পূর্ণবয়স্ক হাতি দাঁত পড়ে যাওয়ায় না খেতে পেয়ে অপুষ্টিতে মারা যায়: হাতি বিশেষজ্ঞ শান্তনু ঘোষ

World Elephant Day 2021: হাতির বিষয়ে জানার কোনও শেষ নেই। তবু এই বিশেষ দিনে হাতি বিশেষজ্ঞ তথা জ়ুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রাক্তন বিজ্ঞানী শান্তনু ঘোষ TV9 বাংলার সঙ্গে হাতি সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য শেয়ার করলেন।

পূর্ণবয়স্ক হাতি দাঁত পড়ে যাওয়ায় না খেতে পেয়ে অপুষ্টিতে মারা যায়: হাতি বিশেষজ্ঞ শান্তনু ঘোষ
Follow Us:
| Updated on: Aug 12, 2021 | 9:36 AM

১২ অগস্ট। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ওয়ার্ল্ড এলিফ্যান্ট ডে। হাতি নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতূহল অনেক। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই জানার বিষয় সীমিত। চিড়িয়াখানায় গিয়ে হাতি দেখা অথবা জঙ্গল সাফারিতে হাতি দেখার মধ্যেই হয়তো সে অভিজ্ঞতা সীমাবদ্ধ। যদিও হাতির বিষয়ে জানার কোনও শেষ নেই। তবু এই বিশেষ দিনে হাতি বিশেষজ্ঞ তথা জ়ুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রাক্তন বিজ্ঞানী শান্তনু ঘোষ  TV9 বাংলার সঙ্গে হাতি সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য শেয়ার করলেন।

হাতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা অত্যন্ত কম। আপনি দীর্ঘদিন চর্চা করেছেন। হাতির বিষয়ে তিনটি বইও রয়েছে আপনার। হাতি নিয়ে একেবারে সাধারণ পাঠকের কোন বিষয়গুলো জানা জরুরি?

হাতি একটা বিরাট সাবজেক্ট। এর অনেক দিক রয়েছে। বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা রয়েছে। শ্রী লালজি বড়ুয়া এবং ইয়ান ডগলাস হ্যামিলটন আমার গুরু। দু’জনেরই প্রিয় ছাত্র আমি। ওঁদের কাছ থেকে অনেক কিছু জেনেছি। আমার নিজেরও গবেষণা রয়েছে। হাতির উপর সবথেকে বড় আমার লেখা বইটি হল ‘হস্তিপুরাণ’। ফলে একটা, দু’টো বিষয় তো নয়। অনেক জানার রয়েছে।

হাতি তো অনেকদিন বাঁচে, এই প্রাণীর লাইফ স্প্যান অনেক বড়?

হাতির লাইফ স্প্যান নিয়ে প্রচুর মিথ রয়েছে, যেগুলো বিজ্ঞানসম্মত নয়। সাধারণভাবে অসুখ না হলে, হাতি ৬৫ থেকে ৭০ বছর বাঁচে। ১০০ বা ১৫০ বছর হাতি বাঁচে, এগুলো গল্প কথা। যতদিন হাতি বেঁচে থাকে, সেই সময়টাকে ধরলে হাতির মুখে মোট ২৪টা দাঁত থাকে। এই সংখ্যাটা টাস্ক ছাড়া বলছি। কষের দাঁত। মোলার টিথ। ২৪টা থাকে। হাতি যা খায়, ডাল, গাছের পাতা, সেগুলো ক্রাশ করতে কষের দাঁত দরকার হয়। মায়ের দুধ ছাড়ার পর জঙ্গলে এগুলোই হাতি খায়। যতদিন হাতি বেঁচে থাকে, এই দাঁতগুলো একসঙ্গে থাকে না। ছ’টা সিরিজে থাকে। চারটে করে এক-একটা সিরিজ। প্রথম দাঁত গজাবার পর থেকে শেষ দাঁত যখন গজায়, প্রত্যেক দাঁতের মাপ আছে, স্থায়িত্ব কাল আছে। শেষ মোলার বা সিক্সথ মোলার ৬৫ থকে ৭০ বছরের মধ্যে পড়ে যায়। তখন হাতির খাবার সামর্থ্য থাকে না। হাতি প্রায় না খেতে পেয়ে মারা যায়। অপুষ্টিতে মারা যায়। অত বড় শরীর, প্রচুর ক্যালোরি দরকার হয়। কিন্তু দাঁত না থাকার কারণে না খেতে পেয়ে জঙ্গলি হাতি মারা যায়। পোষা হাতি থাকলে খিচুড়ি বা নরম ভাত খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয় অনেক সময়। তবে সেটি ব্যতিক্রম।

1

হাতির খাবারের মধ্যে বিশেষত্ব রয়েছে?

হাতি প্রচুর খাবার খায়। প্রচলিত প্রবাদ আছে, ‘হাতির খোরাক’। সেটা ভুল বলব না। সেটা ঠিক। একটা জঙ্গলি প্রাপ্তবয়স্ত হাতির ২৫০ থেকে ৩০০ কেজি সবুজ খাবার অর্থাৎ ঘাস, লতাপাতা, ফল, গাছের শেকড়, জঙ্গলি আম, জাম, চালতা প্রতিদিন প্রয়োজন। হাতির আবার অনেক নবাবি ব্যাপার রয়েছে। যতটা খাবার খায়, প্রায় ওই পরিমাণ খাবার নষ্ট করে। ভাঙে, ফেলে দেয়, পা দিয়ে মাড়িয়ে দেয়। এটা হিসেব করলে দেখা যাবে, একটি প্রাপ্তবয়স্ক হাতির প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৫৫০ কেজি খাবারের প্রয়োজন। ওই পরিমাণ জঙ্গলকে সাপোর্ট করতে হয়। তবে সে জঙ্গলে হাতি থাকতে পারে। বাচ্চা হাতির খাবারের একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার আছে। সেটা সাধারণ মানুষ জানেন না বলেই আমার ধারণা।

2

কী সেটা?

জন্মের পর থেকে যে কোনও স্তন্যপায়ী প্রাণাী মায়ের দুধ খায়। একটা বয়সের পর মায়ের দুধ ছাড়তে হয়। হাতিও ব্যতিক্রম নয়। মানুষের বাচ্চারাও মায়ের দুধ খায়, সঙ্গে সেমি সলিড খাবার খায়, যা শক্ত খাবারে পৌঁছে দেওয়ার আগের স্টেজ। হাতিদের ক্ষেত্রেও তাই হয়। এর একাধিক কারণ আছে। দুধ ছাড়ার পর থেকে যখন সেমি সলিড ফুডে অভ্যস্ত হবে কোনও ছোট হাতি, তখন তার খাবার হল বড় হাতির মল। এটা বাচ্চা হাতি খায়। এর প্রথম কারণ হাতি ব্যাড অ্যাসিমিলেটার। হাতি যে খাবার খায় তার ৩৬ থেকে ৩৭ শতাংশ হজম হয়। বাকিটা বেরিয়ে যায়। এই যে মলটা বেরিয়ে গেল, এর মধ্যে হাফ, কোয়ার্টার, থ্রি ফোর্থ ডাইজেস্টেড খাবার থাকে, যেগুলো পাচক রসে জারিত হয়ে থাকে। ফলে বড় অংশ সিম্পল ফর্মে থাকে। বাচ্চারা খেলে হজমে সুবিধে হয়। হাতি যা খায়, তা হল সেলুলোজ়। আর এগুলো ভাঙতে যে উৎসেচক দরকার হয়, তা সেলুলেজ়। এটা কোনও প্রাণী নিজেরা তৈরি করতে পারে না। এটা এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া এবং এক ধরনের প্রোটোজ়োয়া অর্থাৎ এক কোষ প্রাণী, তৈরি করে। হাতির মলে এই ব্যাকটেরিয়া এবং প্রোটোজ়োয়া প্রচুর পরিমাণে থাকে। বাচ্চা হাতি যখন মল খাচ্ছে খাবার হিসেবে তখন পাচনতন্ত্রে এই ব্যাকটেরিয়া এবং প্রোটোজ়োয়া স্বাভাবিক ভাবেই চলে যাচ্ছে। ভিতরে গিয়ে ওগুলো মাল্টিপ্লাই করতে থাকে। ধীরে-ধীরে ভিতরে যতটা ব্যাকটেরিয়া বা প্রোটোজ়োয়া থাকা দরকার, তা তৈরি হয়ে যায়। হাতি যখন অ্যাডাল্ট হয়ে যায়, তখন পুরোটাই তৈরি হয়ে যায়।

3

সারা বছরই এক রকম খাবার খায় হাতি?

না। হাতির খাবার সারা বছর এক রকম থাকে না। গরমে তার জলের প্রয়োজন। যে সব খাবারের মধ্যে জল থাকে, কলাগাছ এই জাতীয় খাবার বেশি খায় গরমে। বর্ষায় যে সব খাবারে কম জল আছে, তা খায়। যে সব জায়গায় কাদা বেশি আছে, বর্ষায় সে সব জায়গায় যায় না। কারণ স্লিপ করতে পারে, সেটা হাতি জানে। শীতে শুকনো খাবার খায়, আর রোদ্দুর পাবে এমন উঁচু জায়গা পছন্দ করে।

হাতির সোশ্যাল লাইফ কেমন?

হাতি দলবদ্ধ জীব। হাতির দল মানে এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। দলের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্কা এবং দলকে পরিচালনার শক্তি থাকবে, এমন হাতি সেই দলের লিডার। মাহুতের ভাষায় ‘রানি ঢুঁই’। এরা সারা দিনের কর্মপন্থা ঠিক করে। কোনও বিপদ হলে, ধরা যাক মানুষ আক্রমণ করেছে, কোনও জায়গায় বন্যা, খরা হয়েছে, তখন কী করতে হবে, কী ভাবে সেই পরিস্থিতি সামলানো যায়, এ সব ব্যাপার ঠিক করে রানি ঢুঁই। বাকিরা তাকে ফলো করে। দলে পুরুষ হাতিও থাকে। সবথেকে শক্তিশালী যে পুরুষ হাতি সে ডিফেন্স মিনিস্টার। একটা দল যখন মুভ করে, এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যায়, সেই শক্তিশালী পুরুষ হাতি পিছনে থাকে। যাতে অ্যাটাক হলে দু’-চারটে পুরুষ হাতি নিয়ে তাড়া করতে পারে। এই হাতিকে বলে ব্রিডিং বুল। এরা পলিগ্যামাস। দলে প্রোডাকটিভলি অ্যাক্টিভ যে সব ফিমেল হাতি থাকে, ব্রিডিং বুল সেক্সুয়ালি তাদের এনজয় করে।

4

কোনও দলে সংখ্যায় একটিই ব্রিডিং বুল থাকে?

দেখুন, এখন জঙ্গল ছোট হয়ে যাওয়ার কারণে দলও ছোট হয়ে গিয়েছে। আগে ৩০, ৪০, ৫০টি হাতি নিয়ে দল তৈরি হত। ৮-১০ টা হাতির দলকে আমরা সাব গ্রুপ বলতাম। এখন ১০টা হাতি নিয়েও দল তৈরি হয়। সেই ছোট দলে ব্রিডিং বুল একটাই থাকে। বড় দল হলে দুটো ব্রিডিং বুল থাকতেও পারে। কারণ দল বড় হলে যতগুলো প্রোডাকটিভলি অ্যাক্টিভ মাদি হাতি থাকে, সকলকে একটা ব্রিডিং বুলের পক্ষে সেক্সুয়ালি স্যাটিসফাই করা সম্ভব হয় না। এই স্লটটার জন্য পুরুষ হাতিদের মধ্যে মারামারি হয়। আমরা মাঝে মধ্যেই লোনারের কথা শুনি। মাঝে মধ্যে দেখা যায় একলা হাতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনও দলে হয়তো পুরুষ হাতিদের মধ্যে লড়াই হয়েছে। যে হেরে গিয়েছে, সেই হাতি বেরিয়ে গেল। হেরে গেলে দল থেকে বেরিয়ে যায় হাতি এবং একা হয়ে যায়। সেই হাতিটা তখন লোনার। যে তাকে মেরে হটিয়েছে, তাকে হারিয়ে ফের দলে ঢুকতে সে চেষ্টা করে।

এই একলা হাতিকেই কি পাগলা হাতি বলে?

পাগলা হাতি ব্যাপারটা একটু গোলমেলে। আসলে যেটা হয়, শ্রী লালজি বড়ুয়া আমার গুরু। আসাম গৌরীপুরের রাজা ছিলেন। ওদের এক সময় প্রচুর হাতি ছিল। পোষা হাতির ক্ষেত্রেও যেটা দেখা যায়, তা হল হাতির একটা মেন্টাল ব্ল্যাকআউট হয়। সে সময় ইব়্যাটিক বিহেভ করে। সেটা ২-৩ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। এটা সাময়িক। বিজ্ঞানীরা এর কারণ পুরোটা এখনও জানেন না। এটা একটা দিক। আবার যে ব্রিডিং বুল, মেল হাতির কথা বলছি, জঙ্গলের হাতি, একটা বিশেষ সময় পুরুষ হাতির ‘মস্ত’ হয়। অর্থাৎ চোখ আর কানের মাঝখান দিয়ে যদি একটা লাইন টানা যায়, তার মাঝে একটা ছোট্ট ফুটো থাকে, সেখান থেকে মদরস বেরোয়। সেটা হল সিক্রিয়েশন অব ল্যাক্রাইম্যাল গ্ল্যান্ড। এটা তিন মাস, চার মাস বা ১০, পাঁচদিনও হতে পারে। সেটা নির্ভর করে বয়স এবং স্বাস্থ্যের উপর। এই সময় হাতি সেক্সুয়ালি চার্জড হয়ে থাকে। এই সময় যদি সেক্লুয়াল পার্টনার না পায়, মেজাজ বিগড়ে যায়। তার উপর লোনার হয়ে গেলে সে লড়াইয়ে হেরে গিয়েছে, চেয়ার চলে গিয়েছে। ফলে বিগড়োনো অ্যানিম্যাল। এটাও একটা পরিস্থিতি। তবে এটাকে পাগলা হাতি বলার কোনও মানে আছে বলে মনে হয় না। আমি নিজে উত্তরবঙ্গে দেখেছি, ভুট্টা খেতে নেমেছে হাতি, জ্বলন্ত বর্শা পিঠে লাগিয়ে দিচ্ছে, দগদগে ঘা হয়ে যাচ্ছে। সেটা বিষিয়ে যাচ্ছে। জঙ্গলের হাতি তো ট্রিটমেন্টও পায় না। তখন তো হাতি অন্যরকম বিহেভ করবেই।

5

হাতি তো অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী বলে শুনেছি। মানুষ হাতিকে নানা ভাবে কাজে লাগিয়েছে। হাতি কতটা হিউম্যান ফ্রেন্ডলি?

হাতি জঙ্গলের জীব। মানুষ শহর, গ্রামের জীব। কাজেই প্রকৃতির নিয়মে দু’জনেরই দু’জনকে অ্যাভয়েড করা দরকার। কেউ কারও বন্ধুও নয়, শত্রুও নয়। জঙ্গলের হাতি আর পোষা হাতিকে এক জায়গায় ফেলা উচিত নয়। জংলি হাতি কোনও কারণ ছাড়া সাধারণত মানুষকে আক্রমণ করে না। তবে একবার যদি মানুষের ভয় চলে যায় হাতির, তখন কারণ ছাড়াও আক্রমণ করতে পারে। কারণ সে হাতিকে হয়তো তাকে আগে বর্শা ছুঁড়েছে মানুষ। সে দেখেছে, মানুষ এ সব করে। ফলে মানুষ দেখলেও তেড়ে যেতে পারে। লালজিরা জঙ্গল থেকে হাতি ধরে ট্রেনিং করাতেন। উনি আমাকে বলেছিলেন, যে হাতি ট্রেনিং করার সময় কোনও মানুষকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিত, তাকে আর ট্রেন করাতেন না। কারণ সেই হাতি মানুষের দৌড় কতটা তা বুঝে গিয়েছে।

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস।