ছিল, কিন্তু আজ কলকাতা থেকে একেবারে গায়েব। আমরা আফগানি তালেবানদের ভয়ে কাঁপতে শিখে, তাঁদের জাত-মশলাটিকে প্রায় ত্যাগ করেছি।

মেসোপটেমিয়া যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি, কিন্তু পার্থিয়া সাম্রাজ্যের যে মূল এলাকা, আজকের ইরানের বিরাট অঞ্চল জুড়ে তাতে বেশ টৈটৈ করে বেড়িয়েছি—নিশাবুরের জাফরানি ক্ষেত থেকে মাতাল আলেকজান্ডারের পুড়িয়ে ফেলা আশ্চর্য শহর পারসেপোলিস পর্যন্ত। এ প্রসঙ্গ তুললাম এই কারণেই যে, আমার ইরান সফরের একটা লক্ষ্যই ছিল ডাকসাইটে হরেক পারসিক খানা যতদূর সম্ভব চেখে দেখা। তার মধ্যে যেমন ছিল আশ্চর্য নানা ‘পালাও’ (আমাদের পুলাও), তেমনই ছিল ইসফাহানের অনির্বচনীয় ‘বেরিয়ান’ আর নান, আবার ক্যাববও। আর সেই ক্যাববের মধ্যেই তেহরানের বিখ্যাত আমির-কবির হোটেলের রেস্তোরাঁয় চেখে দেখেছি মুর্ঘ ক্যাবব। উপাদেয়। কিন্তু জোর দিয়ে বলতে পারি যে মশলার জোরে আপিকিয়ুসের এ খানার গায়ে পারসিক বা ‘পারথিক’ তকমা, সেই হিং আজও পারসিক মহল-এ-খুরাকপাজ়ি-তে চুটিয়ে ব্যবহার হচ্ছে এমনটা কখনও মনে হয়নি। আর আমির-কবিরের সেই মুর্ঘ ক্যাবব যতই সুস্বাদু হোক, পুল্লুম পার্থিকুম, বা কুক্কুটী পারসিকের স্বাদের সঙ্গে তারও কোনও তুলনা চলে না।

তবে এটা বুঝতে আর কোনও ছোট্ট এ মুরগির পিঠে চড়ে থালায় হাজির নীচের মানচিত্রে দেখানো সুপ্রাচীন দু’-দু’টি মহাসাম্রাজ্য— রোম ও পার্থিয়া।

আধুনিক মানচিত্রে রোম ও পার্থিয়া সাম্রাজ্য যথাক্রমে বেগুনি ও সবুজ রেখায় চিহ্নিত

ছোটো একখানা মুরগির এই থালে শুধু ওই দুই মানচিত্রে দেখানো দুই মহাসাম্রাজ্যই হাজির নয়। রেসিপিটা খুঁটিয়ে পড়লেই দেখা যাবে হাজির আরও অনেক কাছের দূরের দেশ। তবে আরেকবার পড়ি মূল রেসিপি।

‘‘মুরগিটিকে উল্টিয়ে ডানা-মেলা ঈগল পাখির মতো করে রাখুন। গোলমরিচ, লাভেজ-পাতা ও একটু শাহি-জিরা থেঁতো করুন। ফিশ সস্‌ দিয়ে ভিজিয়ে নিন। ওয়াইনে গুলে নিন। একটা কুমান পাত্রে মুরগিটা রাখুন। রান্নাটা করতে করতেই কড়া হিং হাল্কা গরম জলে গুলে মুরগিটার ওপর ছড়িয়ে দিন। গোলমরিচ ছড়িয়ে পরিবেশন করুন।’’

— (আপিকিউস)

এবার এই রেসিপির যে শব্দটায় চড়ে রোম ও পার্থিয়া পার করে এক্কেবারে অন্য এক অঞ্চলে হাজির হব সেটি হল— ‘কুমান’। কুমান থালাটা আবার কী থালা? সেটা বুঝতে হলে পৌঁছতে হবে আরেক প্রাচীন নগরে—রোমা থেকে টাইরেনীয় সাগরের উপকূল বেয়ে দক্ষিণে ২৫০ কিলোমিটার পার করে পৌঁছে যেতে হবে কুমা শহরে। এই প্রাচীন কুমা শহর পূর্বসাধারণাব্দ অষ্টম শতক থেকে ৪২১ পূর্বসাধারণাব্দ পর্যন্ত ছিল ইতালির মূল ভূখণ্ডে দারুণ শক্তিশালী গ্রিক উপনিবেশের অঙ্গ। তাই এখানেই প্রথম গড়ে ওঠে বিখ্যাত গ্রিকো-রোমান সংস্কৃতি, খানাদানাও তার বাইরে ছিল না নিশ্চয়ই। তবে সে প্রসঙ্গে আমরা আসব অন্য এক গ্রিক খানা পাকাতে-পাকাতে।

দেখতে-দেখতে প্রথম সাধারণাব্দের মধ্যে কুমা হয়ে ওঠে রোমান কোটিপতিদের বিলাসকেন্দ্র। ডাকসাইটে রোমানদের ভিলায় ভরে ওঠে শহর। এবং এই সময়েই এ শহরে গড়ে ওঠে সেরামিক পাত্র তৈরির বড়-বড় কারখানা। সেখানে তৈরি হওয়া সেরামিকের পাত্রই যে কুমান পাত্র, তা নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই।

কেন এই পাত্রে রেখেই মুর্গি পোড়াতে হবে, তা আমার জানা নেই। হয়তো এ পাত্র পুড়ে কোনও বিশেষ গন্ধ বার হত। হয়তো এই পাত্র ব্যবহারই ছিল চল। তবে আমার ধারণা কোনও না কোনও কারণ না থাকলে বিশেষ ভাবে ‘কুমান পাত্র’ বলা থাকত না। রোমান বাদশাহি হেঁশেলে আনাড়িদের কোনও জায়গা থাকতে পারে না। কাজেই তাঁরা যখন কুমান থালা বলছেন, তার নির্ঘাত কোনও উদ্দেশ্য আছে এটা ধরে নেওয়া যেতেই পারে। আমার বরাবরই মনে হয়েছে প্রত্যেক সুখাদ্য এক-একটা দুরন্ত রাসায়নিক পরীক্ষার সাফল্যের উদ্‌যাপন। এই কৃতদাস মহাপাচকেরা সেই রন্ধন-রসায়ণে কী সাংঘাতিক দড় ছিলেন, তারও উদাহরণ এই কুক্কুটী পারসিক।

দেখবেন, রেসিপিতে যে ‘লাভেজ’ পাতার কথা বলা হয়েছে তা চট করে বাংলায় মিলবে না। চিন্তা নেই সেলেরি ব্যবহার করুন। দুটিই ‘এপিয়াসি’ পরিবারের গুল্ম। কিন্তু আমার চোখ, থুড়ি জিভ টেনেছে শাহি-জিরার ব্যবহার। ক্যারাওয়ে। বৈজ্ঞানিক নাম ‘কারুম কার্ভি’। ইনিও কিন্তু ইরানের আদিবাসিন্দা। এবং ‘এপিয়াসি’ প্রজাতির ফল (ভুল করে বীজ বলা হয়)। এবার হিং, লাভেজ (কিংবা সেলেরি) আর শাহি-জিরে এই তিন মশলার সম্পর্কটা লক্ষ্য করুন— এই তিনটিরই আদিউৎসস্থান পশ্চিম এশিয়া: ইরান-আফগানিস্তান!

আমরা খানাখানদানি-১এই দেখেছি গোলমরিচ হাজির হয়েছে সুদূর ভারত থেকে আর ফিশ সস্‌ আদি রোমান সৃষ্টি। ওয়াইনও রোমানই।

অ্যন্ড্রু ড্যালবি আর স্যালি গ্রেগিঙ্গার অনেক মাথা চুলকিয়ে ১৬০০ বছরের এই প্রাচীন রেসিপিটির আধুনিক রূপ দিয়েছেন এ রকম—

মুর্গির ঠ্যাং বা ব্রেস্ট— ৪ পিস গুঁড়ো গোলমরিচ রেড ওয়াইন — ১৭০ মি.লি. ফিশ সস্‌— ৩০ মি.লি. হিং— ১/২ চা-চামচ লাভেজ (বা সেলেরি)— ২ চা-চামচ শা-জিরা— ২ চা-চামচ

একটা ক্যাসেরোল ডিশ্‌-এ মুর্গিটা রেখে ভাল করে গোলমরিচ ছড়ান। ওয়াইন, শা-জিরা, সেলেরি, ফিশ সস্‌, হিং এক সঙ্গে ভাল করে মিশিয়ে মুর্গির ওপর ঢালুন। ঢেকে দিন। আভেন গরম করুন। ১৯০ ডিগ্রি-তে দিয়ে ১ ঘণ্টা বেক করুন। রান্নার মাঝপথে মুর্গির ঢাকা খুলে বেশ সোনালি হতে দিন।

আমার নোট:

১। সব উপকরণ মিশিয়ে মুর্গি অন্তত ছয় ঘণ্টা অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মুড়ে রেখে দিন। ২। ওটিজি-তে রান্নাটা করুন, এটা খেয়াল রেখে যে ওপর-নীচ দু’টো কয়েলই যেন গরম হয়। ৩। মাঝপথে মুর্গির অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের ঢাকা খুলে সব উপকরণ দিয়ে তৈরি ম্যারিনেড আর একবার ভালো করে মাখান। ৪। সোনালি হোক বা না হোক, নরম হলে বার করে নিন। সোনালি করার তাগিদে বেশি পুড়ে রস শুকিয়ে গেলে খানাটি মাঠে মারা যাবে।

সেলেরি পাতা বাটা আর মাখন এক সঙ্গে মিশিয়ে পাঁউরুটির স্লাইস টোস্ট করে তাতে মাখিয়ে শিরাজ় রেড ওয়াইন সহযোগে পরিবেশন করুন। আপিকিয়ুসের দিব্যি, এমন মুর্গি পোড়া এর আগে আপনি খাননি!

আরও পড়ুন- Roman & Parthian Food Recipe Part I: খানা খানদানি-পর্ব ০৩, ১৬০০ বছরের প্রাচীন রোমান খাবার ‘পুল্লুম পার্থিকুম’ আসলে কী?

খানা-খানদানি প্রকাশিত হবে প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে শনিবার-রবিবার

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস