সংখ্যালঘুকে উদ্যোগ নিতে হয়েছে এবং বলতে হয়েছে ‘এসো, আমাদের চেনো’… এর উল্টোটাই আমরা আশা করেছিলাম: সাবির আহমেদ

Know Your Neighbour অর্থাৎ ‘প্রতিবেশীকে চিনুন’। দীর্ঘকাল এক সঙ্গে বসবাস করে, শুধু ধর্মীয় পরিচিতির কারণে যে অজ্ঞতা তৈরি হয় এবং সেখান থেকে যে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়, তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। তা দূর করার উদ্দেশে ‘প্রতিবেশীকে চিনুন’-এর উদ্যোগ।

সংখ্যালঘুকে উদ্যোগ নিতে হয়েছে এবং বলতে হয়েছে ‘এসো, আমাদের চেনো’... এর উল্টোটাই আমরা আশা করেছিলাম: সাবির আহমেদ
উর্দু মানেই একটা ভিনদেশি ভাষা, মুসলমানের ভাষা বলে আমাদের ট্রোল করা হচ্ছে।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Nov 09, 2021 | 2:57 PM

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

সাবির আহমেদ, ‘প্রতীচী (ইন্ডিয়া) ট্রাস্ট’-এর ন্যাশনাল রিসার্চ কো-র্ডিনেটর। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রতিষ্ঠিত এই গবেষণা সংস্থায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও  পরিবেশ নিয়ে গবেষণার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকে। সংস্থার গবেষণার প্রকল্পগুলি রূপায়ণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সাবির। তাঁর গবেষণার বিষয় রাজ্যের সংখ্যালঘু সমাজের অবস্থা। এ রাজ্যের মুসলমানরা কেমন আছেন, তা নিয়ে কুমার রাণা’র  সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় প্রথম বই ‘পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান একটি পরিক্রমা’। এছাড়া শিশুর অধিকার ও সুরক্ষা নিয়ে ধারবাহিকভাবে লিখে যাচ্ছেন। শিশু সুরক্ষা ও অধিকার নিয়ে লেখার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ শিশু অধিকার সুরক্ষা আয়োগ ‘শিশুশ্রী পুরস্কার’-এ ভূষিত করে সাবিরকে।

গবেষণা ছাড়াও ২০০৬  থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তির জন্য ‘প্রতিবেশীকে চিনুন’ নামে এক কর্মসূচীর উদ্য়োক্তা। দীর্ঘকাল এক সঙ্গে বসবাস করে, শুধু ধর্মীয় পরিচিতির কারণে যে অজ্ঞতা তৈরি হয় এবং সেখান থেকে যে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়, তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। এই বিভেদের বাঁধ ভাঙতে শুরু হয়েছিল ‘প্রতিবেশীকে চিনুন’-এর যাত্রা। সমাজ ও উন্নয়ন বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন সাবির।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে সম্প্রতি দুর্গাপুজোর মণ্ডপে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘুদের উপর যে আক্রমণের ঘটনা ঘটল, তার পরিপ্রেক্ষিতেই যোগাযোগ করা সাবির আহমেদের সঙ্গে।


 ‘প্রতিবেশীকে কেন চেনা উচিত’—এই প্রশ্নকে মাথায় রেখেই শুরু হয়েছিল ‘প্রতিবেশীকে চিনুন’ বা ‘নো ইওর নেবার’ (Know Your Neighbour)। সম্প্রতি প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে যে ঘটনা ঘটল এবং তার জেরে যে প্রতিবাদ সংঘটিত হল দুই বাংলায়, তাতে আরও একবার নিঃসন্দেহে ভীষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে ‘প্রতিবেশী’ শব্দটা। রাজনৈতিক মেরুকরণের জেরে যেখানে ব্য়ক্তি-মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মাচরণকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়তে হয় বা হচ্ছে, সেখানে ভিনধর্মের ‘প্রতিবেশী’কে চেনা, জানা, বোঝা আরও কতটা জরুরি হয়ে পড়ছে?

আপনার প্রথম প্রশ্ন, অর্থাৎ সম্প্রতি প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে যে ঘটনা ঘটল এবং তার জেরে যে প্রতিবাদ সংগঠিত হল দুই বাংলায়, তাতে নিঃসন্দেহে আরও একবার ভীষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে এই ‘প্রতিবেশী’ শব্দটা। আপনি একেবারেই ঠিক বলেছেন। আমাদের প্রতিবেশী কারা? আমরা দেখি যে, আমরা একই ভাষায় কথা বলি, একই খাদ্যাভ্যাস, একই পোশাক পরি… অথচ কেবলমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে আমরা একে-অপরের থেকে অনেকটা দূরে। একটা ঐতিহাসিক কারণে আমাদের এই বিভাজনটা আরও বেড়েছে। আমরা জানতাম যে স্বাধীনতার আগে আমাদের একত্রে থাকার, বসবাসের নানা অভ্যাস ছিল। কিন্তু দেশভাগের ফলে আমাদের মধ্যে—মনের দিক থেকে—একটা বিভাজন তৈরি হয়। অসংখ্য মানুষকে পূর্ববঙ্গ থেকে এদেশে চলে আসতে হয়েছে। একইভাবে অসংখ্য মানুষকে এদেশ থেকে পূর্ববঙ্গে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে যেতে হয়েছে। এবং ধর্মীয় এক কারণে আমরা নিজেদের এক গণ্ডি বা ‘এরিয়া’র মধ্যে ঢুকে যেতে বাধ্য় হয়েছি। তার ফলে আমাদের যে এতগুলো মিলের জায়গা… ভাষার জায়গা… পরিধানের জায়গা… খাদ্যাভ্যাসের জায়গা… আচার-আচরণের জায়গা… এই যে সাযুজ্যগুলো… সেসব ভুলে আমরা ধর্মীয় পরিচিতিকে কেন্দ্র করে একটা বিভাজন তৈরি করেছি এবং এই কারণেই বাংলাদেশের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের মনে হয়েছে প্রতিবেশীকে চেনার অনেক কারণ রয়েছে এবং প্রতিবেশীর সঙ্গে আমার মিলই বেশি—অমিল কম। অথচ আমরা বছরের পর বছর ধরে কৃত্রিমভাবে একটা দূরত্ব তৈরি করে রেখেছি।

এই কারণেই যখন আমরা কলকাতায় ‘প্রতিবেশীকে চিনুন’ (Know Your Neighbour) শুরু করেছিলাম (আমাদের গবেষণার উপর ভিত্তি করে), তখন বারবার দেখতে পাচ্ছিলাম যে, সংখ্যালঘুকে কেন্দ্র করে সংখ্যাগুরুর যে অজ্ঞতা, সেই অজ্ঞতা থেকে তৈরি হয় একটা অনীহা এবং অ-পরিচয়। এবং এই অ-পরিচয় থেকেই সুস্থ, স্বাভাবিক সম্পর্ক পরিণত হয় বিষময় সম্পর্কে। আমরা যদি আমাদের এই মিলের জায়গাগুলো… পরিচিতির জায়গাগুলো… যেখানে আমাদের অনেক মিল রয়েছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনার… আলাপের সুযোগ পেতাম, তাহলে হয়তো আমাদের নতুন করে প্রতিবেশীকে চেনার এই উদ্যোগ নিতে হত না। আমরা সহজেই জানতে পারতাম—যেমন আমরা বাংলাদেশে দেখতে পাচ্ছি, এখানেও দেখতে পাচ্ছি—প্রতিবেশীর ধর্মাচরণের সময় আমার ব্যবহার কেমন হবে। যেমন আমার পাড়া মোমিনপুরে দেখেছি আজানের সময় যদি দুর্গাপুজো বা অন্য কোনও পুজোর ঢাক-ঢোল অথবা অন্য কোনও বাদ্য়যন্ত্র বাজে, তাহলে সেই বাদ্য়যন্ত্র সাময়িকভাবে বাজানো বন্ধ রেখে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। এই ধরনের ঘটনা কিন্তু আমরা আকছার দেখি।

কিন্তু আমি এবং আমার প্রতিবেশীরা যদি একসঙ্গে না-থাকি, মিলেমিশে না-থাকি? শহর যেমন একে-অপরের থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে… দক্ষিণ কলকাতা যেমন স্বাধীনতার পর কার্যত মুসলমানশূন্য হয়ে গিয়েছে… অথচ দেশভাগের আগে আমরা জানি কলকাতা শহরের বিভিন্ন অংশে—যেমন গড়িয়াহাট থেকে শুরু করে সাদার্ন অ্যাভেনিউ এবং দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন অংশে—মুসলমান থাকত। এমতাবস্থায় আমরা মুসলমানদের কথা, তাঁদের সঙ্কটের কথা কী করে জানব? এসব কথা জানার জন্য আমাদের আবার উদ্যোগী হতে হচ্ছে আলাপ-আলোচনার… সংখ্যালঘুর কাছে পৌঁছনোর। আমরা একসঙ্গেই থাকছি, এক ভাষাতেই কথা বলছি… কিন্তু আদতে আমরা থাকছি একত্রে আলাদা-আলাদা (‘উই আর লিভিং টুগেদার সেপারেটলি’)। এই ধারণাকে ভাঙার জন্যই প্রতিবেশীকে চেনার আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে।

 ‘সংখ্যালঘু’—বাংলাদেশের ঘটনার পর এই শব্দটা কতটা ভাবাচ্ছে? কোথাও গিয়ে কি মনে হচ্ছে পড়শি দেশের সংখ্যালঘু নাগরিক আর এ দেশের সংখ্যালঘু নাগরিকের সামাজিক অবস্থান আর সমস্যার রাজনৈতিক শিকড় অনেকাংশেই এক?

যে কোনও গণতান্ত্রিক দেশে সংখ্যালঘু কতটা ভাল আছে, তার উপর নির্ভর করেই বোঝা যায় সেই দেশ গণতান্ত্রিকভাবে কতটা শক্তিশালী ও সক্ষম। আমরা, মুসলমানরা, যারা এদেশে আছি, তারা ভারতে প্রায় ১২ শতাংশ এবং পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে প্রায় ৩০ শতাংশ। তা সত্ত্বেও সংখ্যালঘুর যে মন বা সংখ্যালঘুর যে অবস্থান, সাম্প্রতিক মেরুকরণের রাজনীতির ফলে তা একজন সংখ্যালঘুকে নতুন করে মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে। এবং তাকে সারাক্ষণ মনে করানো হচ্ছে তুমি ‘সেকেন্ড ক্লাস সিটিজ়েন’। তোমাকে এখানে মুখ বন্ধ করে থাকতে হবে। তোমার কিছু বলার অধিকার নেই। অথচ সংবিধানগতভাবে সব নাগরিকেরই অধিকার সমান। আজকে আমরা এদেশে দেখলাম খাদ্যকে কেন্দ্র করে গণপিটুনির ঘটনা—কে, কী খাবার খাবে; কার, কী খাবার পছন্দ—মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক মেলামেশাকে কেন্দ্র করে সমস্যা তৈরি হচ্ছে, ধর্মাচরণকে কেন্দ্র করে সমস্যা তৈরি হচ্ছে… একইভাবে আমরা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দেখলাম—হয়তো সংখ্যার নিরিখে তারা কম… কিন্তু সেখানকার সংখ্যাগুরু অর্থাৎ মুসলমানদের উপর আরও দায়িত্ব বর্তায়, কারণ সেখানকার সংখ্যালঘু অর্থাৎ বাংলাদেশের হিন্দুদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে তাদের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। রাজনীতিতে হিংসা, বিদ্বেষই মূলধন। আপনি যদি লক্ষ্য করে থাকেন, তাহলে দেখবেন, গত কয়েক দশকের অন্তত ২টি নির্বাচনে ধর্ম, বিদ্বেষ, মানুষের প্রতি মানুষের বিদ্বেষ… যুদ্ধকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী লড়াই হয়েছে। এখানে কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য পরিষেবা মানুষ কতটা পাচ্ছে—এই নিয়ে যতটা না আলোচনা হয়েছে—তার চেয়ে বেশি কিন্তু মেরুকরণের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে এই ধরনের বিভেদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এবং রাজনীতির কারবারিদের কাছে এটা একটা বিরাট সম্পদ। যত বিদ্বেষের বিষ আমরা ছড়াতে পারব, ততই রাজনৈতিকভাবে আমরা সফল হব। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, দক্ষিণ এশিয়ায় এটাই একটা ধারা হয়ে আসছে। আমরা ধর্মের রাজনীতিকে উস্কে দিয়ে সংখ্যালঘু মানুষকে কোণঠাসা করে রাজনৈতিকভাবে শীর্ষে থাকতে, ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি। সেইজন্য বাংলাদেশে আজ যা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে যা হয়েছে—তা যদি খুব মোটা দাগে আমাদের দেখতে হয়—তাহলে কিন্তু এর পিছনে রাজনীতিই কাজ করেছে। এবং বাংলাদেশের ঘটনাকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে চলবে না।

প্রতি ৪ জনে ১ জন মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও একজন মুসলিম (অথবা ভিনধর্মী) সহ-নাগরিককে সেভাবে চেনা হয়ে ওঠে না আমাদের—এই আক্ষেপ কমাতে কতটা সাহায্য করছে ‘প্রতিবেশীকে চিনুন’ বা ‘নো ইওর নেবার’ (Know Your Neighbour)?

‘প্রতিবেশীকে চিনুন’ একটি ছোট্ট উদ্য়োগ। এবং খানিকটা শহরকেন্দ্রিকও বটে। প্রসঙ্গত, এই উদ্যোগ সংখ্যালঘুকে নিতে হয়েছে এবং বলতে হয়েছে ‘এসো, আমাদের চেনো’। তবে এর উল্টোটাই আমরা আশা করেছিলাম। ভেবেছিলাম সংখ্যাগুরুর একটা দায়িত্ব থাকবে যে, আমাদের প্রতিবেশীরা—যাঁরা এভাবে আর্থিক-সামাজিকভাবে পিছিয়ে—তাঁদের আরেকটু আমাদের জানার, বোঝার দরকার আছে। আমরা চেষ্টা করে যেটা  পেরেছি, তা হল ‘নেবারহুড ওয়াক’। অর্থাৎ প্রতিবেশীদের কাছে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে হেঁটে, সেইসব এলাকার মানুষের খাদ্য, স্থাপত্য, সেখানকার মানুষের কথা জানার চেষ্টা করেছি… এবং এর মধ্যে যে কত বৈচিত্র্য় রয়েছে… যেমন আমরা যখন কলুটোলা স্ট্রিটে হাঁটতে যাই, তখন দেখি বলাইচাঁদ দত্ত বা রায়বাড়িতে ২০০ বছরের প্রাচীন দুর্গাপুজো হয়। অথচ আমরা কলুটোলা স্ট্রিট-জ়াকারিয়া স্ট্রিট-খিদিরপুর বলতেই ভাবি এখানকার একশো শতাংশ মানুষই বুঝি মুসলমান। আদতে কিন্তু এরকম নয়। এদেশে… এ শহরে… অনেক প্রতিবেশী আছেন যাঁরা ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী এবং তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ওই ধরনের এলাকায় বসবাস করেন কোনও রকম ভয়ডর না-করে।

আমরা দেখেছি সংখ্যাগুরুর যে মানসিকতা… তার সাহিত্যে, সিনেমায়, লেখাপড়ায়, আচার-আচরণে সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্ব আমরা সেভাবে দেখতে পাই না। এই প্রতিনিধিত্ব না-থাকার কারণেই একটা বিচ্ছিন্নতা বা যোগাযোগহীনতা (ডিসকানেক্ট) তৈরি হয় এবং এই যোগাযোগহীনতা থেকেই আরও ‘এলিয়েনেশন’ তৈরি হয়। এর জেরে সম্পর্কের একপ্রকার অবনতি হয়। এই অবনতি যাতে আর না-ঘটে, সেজন্য আমরা নানা রকমের উদ্যোগ নিচ্ছি।

‘প্রতিবেশীকে চিনুন’ বা ‘নো ইওর নেবার’ (Know Your Neighbour)-এর দুই সন্তান, থুড়ি, বলা চলে দুই প্রতিবেশী: ‘দোস্তি কি ইফতার’ আর ‘দোস্তি কি উৎসব’। একটু বিশদে বলুন এই দুই পড়শির ব্য়াপারে…

‘দোস্তি কি ইফতার’ শুরুর কারণ ছিল সাম্প্রতিককালে আমরা দেখেছি ইফতারের সময় হালিমকে ঘিরে একটা বিপুল আলোড়ন হয় শহরে… দীর্ঘ লাইন পড়ে হালিমের জন্য… কিন্তু এই হালিম আসলে পাওয়া যায় রমজান মাসে। তখন আমরা ঠিক করলাম যে, আমাদের সহ-নাগরিকেরা—অনেকেই—দীর্ঘদিন ধরে জানেনই না ইফতার কাকে বলে, কেন হয়, কীভাবে পালিত হয়। সেজন্যই আমরা ‘দোস্তি কি ইফতার’ শুরু করেছিলাম। গত চার বছর ধরে সম্পূর্ণভাবে নিজ সম্প্রদায়ের উদ্যোগে চাঁদা তুলে অ-মুসলমানদের জন্য আয়োজন করা হয়েছে এই উদ্যোগের। অনেক মহিলা, অনেক পুরুষ অংশগ্রহণ করেছেন এই ‘দোস্তি কি ইফতার’-এ, যেখানে তাঁরা প্রথমবার এই ধরনের কোনও অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। এবং তাঁরা অনেকগুলি ভাল জিনিস বলেছেন। কী নিষ্ঠার সঙ্গে বিভিন্ন খাবার সাজিয়ে রেখে তাঁরা বসে থেকেছেন এবং সংযমের পরীক্ষা দিয়েছেন, কারণ নির্দিষ্ট সময়ের আগে খাবার মুখে তোলা যাবে না। আরও কয়েকটি জিনিস শিখে তাঁরা খুব আনন্দিত হয়েছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কীভাবে শ্রেণি-নির্বিশেষে মানুষ এক জায়গায় বসে… এক থালায় খাবার খাওয়ার অভ্যাস রপ্ত করছে।

আর এর সূত্রেই শুরু হয়েছিল ‘দোস্তি কি উৎসব’। অনেক ইসলাম ধর্মাবলম্বীই হয়তো ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে মূর্তিপূজা বা অন্য পুত্তলিকা-পুজোর সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেন না। কিন্তু উৎসব সবার—এই ভাবনা থেকেই আমরা ‘দোস্তি কি উৎসব’ শুরু করেছিলাম—যেখানে দুর্গাপুজোর প্রাঙ্গণেই অনেক মুসলমান বন্ধু, যাঁরা কোনও দিন দুর্গাপুজোয় অংশগ্রহণ করেননি, যাঁরা জানেন না কীভাবে এই গোটা পর্বটা অনুষ্ঠিত হয়, তাঁদের জন্য ট্যাংরা অঞ্চলে ‘দোস্তি কি উৎসব’-এর আয়োজন করেছিলাম। প্রচুর মানুষের সাড়া পেয়েছিলাম। এখানে হিজাব পরে বহু মহিলা—যাঁরা জীবনে কখনও এই ধরনের উৎসবে অংশগ্রহণ করতে পারেননি—তাঁরাও হাজির হয়েছিলেন। এবং এই উৎসবকে কেন্দ্র করে একে-অপরকে চেনা-জানাটা হয়।
আমরা মুসলমান পরিবারের কোনও বন্ধু থাকলে ঈদের সময় বা অন্য কোনও পরবে তাঁদের বাড়ি যাই এবং খাবার নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু আমাদের সংখ্যাগুরুদের অনেকেই এভাবে ভেবে দেখেন না যে, ‘আচ্ছা আমরা তো দুর্গাপুজোর সময় তাঁদের (সংখ্যালঘু তথা মুসলমানদের) একবার ডাকতে পারি’। তাঁরা এসে আমাদের সঙ্গে একটু আনন্দ ভাগ করে নিতে পারে… আলাপ-আলোচনা করে নিতে পারে। এই কারণেই কিন্তু আমাদের ‘দোস্তি কি উৎসব’।

অ-মুসলিমকে উর্দু শেখানো—এযাবৎ সবথেকে মনে রাখার মতো ঘটনা কী-কী?

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আট-সাড়ে আট হাজার শব্দ ছিল—উর্দু, আরবি, ফার্সি—যেগুলো বাংলায় মিশে গিয়েছিল, অথচ সেগুলোর বিষয়ে আমরা জানি না। অ-মুসলিম অনেকেই জানতে চান নমাজ মানে কী, আজান মানে কী, আসসালাম ওয়ালাইকুম মানে কী। এগুলো যদিও উর্দু, আরবি, ফার্সি থেকে এসেছে, তবু এদের অর্থ অনেকেই জানতে পারেননি। এই না-জানার কারণে, আমরা দেখেছি, বিভিন্ন সময় বিভ্রান্তিও হয়। এছাড়া রাজনৈতিক কারণে ‘এক ভাষা, এক দেশ’-এর তত্ত্ব প্রচার করতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গার যে উর্দু নাম রয়েছে (যে সব জায়গার সঙ্গে মুসলমান সম্প্রদায়ের যোগ রয়েছে), সেগুলো বদলে দেওয়ার একটা প্রবণতা শুরু হয়েছে। এই ভাষাগুলোকে সবসময় ‘মুসলমানের ভাষা’ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। অথচ আমরা যদি একটু ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করি তাহলে দেখব, মুন্সি প্রেমচন্দ উর্দু চর্চা করেছিলেন। পঞ্জাবি লেখকরাও উর্দু চর্চা করেছিলেন। উর্দু একটা ভাষা—যার উৎপত্তি হয়তো ফার্সি থেকে—কিন্তু তাতে অনেকখানি হিন্দি আর বাংলারও প্রভাব রয়েছে। একসময় রামমোহন ফার্সি শিখেছিলেন। উর্দু পত্রিকা ছিল এখানে। উর্দু, আরবি ভাষায় আর্কাইভ করার মতো প্রচুর জিনিস রয়েছে, যেগুলোর ব্য়াপারে জানতে পারলে আমাদের উপকার হবে। আমরা ইতিহাস-চর্চা করতে পারি। এই কথা মাথায় রেখেই আমরা অতিমারির আগে থেকে উর্দু, আরবি, ফার্সি ভাষার চর্চা শুরু করি। এবং আপনারা জানলে অবাক হবেন, ৮০ শতাংশ অংশগ্রহণকারীই অ-মুসলমান। তাঁদের কেউ কলেজে পড়ান। কেউ আবার ছাত্রছাত্রী। সকলেই আগ্রহ দেখিয়েছেন। এঁদের মধ্যে এক অ-মুসলমান কলেজছাত্রী স্বাধীনতা দিবসে শায়েরি শুনিয়েছেন অনলাইনে। এবং তাঁরা যে এত কাছে থেকেও এত দূরে থাকা একটা ভাষাকে জেনে বিভিন্ন অরিজিন্য়াল টেক্সট পড়তে পারছেন… ইতিহাস-চর্চা করছেন… আনন্দের সঙ্গে ভাষাচর্চা করছেন, যাঁরা একটু-একটু পড়তে পারছেন, তাঁরাও অনুবাদ করার কাজ করছেন, এগুলো অবশ্যই সদর্থক দিক।

নঞর্থক দিক বলতে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে উর্দু মানেই একটা ভিনদেশি ভাষা, মুসলমানের ভাষা বলে আমাদের ট্রোল করা হচ্ছে—আমরা বাংলায় থেকেও কেন মুসলিম ভাষার প্রচার করছি… বলা হচ্ছে জোর করে বাংলায় উর্দু, আরবি, ফার্সি ব্য়বহারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

অ-মুসলমানকে উর্দু শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে যদি মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্তদের সংস্কৃত ভাষা শেখানো যায়…? বিষয়টাকে কীভাবে দেখবেন?

অত্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। শুধু উর্দু নয়, আমরা একসঙ্গে উর্দু ফার্সি এবং আরবি ভাষার একটা চর্চা শুরু করেছি। আগেই উল্লেখ করেছি প্রায় সাড়ে আট হাজারের বেশি উর্দু, আরবি, ফার্সি শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহার করা হয়। এগুলো আমাদের রক্তে মিশে গিয়েছে। এই ভাষাগুলো শিখলে আমরা বুঝতে পারব কীরকমভাবে এই ভাষাগুলো বাংলা ভাষার মধ্যে চলে এসেছে। অন্য দিকে, বাঙালি হিসেবে সংস্কৃত ভাষা চেনা-জানার আগ্রহ, এটা কিন্তু অনেকদিনের। নানান প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমরা দেখেছি বাঙালি মুসলমানদের অনেকের মধ্যেই সংস্কৃত পাঠ নেওয়ার একটা আগ্রহ রয়েছে। যেহেতু পশ্চিমবাংলার স্কুল-শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কৃত পাঠের সুযোগ আছে, অনেক মুসলমান ছাত্র-ছাত্রী এখনও সংস্কৃত পড়েছেন এবং আমরা একটা অনুসন্ধান করে দেখেছি ৭ থেকে ১০ জন মুসলমান সংস্কৃত শিক্ষক হিসেবে পড়াচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে আমি নাজনীন মল্লিকের কথা উল্লেখ করতে চাই। নাজনীন অত্যন্ত একটি দরিদ্র পরিবার থেকে উঠেছেন। এই মহিলা সংস্কৃত পড়েছেন। বর্তমানে পিএইচডি করছেন এবং কলেজে অধ্যাপনা করছেন। আমার মনে হয় সংস্কৃত পড়ার ক্ষেত্রে সরকার যদি মুসলমানদের জন্য স্কলারশিপের ব্যবস্থা করতে পারে, তাহলে সেটা একটা ভাল উদ্যোগ হতে পারে।

বিষয়টা কি ভাষা শেখানো, নাকি ভাষা শেখানোর মাধ্যমে আসলে সংস্কৃতির পারস্পরিক আদান-প্রদান? 

এক্ষেত্রে ভাষাটা একটা অজুহাত মাত্র। এই ভাষা-শিক্ষার মাধ্যমে মতের আদান-প্রদান… একে-অপরকে আরেকটু ভাল করে জানা। একটা অজুহাত সম্প্রতি খাড়া করা হচ্ছে যে মুসলমানরা খুব জোর করে কিছু আরবি, উর্দু, ফার্সি শব্দের ব্যবহার করছে। আগেই উল্লেখ করেছি বাংলায় প্রায় সাড়ে আট হাজার উর্দু, আরবি, ফার্সি শব্দ ব্যবহৃত হয়। এই অভ্যাস বাতিল করার জন্য মাঝেমধ্যে চেষ্টা হয়। কিন্তু প্রায় একশো বছর আগেও এই ধরনের আয়োজন হয়েছিল। এই যে উর্দু, আরবি, ফার্সি বাতিলের কথা, তা বলার চেয়ে জানা ভাল ‘বাতিল’ শব্দটা আসলে আরবি শব্দ থেকে এসেছে। সুতরাং আমরা বিচ্ছিন্নভাবে থাকতে পারি না। অন্য ভাষার থেকে নিজেদের ভাষা সমৃদ্ধ হয়, সমৃদ্ধ হয় অন্য ভাষাও।

সংখ্যালঘুর মন বুঝতে সংখ্যাগুরুকে এগিয়ে আসতে হবে রাজনৈতিকভাবে—কিন্তু সেই রাজনীতি হতে হবে সংখ্যাগুরুর একমেরুকরণের ভারমুক্ত। বাঙালি মুসলিম হয়ে অ-মুসলিম বাঙালিকে উর্দু শেখাতে গিয়ে এটা কীভাবে টের পেলেন বা পাচ্ছেন?

আমি প্রথম থেকেই বলছি শাসক হিসেবে সংখ্যাগুরুর যে দায়িত্ব রয়েছে, সেই দায়িত্বপালনের জন্য তাকে আরও বেশি এগিয়ে আসতে হবে। অন্য় দিকে, সংখ্যালঘুর মন বুঝতে, তার পিছিয়ে পড়ার কারণ বুঝতে আমাদের আরও বেশি করে কাজ করে যেতে হবে। আমরা যদিও বা বাংলায় থাকি, বাংলায় কথা বলি, বাংলায় লিখি, তবুও অনেকেই ফোন করলে প্রথমে বাংলা বা হিন্দিতে প্রশ্ন করেন। বাঙালি পরিচয় থাকা সত্ত্বেও আমাদের উর্দুভাষী বলে চিহ্নিত করা হয়। অন্য় দিকে, উর্দু ভাষার সাহিত্য়গুণ অসীম… আপনারা জানলে অবাকই হবেন যে ঈশ্বরের অবমাননা কিন্তু উর্দু ভাষাতেও হয়েছে। অনেক মুসলমান লেখক তা করেছেন। ভাষাকে কখনওই বেঁধে দেওয়া ঠিক নয়।

এই সত্য-উত্তর বা ‘পোস্ট-ট্রুথ’পৃথিবীতে ধর্ম-জিগির তুলে ধর্মকে বারবার টার্গেট করে দেওয়ার প্রক্রিয়াটা একজন সংখ্যালঘুকে কতটা ভাবায়?

আমি একটা কথা শুরুতেই বলছিলাম যে নাগরিক হিসেবে আমাদের নানান পরিচিত রয়েছে। আমার পরিচয়ের ক্ষেত্রে আমি বলতে পারি, আমি একজন বাংলাভাষী। আমি একজন বাংলাভাষী মুসলমান। আমি একজন পশ্চিমবঙ্গবাসী। আমি একজন ভারতবাসী। কিন্তু আমাদের ধর্মীয় আচার-আচরণ—যেগুলো খুবই ব্য়ক্তিগত—সেগুলোকে, মানে আমাদের ধর্মীয় পরিচয়টাকেই বারবার বড় করে দেখানো হচ্ছে। কেউ যদি নির্দিষ্ট কোনও ধর্মীয় পোশাক পরে থাকেন, কোনও মহিলা যদি বোরখা পরে থাকেন, কোনও পুরুষের যদি দাড়ি-টুপি থাকে, তাহলে তাকে যেভাবে সন্দেহের চোখে দেখা হয়, হেনস্থার শিকার হতে হয়, সেটা একটা নতুন মাত্রা নিচ্ছে। আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই সল্টলেকে মাদ্রাসা কর্মীরা যখন হোটেল ভাড়া নিয়েছিলেন, তখন তাঁদের সরকারি পরিচয়ের তুলনায় ধর্মীয় পরিচয় প্রধান হয়ে উঠেছিল। যার জেরে তাঁদের ঘরভাড়া বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। এটা একটা নতুন ধরনের সঙ্কট এবং এই সঙ্কট ক্রমশ বাড়ছে। এই সঙ্কটের নিরসন ঘটাতে হলে আমাদের একে-অপরকে আরও ভালভাবে চিনতে হবে… জানতে হবে। জাজমেন্টাল হলে চলবে না।

অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ