Rahul Arunodoy Bandhopadhyay: ‘আজও বেমক্কা আশিকি হয়, নতজানু হয়ে কুঁচি ঠিক করে প্রেমিক’
সরস্বতী পুজো, প্রেম, নস্টালজিয়া... TV9 বাংলার জন্য কলম ধরলেন অভিনেতা রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়।
আপনাদের কারও গানটা মনে আছে? ‘সরস্বতী বিদ্যেবতি, তোমায় দিলাম খোলা চিঠি/একটু দয়া করো মাগো বিদ্যে যেন হয়/এসব কথা লিখছি জেনো নালিশ করে নয়…’। লোডশেডিংয়ের অন্তাক্ষরিতে ‘স’ দিয়ে এই গানটা আমাদের অবধারিত ছিল। সরস্বতীর প্রতি কেন জানি না আমার একটা অমোঘ আকর্ষণ আছে। আমি আজন্ম না হলেও বর্তমানে নাস্তিক। কিন্তু শৈশবে ঘোরতর আস্তিক ছিলাম। ফাঁকিবাজদের পাশ-ফেল চিরকালই গোলমেলে ব্যাপার। তার উপর যথারীতি কুল সরস্বতী পুজোর আগেই খেয়ে ফেলতাম। ফলে প্রত্যেক বার মনে হয় এই বার গেলাম। কিন্তু দেখতাম প্রত্যেকবার মনীষা কৈরালা থুড়ি সরস্বতী আমাকে বাঁচিয়ে দিতেন। আজকের নাস্তিক আমি যদিও বলছে, “সরস্বতী নয়, হল কালেকশন বাঁচিয়েছে”। পুরনো আমি কাউন্টার করছে, “সরস্বতী মা ছিলেন বলেই সহজ গার্ড পড়েছে”। ছাড়ুন, বাঙালি মধ্যবিত্ত নাস্তিকের এই আত্মরণ চিরকাল চলে এসেছে, নতুন কিছু নয়।
ঋতুদার সঙ্গে আমার খুব চমকপ্রদ আলোচনা হয়েছিল। ঋতুদা আমায় প্রশ্ন করেছিলেন, “সরস্বতী কীসের দেব বলতো?” স্বাভাবিক ভাবেই আমি বলেছিলাম, ‘বিদ্যার দেবী’। তখন ঋতুদা দুর্গার পারিবারিক স্ট্রাকচার দিয়ে আমাকে বুঝিয়েছিলেন, ‘দ্যাখ, দুর্গার প্রত্যেকটা সন্তান কী করে, তা তার বাহন দিয়ে বোঝা যায়। কার্তিক পুরুষশ্রেষ্ঠ, তার বাহন ময়ূর। গণেশ সম্পদের দেবতা। সম্পদ মানেই সে সময় গোদাম, গোদাম মানেই ইঁদুর। গোটা পৃথিবীতে owl বা প্যাঁচাকে জ্ঞানী (wise) মনে করা হয়। তাই জ্ঞানের দেবী লক্ষ্মী এবং বাংলা যেহেতু নদীমাতৃক দেশ, নদীর দেবী সরস্বতী, যার বাহন রাজহাঁস। ঘটনাচক্রে সরস্বতী নদী শুকিয়ে গেছে বলে এবং শিক্ষা এবং অর্থের সমানুপাতিক সম্পর্ক তৈরি হওয়ার ফলে লক্ষ্মী আজ অর্থের দেবী, সরস্বতী বিদ্যার।”
আমার বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই, কিন্ত যে বলেছে তার মেধা বা পড়াশোনা নিয়ে সন্দেহও নেই। কোনও প্রগাঢ় হিন্দু যদি রেগে গিয়ে থাকেন তাহলে আমার কিছু করার নেই। ঋতুদা নতুন ধর্ম এই পৃথিবীতে আনতে চাননি। তিনি একটি উৎসাহী নতুন অভিনেতার সঙ্গে academic discussion করেছিলেন। সত্যিই বয়স হয়ে গেছে, এত কথা কেন লিখছি? বোধহয় এই সত্যিটা লুকোনোর জন্য যে সরস্বতী পুজোর মতো প্রেমের পুজো আর হয় না। ঠিক লুকোনোও বলব না, আসলে সরস্বতী পুজো আর প্রেম নিয়ে এত কথা হয়েছে নতুন আঙ্গিক ভাবা কঠিন। তবে এটাও তো ঠিক সরস্বতী লগ্নজিতা-কণ্ঠি, লগ্নজিতার জন্মের আগে থেকে কানের কাছে এসে বলবে, ‘বসন্ত এসে গেছে’। আর বসন্ত তো শুধু ঋতুতে এসেছে তা নয়, শরীর-মন কিছু বাকি নেই বসন্ত এসে যাওয়ার, সেটাই মনে করিয়ে দেয় এই পুজো। মেয়েদের স্কুল মর্নিংয়ে, ছেলেদের স্কুল ডে’তে। দেখা প্রায় হতোই না। কিন্তু ইংলিশের শিক্ষক সুবোধ স্যর পুজো করে চলে যাওয়ার পর একদিনের জন্য হলেও ছেলেমেয়ে মিশে যেত। তারপর শুরু হত ‘গ্যালাখেলা’। একদিকে একদল ছেলে যারা বুভুক্ষু (অবশ্যই খিচুড়ির জন্য নয়), আরেকদিকে একদল মেয়ে যারাও equally deprived এর চক্করে প্রচুর ভুলভ্রান্তিও হত। বিনোদ কাম্বলির মতো দেখতে একটা মেয়েকে আমার বন্ধুর দিব্যা ভারতী মনে হয়েছিল। এবং সাড়ে চার ফুটের আমার বেস্টফ্রেন্ড শুভদেব প্রপোজাল পেয়েছিল কারণ ওকে নাকি আগরকারের মতো দেখতে। বিশ্বাস করুন, ওকে আগরকার তো দূরে থাক, আগরবাতি বা আগরপাড়ার মতোও দেখতে নয়।
লাল্টুর ঠাকুরদা পুরোহিত ছিলেন। কিন্তু সরস্বতী পুজোর দিন মনে হত সি.আই.এ। নিজের পরিচয় এত গোপন রাখতেন মনে হত ডায়রেক্ট কিউবার সি-বিচে ল্যান্ড করে বলছেন, “হিত, পুরোহিত”। কারণ কে কোথা থেকে হাইজ্যাক করে নেবেন ওঁকে, বেচারা উনিও জানেন না। আর পাড়ার পুজোয় আমাদের যা মার্জিন হত তাতে স্বচ্ছন্দে একে অপরকে ‘shark tank’-এ পিচ করা যেত। একবার চাঁদার উদ্বৃত্ত টাকায় সবাই ডিওডোরেন্ট রোল অন কিনেছিলাম। মনে রাখতে হবে সেই সময় ডিও স্প্রে এ দেশের চৌহদ্দিতে ঢোকেনি। আমি ছিলাম চাঁদা স্পেশালিস্ট কারণ যাবতীয় কঠিন বাংলা বানানের উত্তর আমি দিতাম।
শেষে বলি, আমি বিশ্বাস করি না কিছু বদলেছে। এখনও নতুন-নতুন শাড়ি পরা প্রেমিকার সামনে নতজানু হয়ে প্রেমিক কুচি ঠিক করে, আজও পুরোহিত হাইজ্যাক হয়। আজও বেমক্কা আশিকি হয়। হয়তো শাড়ির কুচি ঠিক করার সময় এখন ফেসবুক লাইভ হয়, তখন হত না। দুঃখের কিছু নেই, একটা সময় নভেল পড়া অপরাধ ছিল। টিভি চলে এল। “আজকাল কেউ নভেল পড়ে না,সবাই টিভি দেখে…”, এটা শুনেই বড় হয়েছি। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়া বলে টিভির সময় আমরা ভাল ছিলাম, এখন সোশ্যাল মিডিয়া সব শেষ করে দিল। তেমনি আমি জানি কোনও এক সরস্বতী পুজোয় লোকে ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামকে মিস করবে, কারণ নতুন কিছু আসবে। নতুন কী আসবে? তা সরস্বতীই জানেন।