কাঁথি সমবায় কি সোনার খনি? কেন লড়াই অখিল-উত্তমের? কতটা অধিকার অধিকারীদের?
Contai co-perative Bank: দীর্ঘদিন ধরে ব্যাঙ্কে ক্ষমতায় ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। তখন পূর্ব মেদিনীপুর জুড়ে অধিকারীদের আধিপত্যই ছিল। পরে শুভেন্দু বিজেপিতে চলে যাওয়ার পর নানা দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসতে শুরু করে।
কাঁথি সমবায় ব্যাঙ্ক নিয়ে তোলপাড় রাজ্য। কাঁথি থেকে কলকাতা, দফায় দফায় বসছে বৈঠক। হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। একটা সমবায় ব্যাঙ্কের ক্ষমতা নিয়ে দুই পক্ষের লড়াই তো দূর, দলের মধ্যেই এমন টানাপোড়েন নজিরবিহীন। শেষ পর্যন্ত রাশ টেনেছেন মমতা। তবে প্রশ্ন উঠছে, কাঁথি সমবায় ব্যাঙ্কে এমন কী ‘রত্ন’ আছে, যার জন্য এত লড়াই!
পূর্ব ভারতের বৃহত্তম সমবায় ব্যাঙ্ক
ভারতের স্বাধীনতার বছরে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালেই স্থাপিত হয় কন্টাই কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক লিমিটেড। এটি পূর্ব ভারতের বৃহত্তম আর্বান কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক বা সমবায় ব্যাঙ্ক। এই ব্যাঙ্কে বছরে টার্নওভার হয় প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা। এই ব্যাঙ্কের হেডকোয়ার্টার কাঁথিতে হলেও এটির ১৬টি শাখা রয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরে ছড়িয়ে রয়েছে সেই সব ব্রাঞ্চ। এমনকী কলকাতা ও হুগলিতেও রয়েছে এর শাখা।
সমবায় ভোটের ভোটার কারা?
কাঁথি সমবায় ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা তথ্য অনুযায়ী, এই ব্যাঙ্কের শেয়াল হোল্ডারের সংখ্যা বর্তমানে ৮২,১৬৫। সেই সব সদস্যরাই ভোট দেয়। আগে সেই সংখ্যাটা আরও বেশি ছিল, প্রায় ৮৪,০০০। বর্তমানে অনেক শেয়ার হোল্ডারের মৃত্যু হয়েছে। আর বর্তমানে আর ওই ব্যাঙ্কের শেয়ার নতুন করে কেনা যাচ্ছে না। আগে যারা শেয়ার কিনে রেখেছিল, তারাই এখন বিক্রি করতে পারে। ফলে শেয়ার হোল্ডারের সংখ্যা কমে গিয়েছে। ভোটার কার্ডে যেমন নম্বর থাকে, এ ক্ষেত্রেও শেয়ার হোল্ডারদের নম্বর থাকে।
কী কাজ ব্যাঙ্কের এই বোর্ডের?
এই নির্বাচনে মোট ১০৮ জন ডেলিগেটস বা সদস্য নির্বাচিত হয়। আর সেই সদস্যদের মধ্যে থেকে ১৫ জনকে ডিরেক্টর হিসেবে নির্বাচন করা হয়। তারাই ব্যাঙ্কের নীতি নির্ধারণ করে। এই ১৫ জনই ঠিক করে, কে হবে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান। ব্যাঙ্ক কোন পথে চলবে, কখন সুদ হ্রাস করা হবে, কখন বাজারে অনেক লোন ছাড়া হবে, গ্রাহকদের ঋণের আবেদন মঞ্জুর হবে কি না, এগুলি ঠিক করে ওই ১৫ জন ডিরেক্টর। অর্থাৎ তাদের হাতেই মূল কলকাঠি। একেকটি বোর্ডের মেয়াদ থাকে পাঁচ বছর করে। এবার প্রায় ৯ বছর পর ওই ব্যাঙ্কের নির্বাচন হল।
১৫ জনকেই নিয়েই উত্তম-অখিল টানাপোড়েন
গত বছরের ডিসেম্বরে কাঁথি সমবায় ব্যাঙ্কের নির্বাচন হয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে, সেই নির্বাচন হয় কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে। ১০৮টির মধ্যে ১০০টি আসনই পান তৃণমূল সমর্থিত প্রার্থীরা। বাকি ৭ আসনে বিজেপি সমর্থিত প্রার্থীরা জয়ী হয়, একটি আসনে জয়ী হয় নির্দল প্রার্থী। এবার ১৫ জন ডিরেক্টর বাছাইয়ের পর্ব। আর তা নিয়েই শুরু অন্তর্দ্বন্দ্ব।
আদি-নব্য সংঘাত যে শুরু হয়েছে, তা একেবারে স্পষ্ট। তৃণমূলের তরফে যে ১৫ জনের প্যানেল তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল, তাতে নাকি অখিল গিরির ঘনিষ্ঠদের জায়গা বেশি। অন্তত এমনটাই মনে করছে জেলার তৃণমূল নেতা উত্তম বারিক। এমনকী পাল্টা ১৫ জনের আরও একটি তালিকাও তৈরি করে ফেলা হয়েছে। প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে, অখিল গিরি দলেরই নেতাদের ‘বোমা মারব’ বলে হুমকি দিচ্ছেন। এসব সামলাতে আসরে নেমেছেন তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী।
গিরি ও বারিকদের কলকাতায় ডেকে বৈঠকও করেন বক্সী। আর সেই বৈঠকের মাঝে খোদ দলনেত্রী মমতা ফোন করে বার্তা দেন, প্রথম প্যানেলই মানতে হবে। আর ডিরেক্টর ঠিক করে দেবেন তিনি নিজে।
বামেরা দাঁত ফোটাতে পারেনি এই ব্যাঙ্কে
ফিরে তাকালে দেখা যাবে, কংগ্রেস আমলে কংগ্রেসের প্রভাব কিছুটা ছিল এই ব্যাঙ্কের ওপর। তবে সেটা শুধুমাত্র পরোক্ষভাবে। পরবর্তীতে বাম সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীনও এই ব্যাঙ্কের পরিচালন সমিতি ছিল ডানপন্থীই। বামপন্থীরা কখনও এই সমবায় ব্যাঙ্কের দখল নিতে পারেনি।
২০০৯ সালে শুভেন্দু অধিকারী ওই ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান হন। তারপর থেকে দীর্ঘদিন ওই আসনে ছিলেন শুভেন্দু। আজ তৃণমূল বলে, ওই কটা বছরে নাকি শুভেন্দু নিজের মনের মতো করে ব্যাঙ্ক চালিয়েছেন। পরে তিনি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর তাঁকে ওই পদ থেকে সরতে হয়।
৯ বছর পর ফের ক্ষমতার লড়াই
২০১৬ সালে শেষবার নির্বাচন হয়েছিল এই সমবায় ব্যাঙ্কে। সে বার জিতে চেয়ারম্যান হয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। এরপর করোনা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় ভোটপ্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। আর ২০২১ সালে বিজেপিতে চলে যান শুভেন্দু অধিকারী। এই সব জটিলতা পেরিয়ে ২০২৪-এর শেষে ভোট হল এই সমবায় ব্যাঙ্কে। আর তারপরই শুরু হল রাজনৈতিক টানাপোড়েন। সমবায় ব্যাঙ্কের জন্য এই টানাপোড়েন নজিরবিহীন।
কেন এত গুরুত্ব এই সমবায়ের?
প্রথমত, এত বছরের পুরনো একটি ঐতিহ্যবাহী ব্যাঙ্ক এটি। দ্বিতীয়ত, এটি পূর্ব ভারতের সবথেকে বড় ব্যাঙ্ক। তৃতীয়ত, এটির টার্নওভার অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে এটা যদি দখলে রাখা যায়, তাহলে এটা রাজনৈতিক দলের কাছে একটা প্রেস্টিজ ইস্যু। সবথেকে বড় সমবায় ব্যাঙ্ক দখলে থাকবে, এটাই বড় বিষয়। এটাই সবথেকে বড় তাৎপর্য বলে মনে করা হয়।
জেলার রাজনৈতিক মহল মনে করছে, শুভেন্দু অধিকারী লড়াই থেকে সরে গিয়েছেন এবার। কাঁথি সমবায় ব্যাঙ্কের নির্বাচনে বিজেপি মনোভাবাপন্ন লোকজন অংশ নিলেও, সরাসরি বিজেপি কোনও প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেনি।
ব্যাঙ্কের বোর্ডে এলে তৃণমূলের কী লাভ?
দীর্ঘদিন ধরে ব্যাঙ্কে ক্ষমতায় ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। তখন পূর্ব মেদিনীপুর জুড়ে অধিকারীদের আধিপত্যই ছিল। পরে শুভেন্দু বিজেপিতে চলে যাওয়ার পর নানা দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসতে শুরু করে। যদি শুভেন্দু শিবির সেই অভিযোগ প্রথম থেকেই অস্বীকার করেছে। হাইকোর্ট অডিটের নির্দেশেও স্থগিতাদেশ দিয়েছিল।
ভুয়ো অ্যাকাউন্ট করে নোটবন্দির সময় তাতে টাকা সরানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বেআইনি নিয়োগ হয়েছে। এছাড়া লোন দেওয়ার নামে কাটমানি নেওয়ার অভিযোগ তো আছেই। নতুন কমিটি এলে পুরনো সব ফাইল বের করা হবে। এটাই উদ্দেশ্য অখিল গিরিদের। সব অবৈধ কাজকর্ম, দুর্নীতির প্রকৃত তদন্ত হবে।
বিজেপি নেতা শিশির অধিকারী অবশ্য রাজনীতিকরণের কথা মানতে রাজি নয়। যেহেতু হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সবটা হয়েছে, তাই এই ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাননি তিনি।