অ্যানালগ পেরিয়ে ডিজিটাল, অনলাইন ফোটোগ্রাফি গ্রুপই এখন ছবি তোলার নতুন নেশা 

মোবাইল পেরিয়ে সাধারণ ডিজিটাল ক্যামেরা, এবং তার পরে ডিএসএলআর হয়ে একেবারে হালফিলের মিররলেস ক্যামেরা-বাঙালির ছবি তোলার নেশা পেরিয়েছে অনেকটা পথ। আর সে সব গ্রুপের ঠিকানা? সোশ্যাল মিডিয়া!

অ্যানালগ পেরিয়ে ডিজিটাল, অনলাইন ফোটোগ্রাফি গ্রুপই এখন ছবি তোলার নতুন নেশা 
অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ
Follow Us:
| Updated on: Apr 19, 2021 | 9:21 PM

একটা সময় ছিল, যখন বলা হতো- চার বাঙালি এক জায়গায় হলেই গ্রুপ থিয়েটার খোলে। ছবিটা পাল্টে গেল কয়েক দশক পর। এক হওয়া চার বাঙালির শখের জায়গা নিল বাংলা ব্যান্ড। আরও দু’-এক দশক পার। ইদানীং চার-পাঁচজন বাঙালি এক হলেই খুলে যায় অনলাইন ফোটোগ্রাফি গ্রুপ (Online Photography Group)। যার শুরুটা হয়তো বা ভার্চুয়াল দুনিয়া (Virtual World)-য় হলেও দিব্যি জুড়ে যায় রোজকার বাস্তবে। কাণ্ডারীরা অবশ্যই নেশার সুতোয় গাঁথা- ছবি তোলার নেশা।

অ্যানালগ ফোটোগ্রাফি (Analog Photography) পেরিয়ে এ কালের ডিজিটাল জমানা (Digital Age) -বাঙালির ছবি তোলার নেশা পেরিয়েছে অনেকটা পথ। ফিল্ম কেনার ঝক্কি নেই, রিল ফুরনোর হা-হুতাশ নেই, ছবি প্রিন্ট করানোর অপেক্ষা নেই- ডিজিটাল ক্যামেরা (Digital Camera) এসে যে অনেকখানি উস্কে দিয়েছে এ নেশাকে, তা বলাই বাহুল্য। শুধু তাই-ই নয়, ছবি তোলার শখ পূরণের সাহসও জুগিয়ে দিয়েছে অনেককেই। দামি এসএলআর (SLR)-ডিএসএলআর (DSLR) তো বটেই, হাতে-হাতে ঘোরা আধুনিক মোবাইলের ক্যামেরা (Mobile Camera)-য় তোলা ছবির মানও এখন যথেষ্টই ভাল। ফলে শখের ফোটোগ্রাফারের সংখ্যাটাও বাড়ছে হইহই করে। মোবাইল পেরিয়ে সাধারণ ডিজিটাল ক্যামেরা, এবং তার পরে ডিএসএলআর হয়ে একেবারে হালফিলের মিররলেস ক্যামেরা (Mirrorless Camera) – নিছক শখ থেকে নিজেকে ঘষেমেজে নিয়ে পুরোদস্তুর ফোটোগ্রাফি (Photography)-র কেরিয়ারেও পা বাড়িয়ে দিচ্ছেন অনেকেই।

অনলাইন ফোটোগ্রাফি (Online Photography) গ্রুপের শুরুটাও ঠিক সেখান থেকেই। ছবি তোলার শখ নাড়াচাড়া, ঘষামাজা, একে অন্যের ছবি দেখে শিখে নেওয়া খুঁটিনাটি, ভুলত্রুটি শুধরে ফেলার সুযোগ এবং অবশ্যই নিজের কাজ অনেকের কাছে তুলে ধরার প্ল্যাটফর্ম- এই গ্রুপগুলো সেই ‘সব পেয়েছির দেশ’। সেই সঙ্গেই জুটে যাচ্ছে একই নেশায় মাতোয়ারা নতুন বন্ধু। খুলে যাচ্ছে ওয়ার্কশপ (Photography Workshop) থেকে প্রতিযোগিতা, ফোটোশ্যুট থেকে এগজ়িবিশন কিংবা ফোটোগ্রাফি ট্রিপ (Photography Trip) থেকে ফোটোওয়াকের দরজাও। সুযোগ থেকে সুলুকসন্ধান সবই তার ভাঁড়ারে।

আরও পড়ুন: ওয়ার্ল্ড আর্ট ডে: করোনা আবহেও বিশ্বজুড়ে চলবে শিল্পকলার উদযাপন, সোশ্যাল মিডিয়াতে চলবে উৎসব

আর সে সব গ্রুপের ঠিকানা? ডিজিটাল যুগে জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধর মতোই- সোশ্যাল মিডিয়া (Social Media)! আর তাই ফেসবুক (Facebook) থেকে ইন্সটাগ্র্যাম (Instagram), ফোটোগ্রাফি গ্রুপের (Photography Group) সংখ্যা বাড়ছে রোজই। জেনারেল ফোটোগ্রাফি থেকে নেচার (Nature), ওয়াইল্ডলাইফ (Wildlife) থেকে বার্ডিং (Birding), ট্র্যাভেল (Travel) থেকে ওয়েডিং (Wedding)- সব বিভাগেই খুলে যাচ্ছে গ্রুপ। তাতে হুড়মুড়িয়ে বাড়ছে সদস্য। নিয়মিত ছবি পোস্ট থেকে প্রতিযোগিতা- অংশগ্রহণের উৎসাহও চোখে পড়ার মতোই। সেই সঙ্গেই আছে গ্রুপের মধ্যে বা গ্রুপে-গ্রুপে ছবির টক্কর, ছবি তোলার খিদে বাড়িয়ে তুলতে নিঃসন্দেহে যা অনুঘটক বটেই।

কী ভাবে তৈরি হয় এই গ্রুপগুলো? কেমনই বা তাতে অংশগ্রহণের নিয়মকানুন? কী করেই বা তাতে নিজেকে ঘষেমেজে নেওয়ার সুযোগ হয় সদস্যদের?

ইদানীং ফেসবুকে যে গ্রুপগুলো শখের ফোটোগ্রাফারদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়, সেই তালিকায় উপর দিকেই রয়েছে ‘বিয়ন্ড ভিশন’। প্রায় ৬০ হাজার ছুঁইছুঁই সদস্য সংখ্যার এই গ্রুপে রোজই অজস্র ছবি জমা পড়ে। যা থেকে কিছু নিয়ম মেনে বাছাই করা ছবিগুলো জায়গা পায় গ্রুপের ওয়ালে। কিন্তু কী ভাবে ফোটোগ্রাফারদের শেখার সুযোগ করে দেয় গ্রুপ? কেমনই বা তাতে ছবি পোস্টের করার নিয়মকানুন? বিয়ন্ড ভিশন-এর তরফে বিভাস দেব জানালেন, নেচার (Nature), ম্যাক্রো অ্যান্ড ক্লোজ আপ (Macro & Close-Up), স্ট্রিট অ্যান্ড ডেইলি লাইফ (Street & Daily Life) , ফোটো-ট্র্যাভেল (Photo-Travel), ওয়েডিং (Wedding) এবং পিক্টোরিয়াল (Pictorial)- এই ছ’টি বিভাগে ক্যামেরায় তোলা ছবি দেওয়া যায়। মোবাইলে তোলা ছবি বিবেচিত হয় শুধু ম্যাক্রো অ্যান্ড ক্লোজ় আপ এবং স্ট্রিট অ্যান্ড ডেইলি লাইফ বিভাগেই। ন্যুড আর্ট, ধূমপানের মুহূর্ত, স্টেজড ফ্রেম কিংবা পাখির বাসার ভিতরকার ছবি দেওয়ার নিয়ম নেই এই গ্রুপে। বিভাসবাবুর কথায়, “ভাল ছবি দেখে ফোটোগ্রাফির খুঁটিনাটি শেখার সুযোগ হয় নতুন ফোটোগ্রাফারদের। গ্রুপের তরফে আমরাও কমেন্টে নানা ভাবে শেখাতে চেষ্টা করি। এ ছাড়া, গ্রুপের আয়োজনে ফোটোওয়াক (Photo Walk), পোস্ট প্রসেসিং (Post Processing)-এর ওয়ার্কশপ, নানা রকম ট্রিপ, বার্ষিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমেও নিজেকে ঘষেমেজে নেওয়ার, ভুলত্রুটি শুধরোনোর সুযোগ পান সদস্যরা।’’

Photography Club & Photo Walk

নিজস্ব চিত্র

তবে শুধু যে নতুন ফোটোগ্রাফারদের গড়েপিটে নেওয়ায় বা শখের ফোটোগ্রাফির প্ল্যাটফর্ম হিসেবেই গ্রুপগুলোর ভূমিকা, এমনটা ভাবলে ভুল করবেন। প্রকৃতি, জীবজগৎ কিংবা পরিবেশ রক্ষাতেও তাদের কিছুটা অবদান নিঃসন্দেহে রয়েছে। ফেসবুকের আর এক গ্রুপ ‘নেচার লাভার্স ক্লাব’ যেমন ফোটোগ্রাফি চর্চার চেয়েও বাড়তি গুরুত্ব দেয় প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বপালনে। মূলত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ তাদের লক্ষ্য। তাই এই গ্রুপের দেওয়ালে নিষিদ্ধ নেসটিং, টোপ দিয়ে তোলা জীবজন্তুর ছবি, গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড প্রজাতির পাখির ছবিও। গ্রুপের তরফে তিমিরবরণ মজুমদার বুঝিয়ে দিলেন বিষয়টা- “এই সমস্ত ক্ষেত্রেই ছবি তুলতে গেলে পশুপাখিকে বিরক্ত করা হয়। তাই এ ধরনের ছবি আমরা নিই না। এ ছাড়াও, বাঘের ছবি দিলে ক্যাপশনে তার নির্দিষ্ট নাম উল্লেখ করা বারণ, যাতে চোরাশিকারীরা তাকে চিনতে না পারে। পাশাপাশি, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ দফতর এবং এ নিয়ে কাজ করা কিছু সংস্থার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। কোনও পশুপাখিকে বাঁচানোর প্রয়োজনে বা ছবির মাধ্যমে বিরল কোনও প্রজাতির সন্ধান পেলে আমরা তাদের খবর দিই। সচেতনতার প্রচার, বৃক্ষরোপণ, প্লাস্টিক বর্জনের মতো কাজেও আমরা যুক্ত।’’

Photography Club & Wildlife Awareness

নিজস্ব চিত্র

এমনই আর এক ফেসবুক গ্রুপ ‘বার্ডস অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফি ক্লাব’। তাদের তরফে তাপস খাঁড়া জানালেন, গ্রুপে বার্ডিং, ওয়াইল্ডলাইফ এবং ম্যাক্রো বিভাগে ছবি নেওয়া হয়। তাতে রোজ পোস্ট হওয়া অজস্র ছবির মধ্যে তাঁরা বাছাই করে রাখেন বিরল প্রজাতি এবং বিরল মুহূর্তগুলোর ছবি। এমন সব ছবি সদস্যদের সমৃদ্ধ করে তো বটেই। আর সেই সঙ্গেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতা এবং বার্ষিক প্রদর্শনীর মাধ্যমে গ্রুপের বাইরে সাধারণ মানুষের কাছেও পৌঁছে যায় জীবজগতের আশ্চর্য সব মুহূর্ত এবং বিরল প্রজাতির কথা।

ছবি তোলার শখে বাড়তি উৎসাহ, নানা খুঁটিনাটি শিখে নিজেকে ঘষেমেজে নেওয়ার সুবিধা আছে। আছে প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে ভাল ছবি তোলার খিদে আরও বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ। ভাল ছবি তুললে আছে প্রশংসা, স্বীকৃতিও। আর কী-কী ভাবে শখের ফোটোগ্রাফারদের সাহায্য করে গ্রুপগুলো?

Photography Club & Associations

নিজস্ব চিত্র

ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে নিয়মিত ছবি দেন সায়ন সামন্ত। পেশা অন্য বটে, তবে ছবি তোলা তাঁর নেশা। তাই সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন এ দিক-সে দিক। “প্রত্যেক ফোটোগ্রাফা্রই চায় তার ছবি প্রশংসা পাক। এই গ্রুপগুলো একসঙ্গে অজস্র মানুষের কাছে ছবি পৌঁছে দেয়। চেনা মানুষের গণ্ডি ছাড়িয়ে অনেক অচেনা মানুষও ছবিগুলো দেখতে পান। ছবি ভাল হলে প্রশংসাও আসে অনেক বেশি। আর তা ছাড়া, প্রতিযোগিতা-প্রদর্শনীতে স্বীকৃতি তো আছেই! এটা একটা বিরাট পাওয়া। এই গ্রুপগুলোর প্রদর্শনী, ওয়ার্কশপ বা ফোটোওয়াকে শেখার সুযোগ যেমন যথেষ্ট আছে, তেমনই ভার্চুয়াল জগত থেকে বেরিয়ে এসে সামনাসামনি অন্য ফোটোগ্রাফার বা আরও অনেক মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগও মেলে। এটাও অনেকখানি পাওয়া তো বটেই,’’ বলছেন সায়ন।

Wildlife Photography & Birding

নিজস্ব চিত্র

ইদানীং যাবতীয় শখ বা পেশার মতোই ফোটোগ্রাফি চর্চাতেও মেয়েদের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। মেয়ে হিসেবে কি কোনওরকম অসুবিধেয় পড়তে হয় গ্রুপগুলোয়?

“মোটেই না। বরং এই ফোটোগ্রাফি গ্রুপগুলো মেয়েদের উৎসাহ দেয় অনেক বেশি। ছবি তুলতে যাওয়ার ক্ষেত্রে একা যেতে মেয়েদের অসুবিধে হলে এগিয়েও আসেন গ্রুপের পুরুষ সদস্যরা,” বলছেন অনন্যা বসু। পেশায় ফার্মাসিস্ট, নেশায় ফোটোগ্রাফার কন্যে। জানালেন, ক্যামারেনা অ্যাকাডেমি, বিয়ন্ড ভিশনের মতো গ্রুপগুলো এখন মেয়েদের ফোটোগ্রাফি চর্চাকে গুরুত্ব ও স্বীকৃতি দিতে চালু করেছে ‘শি ফোটোগ্রাফার’ অ্যাওয়ার্ড। মেয়েদের মধ্যে ফোটোগ্রাফির চর্চাকে আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিতে তা সফলও হয়েছে বেশ।

Photography Clubs & Women Empowerment

নিজস্ব চিত্র

সব মিলিয়ে ফোটোগ্রাফির গ্রুপগুলো যে ছবি তোলার নেশাটাকে বেশ খানিকটাই উস্কে দিতে পেরেছে, তা বলাটা খুব ভুল নয় বোধহয়! সোশ্যাল মিডিয়া পেরিয়ে রোজকার জীবনেও ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে ফোটোগ্রাফি চর্চা, খুলে দিয়েছে একই নেশায় মেতে থাকা মানুষদের যোগাযোগের পথও। কে বলতে পারে, আগামী দিনে এই গ্রুপগুলো থেকেই হয়তো উঠে আসবেন নামী কোনও ফোটোগ্রাফার!

অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ