অহংকারহীন এক নীরব দার্শনিক: ‘আমি সৌমিত্র’র পরিচালক সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়

যদি উনি আজ থাকতেন, তাহলে ‘অভিযান’ ও ‘আমি সৌমিত্র’ দুটো ছবির জন্য একই রকম গর্বিত হতেন। ওঁর জাগতিক সব আশীর্বাদ আমরা পেতাম। ওঁর সামনে ওঁকে দেখে উনি কী অনুভব করছেন, সেই বিরল অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়া আর হল না।

অহংকারহীন এক নীরব দার্শনিক: ‘আমি সৌমিত্র’র পরিচালক সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়
‘আমি সৌমিত্র’-তে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
Follow Us:
| Updated on: Jan 19, 2021 | 9:50 AM

শুধু অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নন। কবি। নাট্যকার। নাট্যপরিচালক। চিত্রকর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর একটা ‘আমি’ নয়। অনেকগুলো ‘আমি’ ছিল। এবং সেই সব ‘আমি’কে জড়ো করেছেন পরিচালক সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়। দীর্ঘ ডকু-ফিচারে বুনেছেন সে গল্প। ‘আমি সৌমিত্র’। ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আমি সৌমিত্র’র ট্রেলর রিলিজ হতে চলেছে। আনন্দের খবরেও প্রিয় সৌমিত্রের জন্মদিনে পরিচালকের মনখারাপ। যাঁকে নিয়ে ছবি তিনিই যে নেই। Tv9 বাংলার সঙ্গে কথা বললেন সায়ন্তন। জানালেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে অনেক কিছু যা জানানো হয়নি কখনও।

আপনার ডকু-ফিচারে শেষ কাজ করলেনআক্ষেপ না অহংকার? আক্ষেপ। একটাই আক্ষেপ সৌমিত্রবাবু ছবিটা দেখে যেতে পারলেন না। ‘আমি সৌমিত্র’ ওঁর খুব ভালবাসার এবং কাছের খুব ব্যক্তিগত এবং নৈর্ব্যক্তিক কাজ ছিল। আর অহংকার নিয়ে কী করব? বাংলা এবং বাঙালির সব অহংকার নিয়ে তো উনি চলে গেলেন।

আরও পড়ুন কঙ্গনার ‘রক্তাক্ত’ লুক এল সামনে, সৌজন্যে ‘ধক্কড়’

২১ ফেব্রুয়ারি ‘আমি সৌমিত্র’র ট্রেলর মুক্তি। আর আজ তাঁর জন্মদিন। এত ভালর মধ্যে মন কেমন রয়েছে? আজ তাঁর জন্মদিন। প্রতিবার জন্মদিনের বিকেলবেলায় তাঁকে মঞ্চে দেখা যেত। কিন্তু এবার মঞ্চ আছে, কিন্তু আমাদের মঞ্চের সেই দিকপাল নেই।

এতদিন একসঙ্গে শুটিং করেছেন, কী-কী শিখলেন ওঁর মতো এত বড় মাপের মানুষের থেকে?

একজন অত বড় মাপের মানুষ হয়ে অত বিশালমাপের তারকা হয়ে কীভাবে একজন স্বাভাবিক সামান্য পথচারীর মতো ওঁর পদচারণা। এটা ওঁর থেকে পাওয়া সবচেয়ে বড় শিক্ষা। শিল্পর প্রতি ওঁর ডেডিকেশন। ওঁর কাজের প্রতি প্যাশন, যা আজীবন এক অনন্ত শিক্ষা হয়ে সারাজীবন আমার কাছে থেকে যাবে।

 

‘আমি সৌমিত্র’র পরিচালক সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়।

তাঁকে ঘিরে এমন এমন কোনও ঘটনা যা বারবার মনে পড়লে মন ভাল হয়ে যায়? ওঁর সঙ্গে যতবার দেখা হত মন ভাল হয়ে যেত। পায়ে হাত দিতেই এক জ্ঞানবৃক্ষের ছায়া পাওয়া যেত। সে-ই অনুভূতি অন্তরে নিবিড়। আমি রবীন্দ্রনাথকে কখনও দেখতে বা ছুঁতে পারিনি। তার আকাঙক্ষা ওঁকে কাছে পেয়ে অনেকটাই পূর্ণ হয়েছে।

 

আজ পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের ‘অভিযান’-এর টিজার রিলিজ করছে, খবর পেয়েছেন নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ পেয়েছি। এবং একই দিনে একটি ছবির টিজার এবং একটি ডকুফিচারের ট্রেলার রিলিজ করুক চাইনি। কারণ সেটা হলে, ছবি দুটো মানুষের কাছে সমানভাবে জায়গা করতে পারবে না বলে আমার মনে হয়। তাই ‘আমি সৌমিত্র’র ট্রেলর-এর মুক্তির তারিখ পিছিয়েছি।

 

পরমব্রতর বা আপনার মতো পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সৌমিত্রর কাছ থেকে শেখার তালিকায় এক থেকে পাঁচে কী-কী রাখবেন?

১. মানুষকে শ্রদ্ধা ভালবাসা আরও গভীরভাবে জানার বা চেনার ইচ্ছে। ২. বাংলা ভাষায় উপর গভীর প্রেম। প্রজ্ঞা ও দখল, এবং তা নিয়ে গর্ববোধ করা। ৩. অসম্ভব মার্জিত ছিল তাঁর রুচিবোধ। এবং একই সঙ্গে কীভাবে এত প্রজ্ঞা এবং বহুমুখী প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও কীভাবে এত মিষ্টি এবং সরস রাখা যায় নিজেকে। ৪. ওঁর টাইম ম্যানেজমেন্ট (সিনেমা, নাটক, লেখা, আঁকা, আড্ডা, আনন্দ) সব কিছুতেই তিনি অত্যন্ত সাবলীল এবং স্বাভাবিক ছন্দে গমন করতে পারতেন। এটা খুব শিক্ষণীয়। আরও ভালভাবে যদি বলি ‘আমি সৌমিত্র’ আগামী প্রজন্মের কাছে একটি ক্লাসরুম হতে চলেছে। সেভাবেই আমরা এটা তৈরি করেছি। যা শুধু আগামী প্রজন্মের সমস্ত অভিনেতাদের নয় আগামী প্রজন্মের শিল্পীদেরও দেখা উচিৎ। ৫. ওঁর জীবনযুদ্ধ। সমস্ত রকম পরিস্থিতিতে ওঁর লড়াই। সেটা জীবন হোক কী শিল্পর ভিতরের ওই ক্ষিদ্দা যে ক্রমাগত ওঁকে ‘ফাইট কোনি ফাইট’ বলে অনুপ্রাণিত করেছেন।

 

পরিচালকের সঙ্গে সৌমিত্র।

একদিকে বায়োপিক একদিকে ডকু-ফিচার। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে শুরু হল ২০২১। কিছু বলবেন?

‘অভিযান’ ওঁর জীবন আর ‘আমি সৌমিত্র’ ওঁর জীবন দর্শন। আজ ‘অভিযান’-এর ট্রেলার আসছে আর পরের মাসে ২১ তারিখ বাংলা ভাষা দিবসে আসছে এক প্রবাদপ্রতিম বাঙালির জীবন দর্শন নিয়ে ডকু ফিচার। ‘আমি সৌমিত্র’ এবং ‘অভিযান’ এই দুটো কাজ যদি ওঁর জীবদ্দশায় রিলিজ হত, তাহলে একটা অন্য মাত্রা রাখত। উনি নেই। এ এক অনন্ত শূণ্যস্থান। এক মহাবিষাদ…হয়তো এই মহাবিষাদের মহাকাশে এক চিরকালীন মহানক্ষত্র হয়ে উনি আমাদের এই কাজ দেখবেন…এই অলীক আশা রইল আমার।

 

‘আমি সৌমিত্র’-র কোন ‘আমি’ আপনার প্রিয়?

সৌমিত্রবাবুর ভিতরে অহংকারহীন এক নীরব দর্শন ছিল। সে-ই ‘আমি’টাই আমার সবচেয়ে প্রিয়।

আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন

যদি উনি আজ থাকতেন, তাহলে ‘অভিযান’ ও ‘আমি সৌমিত্র’ দুটো ছবির জন্য একই রকম গর্বিত হতেন। ওঁর জাগতিক সব আশীর্বাদ আমরা পেতাম। ওঁর সামনে ওঁকে দেখে উনি কী অনুভব করছেন, সেই বিরল অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়া আর হল না।