ওয়াররুমের মুকুল এবার ওয়ার জ়োনে, গ্ল্যামার না কৌশল?

মুকুল রায়কে যে সরাসরি নির্বাচনের ময়দানে নামানো হবে তা দিন কয়েক আগেও সেভাবে আঁচ পাওয়া যায়নি। তবে আবার, বিজেপির কর্ম পদ্ধতি অনুসরণ করলে মুকুলকে ভোটে লড়ানোর সিদ্ধান্তকে খুব একটা বিস্ময়করও মনে হয় না।

ওয়াররুমের মুকুল এবার ওয়ার জ়োনে, গ্ল্যামার না কৌশল?
গ্রাফিক্স- অভীক দেবনাথ
Follow Us:
| Updated on: Mar 18, 2021 | 9:39 PM

কলকাতা: তিনি বরাবরই অন্তরালে থাকতে অভ্যস্ত। সামনাসামনি লড়ার থেকে লড়াইয়ের কৌশল রচনাতেই স্বচ্ছন্দ। বিগত দেড় দশকে বাংলায় যত নির্বাচন হয়েছে, সবগুলিতেই তাঁকে দেখা গিয়েছে ওয়াররুম আলো করে বসে নাগাড়ে ফোনে কথা বলতে। স্নায়ুর চাপ সামলাতে চলত মুহুর্মুহূ সিগারেটে টান। সেই মুকুল রায়ই এবার কুড়ি বছর পর ওয়াররুম ছেড়ে সরাসরি ওয়ার জোনে। বিধানসভা নির্বাচনে এবার কৃষ্ণনগর উত্তর আসনে পদ্ম প্রার্থী হয়েছেন। তবে এবারই প্রথম নয়, এর আগেও একবার বিধানসভায় লড়েছিলেন ‘চাণক্য’ মুকুল। তবে সে স্মৃতি মোটেই সুখের নয়। বিধানসভা নির্বাচনে স্ট্রাইক রেট ভাল নয় মুকুলের। জোড়াফুল প্রতীকে প্রথম বলেই ‘ডাক’ হয়েছিলেন ২০০১ সালে। তারপর আর জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য লড়েননি মুকুল রায়।

যুব কংগ্রেস নেতা হিসেবে রাজনীতিতে পথ চলা শুরু কাচরাপাড়ার মুকুল রায়ের। যুব কংগ্রেসে থাকর সময়ই মমতার সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে মুকুলের। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল গড়ার সময় মমতার হাত শক্ত করে ধরেছিলেন তিনিই। খাতায় কলমে তিনিই তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাতা। এরপর ২০০৬ সালে তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকেই ক্রমশ দিল্লিতে তৃণমূলের মুখ হয়ে ওঠেন মুকুল রায়। এর আগে অবশ্য ২০০১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে উত্তর চব্বিশ পরগনার জগদ্দল বিধানসভা কেন্দ্র থেকে লড়েছিলেন মুকুল রায়। কিন্তু ফরওয়ার্ড ব্লকের হরিপদ বিশ্বাসের কাছে হেরে যান মুকুল। এরপর আর জনপ্রতিনিধি হওয়ার লড়াইয়ে নামেননি তিনি। তবে জনপ্রতিনিধি না হলে কী হবে, গুচ্ছ গুচ্ছ জনপ্রতিনিধি তৈরি করেছেন মুকুল, এমনটাই বলেন রাজনীতির কারবারিরা। দুই দশকের বেশি সময় তৃণমূলের সাংগঠনিক খুঁটি সামলেছেন দক্ষ মুকুল। লাগাতার ৬ বছর দিল্লিও সামলেছেন। ২০০৬ সাল থেকেই তিনি রাজ্যসভার সাংসদ। ২৮ মে ২০০৯ থেকে ২০ মার্চ ২০১২ পর্যন্ত মুকুল ছিলেন রাজ্যসভায় তৃণমূলের নেতা। এরপর মন্ত্রী হিসাবে যাত্রা শুরু হয় তাঁর। প্রথমে প্রতিমন্ত্রী ও পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইস্তফা দেওয়ায় রেল প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন মুকুল রায়।

২০১২ সালে বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে ওঠেন দীনেশ ত্রিবেদী (তিনিও এখন বিজেপি-তে)। রেল বাজেটে ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে মমতার কোপে পড়েন তৎকালীন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী। মমতার আপত্তিতে ইস্তফা দিতে হয় দীনেশকে। তখন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটেলের কাছে শপথ বাক্য পাঠ করে ভারতের রেলমন্ত্রী হন মুকুল রায়। কিন্তু সেই বছরই ৫১ শতাংশ এফডিআই-তে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের অনুমোদনের পরে ফাটল ধরে জোটে। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই ইতি হয় মুকুলের মন্ত্রীত্বের যাত্রা। এরপর থেকে না বিধায়ক, না মন্ত্রী মুকুল। তবে সব সময় দক্ষ সংগঠক হিসেবে ফুল মার্কস নিয়ে পাশ করেছেন তিনি। দায়িত্ব পালন করেছেন রাজ্যসভাতেও।

এরপর বিজেপি পার্টি অফিস থেকে প্রকাশিত হয় নারদা স্ট্রিং অপারেশনের ফুটেজ। সেখানে টাকা নিতে দেখা যায় মুকুল রায়কে। নাম জড়ায় সারদা কেলেঙ্কারি মামলাতেও। তখন থেকেই ক্রমশ তৃণমূল-মুকুল দূরত্ব বাড়তে থাকে। যদিও মুকুলের দাবি, তৃণমূলের রাজনৈতিক লাইন অপছন্দ হওয়াতেই তিনি সরে আসছিলেন। এই সময় মুকুলের সঙ্গে তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ও বিজেপির সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয়বর্গীয়র যোগাযোগের খবর আসতে থাকে। এই অভিযোগেই তৃণমূল থেকে পরবর্তী ৬ বছরের জন্য তৃণমূল থেকে সদস্যপদ বাতিল হয় তাঁর। এর কয়েক মাস পরই মুকুল ইস্তফা দেন তৃণমূল থেকে। দু’মাস পরেই মুকুল ঝাঁপ দেন পদ্মে।

এরপর থেকে বারবার ভাঙন ধরেছে তৃণমূলে। একের পর এক নেতা তৃণমূল পড়েছেন পদ্মের মোহে। বিশ্লেষকরা বলেন, এখন বিজেপিতে যে দলবদলুদের আনাগোনা তার শুরুটা হয়েছিল মুকুলের হাত ধরেই। তবে সংগঠক হিসেবে বিজেপিতেও আস্থা অর্জন করেন মুকুল, এমনটাই মত ওয়াকিবহাল মহলের। তাঁর বিজেপি যোগদানের পর ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসনে জিতেছে বিজেপি। ভোট শতাংশ বেড়েছে রেকর্ড হারে। বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলে, এই অভূতপূর্ব সাফল্যের জন্য কৌশলী মুকুলের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

এ দিকে মুকুল রায়কে যে সরাসরি নির্বাচনের ময়দানে নামানো হবে তা দিন কয়েক আগেও সেভাবে আঁচ পাওয়া যায়নি। তবে আবার, বিজেপির কর্ম পদ্ধতি অনুসরণ করলে মুকুলকে ভোটে লড়ানোর সিদ্ধান্তকে খুব একটা বিস্ময়করও মনে হয় না। ভোটের রাজনীতিতে একেবারে আনকোরা এবং চিরকাল আরএসএস করে আসা দিলীপ ঘোষকেও রাজ্য সভাপতি করার কয়েক মাসের মধ্যে বিধানসভার প্রার্থী করা হয়। গেরুয়া শিবির সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মহলের মতে, যে যতই বড় কৌশল রচনাকারী হোন না কেন, জনসমর্থন আছে কিনা তা নির্বাচনের কষ্টিপাথরে যাচাই করে দেখতে চাওয়া হয় এই দলে। বঙ্গ বিজেপিতে দিলীপ ঘোষ এবং মুকুল রায়ের শিবির বিভাজনের কথা তাই কান পাতলেই শোনা যায়। সে ক্ষেত্রে দিলীপ ঘোষকে একাধিকবার নির্বাচনে লড়ে নিজের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়েছে। তাই মুকুল রায়কেও এবার বিধানসভার টিকিট দেওয়া অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।

এখন দেখার কুড়ির গেরো (২০ বছর পর লড়ছেন) পেরতে সক্ষম হন কিনা মুকুল রায়। এবার কৃষ্ণনগর উত্তরে তাঁর বিরুদ্ধে তৃণমূলের তারকা প্রার্থী কৌশানি। ফলে, লড়াইটা গ্ল্যামারের সঙ্গে দক্ষ কৌশল রচনাকারীর। এবার কি স্ট্রাইক রেট ৫০ করতে পারবেন মুকুল না কি প্রথম বলেই ৬ মারবেন কৌশানি? উত্তর দেবে কৃষ্ণনগর উত্তর, তারিখটা ২ মে।

আরও পড়ুন: শিখা মিত্রের পর তরুণ সাহা! ‘আমাকে না জানিয়েই প্রার্থী করেছে বিজেপি, লড়ব না’